ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
মো: তোফাজ্জল বিন আমীন : বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক আইপিইউর ১৩৬তম সম্মেলন ঢাকায় শেষ হয়ে গেল। এতে গণতান্ত্রিক ১৩২টি দেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। ৫০টি দেশের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনে টেকসই গণতন্ত্র, সুষম উন্নয়ন, জঙ্গিবাদ দমন, মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। এই সম্মেলনকে সংসদীয় গণতন্ত্রের মিলনমেলা বললে ভুল হবে না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এমন একটি সময়ে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার নির্বাচিত মেয়রদের বরখাস্ত করার ঘটনাটি অংশগ্রহণকারী অতিথিদের সামনে চলে আসায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা কেমন তা পরিষ্কার হয়ে গেছে।
এটা তো অস্বীকার করা যাবে না যে, গণতন্ত্রের বিজয় সুনিশ্চিত করার জন্যই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছিল। কিন্তু সে গণতন্ত্র আজ শৃঙ্খলিত। যে কারণে জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কলমের এক খোঁচায় বরখাস্ত করে দিচ্ছে। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে দেশের মানুষ যখন অংক কষছে, ঠিক তখন আলোচনার মোড় ঘুরে সামনে চলে এসেছে রাজশাহী ও সিলেট। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হবিগঞ্জ পৌরসভা। প্রায় দুই বছর বরখাস্ত থাকার পর উচ্চ আদালতের নির্দেশে মেয়রের দায়িত্ব নিতে গিয়েছিলেন সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ও রাজশাহীর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। আরিফুল মেয়র হিসেবে দুই ঘণ্টা সময় অতিবাহিত করতে পারলেও বুলবুল পেয়েছেন মাত্র আট মিনিট। হবিগঞ্জের মেয়র জি কে গউসও দায়িত্ব নেওয়ার ১১ দিনের মাথায় দায়িত্ব হারান। এই তিনজনকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে বরখাস্ত করা হয়। তিনজনই উচ্চ আদালতের রায়ে ফের দায়িত্ব ফিরে পেয়েছেন। জনগণের ভোটে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রশাসনের জনপ্রতিনিধির প্রতি এ ধরনের আচরণ দুর্ভাগ্যজনক।
বর্তমান সরকারের শাসনামলে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্তের নমুনা নতুন নয়। শুরু থেকেই সরকার ভিন্ন মতের জনপ্রতিনিধিদের সাথে গণতান্ত্রিক ও যুক্তিসঙ্গত আচরণ করেনি। কমিশনার, উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, মেয়র কাউকে বাদ দেয়া হয়নি। স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধিরা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি। তারা স্থানীয় সরকার পরিচালনায় জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন। কোনো দল বা গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব তারা করেন না। অথচ জনগণের নির্বাচিত জনপ্রতিধিদের মধ্যে সরকারদলীয় নন এমন জনপ্রতিনিধিদের মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। দেশে মোট ১২টি সিটি করপোরেশন রয়েছে। তার মধ্যে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে এখনও নির্বাচন হয়নি। বাকি ১১টির মধ্যে ৬টিতে বিএনপির প্রার্থীরা জয়ী হয়েছিল। পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০১৩ সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও গাজীপুরের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিএনপির প্রার্থীরা জয়ী হয়েছিলেন। জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যদি অপরাধী হন তাহলে অবশ্যই দেশের প্রচলিত আইনে বিচার করা উচিত। জনগণ ভোট দিয়েছে বলেই অপরাধী জনপ্রতিনিধি কাউকে দায়িত্ব পালন করতে দিতে হবে এমন দাবি আমি করছি না। তবে বেছে বেছে বিরোধীদলীয় জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দিয়ে বরখাস্ত করা যে হয়রানিমূলক, তা বুঝতে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। আওয়ামী লীগের অনুগত কোনো মেয়র বা চেয়ারম্যানকে বরখাস্ত করা হয়েছে এমন নজির নেই। সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণ দেখে মনে হচ্ছে আর স্থানীয় নির্বাচনের প্রয়োজন নেই। কেননা বিরোধী মতের প্রার্থীরা জয়ী হলেই বরখাস্তের খড়গ নেমে আসে। এভাবে কথায় কথায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বিভিন্নভাবে তাদের দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখার প্রক্রিয়া গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশের পথের অন্তরায়।
শাসক দল আওয়ামী লীগের লোকদের কাজকর্মের বিরুদ্ধে কোনো টুঁ-শব্দ করা বা প্রতিরোধের কেউ নেই। নিজেদের সামান্য একটু সুবিধা ভোগের চিন্তায় নীরব থাকাই অনেকে শ্রেয় মনে করেন। যে কারণে চোখের সামনে ঘটতে থাকা অন্যায়, অনাচার, অবিচার, জুলুমের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলে না। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা বিতর্কিত নির্বাচনের পর সোয়া তিন বছরে প্রায় চারশ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বরখাস্ত করেছে। বরখাস্তের কারণ হিসেবে কয়েকজনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দেখানো হলেও অধিকাংশের বিরুদ্ধে দেখানো হয় রাজনৈতিক সহিংসতায় ঘটা ফৌজদারি মামলা। এক যুগ দেড় যুগ আগের দায়ের করা মামলায়ও জনপ্রতিনিধিদের নাম অন্তর্ভুক্ত করে তাদের সাময়িক বরখাস্ত করার ঘটনা ঘটেছে। রাজনৈতিক ও আইন বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার সংশ্লিষ্ট আইনটি নিজেদের স্বার্থে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ব্যবহার করছে। তারা এটিকে কালো আইন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করা প্রসঙ্গে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, এ ধরনের আইনের সুযোগে সামরিক শাসকরা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণ করত। বর্তমান সরকারও তাই করছে। নির্বাচিত প্রতিনিধিকে ক্ষমতাচ্যুত করা গণতন্ত্রের জন্য অশুভ, গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। একজন যে কোনো দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। জনগণ তাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করলে সেই ব্যক্তি আর দলের থাকে না। সে জনগণের হয়ে যায়। আইন নিজেদের মতো ব্যবহার করে জন প্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা হচ্ছে। এটা গণতন্ত্রের জন্য, জনগণের ভোটের অধিকারের জন্য অশনি সংকেত। সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে। প্রতিপক্ষকে দুর্বল করতে আইনের অজুহাতে এসব করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেটকে ভন্ডুল করা হচ্ছে। এ ব্যবস্থা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এটা গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। সরকার এগুলো থেকে বিরত না হলে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বাড়বে এবং এর পরিণতি ভালো হবে না। বিষয়গুলো বুমেরাং হয়ে এক সময় সরকারের দিকেই ফিরে আসতে পারে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।