ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
আফতাব চৌধুরী : স্বাস্থ্য মানুষের মৌলিক অধিকার। সু-স্বাস্থ্য বজায় রাখা প্রতিটি মানুষের কাছে একটি সামাজিক লক্ষ্য। এ জন্য স্বাস্থ্যক্ষেত্রের পাশাপাশি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে চিকিৎসা সম্পর্কে সুষম ও সুসংহত বাতাবরণ তৈরি করা সম্ভব। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে রোগ প্রতিরোধের ওপর যথেষ্ট পরিমাণে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন থাকা সত্তে¡ও চাহিদা মতো তা করা হচ্ছে না বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। কারণ দেশে এখনও প্রতি বছর প্রসবসংক্রান্ত কারণে হাজার হাজার মহিলা ও শিশুরা মারা যায়। দেশের শহরাঞ্চলে স্বাস্থ্যরক্ষা এবং চিকিৎসার যে সুযোগ-সুবিধা রয়েছে তা সাধারণ জনগণের প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য বলা চলে। আর গ্রামগঞ্জে স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে নানা অভিযোগ, অসুবিধা এবং প্রতিবন্ধকতার সংবাদ পত্র-পত্রিকায় হর হামেশাই প্রকাশিত হয়। এক কথায় দেশে সরকার জনস্বাস্থ্য সেবাকে যতটুকু গুরুত্ব দেয়া উচিত ঠিক ততটুকু দেয়া হচ্ছে না বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।
গ্রামগঞ্জ কিংবা ছোট শহর তো দূরের কথা- আজকাল বড় বড় শহরেও জেনারেল প্র্যাকটিশনার (সাধারণ চিকিৎসক) খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। কারও শরীরে ছোটখাটো সমস্যা দেখা দিলে বা অসুখ হলে তার জন্য কী ওষুধ খেতে হবে তা জানার জন্য আর সাধারণ চিকিৎসককে খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ সাতের দশকের গোড়ার দিকেও শহরে তো ছিলই গ্রামেগঞ্জেও এ ধরনের চিকিৎসকের অভাব টের পাওয়া যায়নি। তাদের ভিজিট ছিল নিতান্ত কম। তারা যে সকল ওষুধ রোগীদের দিতেন তার দামও খুব বেশি হতো না। ওষুধ দেয়ার আগে তারা রোগীকে নিজেই পরীক্ষা করে নিতেন। রক্ত, মল, মূত্র, এক্স-রে, সনোগ্রাফি, স্ক্যানিং ইত্যাদিরও প্রয়োজন হতো না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের দ্বারাই রোগীর সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। কারণ তারা অল্পেই বুঝে নিতে পারতেন রোগীর কী হয়েছে। আজ যেন তারা প্রায় উধাও হয়ে গেছেন। দেশে স্বাস্থ্য সেবার যে কাঠামো এতদিন ছিল তা ইংরেজ এবং পাকিস্তানি শাসনের ফলশ্রæতি। এ অঞ্চলে সে কাঠামো আজ বজায় না থাকলেও ইংল্যান্ডে তা এখনও বজায় রয়েছে। সে দেশে এখনও রোগে আক্রান্ত হলে রোগী প্রথমে চলে যায় জিপি-র (জেনারেল প্র্যাকটিশনার) কাছে। জিপি-রা রোগীকে সুস্থ করতে না পারলে তারাই রোগীকে সে রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেন। এলাকাভিত্তিক জিপি-রা আজও রোগীর সেবা করে চলেছেন।
আমাদের দেশে আজ জেনারেল প্র্যাকটিশনার চালু না থাকায় প্রথমেই চলে যেতে হয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে, যারা ব্যক্তিগতভাবে শহরজুড়ে নিজস্ব চেম্বার খুলে বসে রয়েছেন। রোগীর কী রোগ হয়েছে, তাকে কোন রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে তা নির্ণয় করতে হয় খোদ রোগীকে। কোনও কোনও সময় লক্ষ্য করা যায় রোগীর যে রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে চলে যাওয়ার কথা সেখানে না গিয়ে অন্য রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে চলে যান। চিকিৎসকরা ব্যবসার খাতিরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বহু টাকা রোগীকে খরচ করিয়ে অন্য চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তবে রোগে আক্রান্ত হয়ে রোগীকে যে কোনও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে গেলে প্রায় সব চিকিৎসকই প্রথমে কোনও ওষুধপত্র না দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। ফলে আজ পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠেছে ডায়াগনোস্টিক সেন্টার। সে সব সেন্টারের সঙ্গে বেশিরভাগ চিকিৎসকের ব্যবসায়িক আঁতাত থাকে। কারণ তাদের নির্দেশ মতো ডায়গনোস্টিক সেন্টার ছাড়া অন্যান্য সেন্টারের পরীক্ষা রিপোর্ট তাদের মনঃপুত হয় না। বড় ধরনের কিছু হলে তখন তারা রোগীদের নার্সিংহোম নতুবা বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির জন্য পরামর্শ দেন। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা আজকাল আর বাড়ি গিয়ে রোগী দেখেন না। এছাড়া বিনা অ্যাপয়েন্টমেন্টে মুমূর্ষু রোগীকে রাতদুপুরে কিংবা ভোরবেলায় তাদের কাছে নিয়ে যেতেও নিষেধ আছে। তাই রোগীদের বাধ্য হয়ে নিয়ে যেতে হয় বেসরকারি নার্সিংহোম নতুবা বেসরকারি হাসপাতালে। এছাড়া সেখানে অধিক পয়সার বিনিময়ে চিকিৎসা করালেও রোগীর কী চিকিৎসা হচ্ছে তাও জানা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এ-ও লক্ষ্য করা গেছে যে, রোগীকে তারা সম্পূর্ণ সুস্থ করতে না পারলে ব্যবসার কথা মাথায় রেখে দেশের অন্যান্য স্থানে তাদের পছন্দমতো নার্সিংহোমে পাঠাবার পরামর্শ দেন। এর আগে যতদিন সম্ভব নিজের ক্লিনিকেই থাকতে পরামর্শ দেন।
দেশের সরকারি হাসপাতালের কোনোরূপ নিশ্চয়তা নেই বললেই চলে। সেখানে শয্যা সংখ্যা সীমিত। চিকিৎসকদের বা সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের রোগীর প্রতি সে ধরনের কোনও মাথাব্যথা বা দরদ থাকে না। কারণ চিকিৎসকদের কেবল সরকারি বেতনের বিনিময়ে চিকিৎসা এবং অপারেশন করতে হয়। সরকারি হাসপাতাল কিংবা মেডিক্যাল কলেজগুলোর প্রতি সরকারের নজর প্রায় নেই। কোনও কোনও সরকারি হাসপাতাল বা মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকলেও তা ব্যবহার করার মতো বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার মতো সঠিক ব্যবস্থা থাকে না। এমনকি নষ্ট হয়ে গেলে বছরের পর বছর ধরে তা মেরামত করাও হয় না এমন বিস্তর অভিযোগ পাওয়া যায়। সরকারি বেতনভোগী ডাক্তাররা এ নিয়ে বিশেষ মাথাও ঘামান না। কারণ সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে তাদের সেখানে বেশি সময় সেবা দিতে হবে। বাইরে গিয়ে অর্থ উপার্জন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠবে না। তাই যারা নিতান্তই গরিব শ্রেণির লোক অর্থাৎ যাদের অন্য কোনও বিকল্প ব্যবস্থা নেই তারাই কেবল উপরওয়ালার ওপর ভরসা করে রোগীদের সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করান।
তবে শহরাঞ্চলে চিকিৎসার সুবিধা যেমন-তেমন হলেও গ্রামগঞ্জের পরিস্থিতি আরও করুণ বলা চলে। সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাওয়া তো দূরের কথা, বহু অঞ্চলে আজও এমবিবিএস ডাক্তারের দেখাই পাওয়া দুষ্কর। কোনও কোনও স্থানে মাসের ১ বা ২ দিন একজন করে ডাক্তারকে দেখা যায় গ্রামের বাজারে। শহরের মতো গ্রামে এখনও বৃহৎ অংশের লোক হার্টের অসুখ থেকে শুরু করে ডায়াবেটিস, কিডনির অসুখ থেকে কানের ব্যথা- সব কিছুতেই আল্লাহর ওপর ভারসা করে হাতুড়ে ডাক্তারদের শরণাপন্ন হন। এছাড়া পাড়ায় পাড়ায় হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারখানায় রোগীর ভিড় জমে। কারণ পাঁচ টাকার বিনিময়ে ডাক্তার দেখানোসহ ওষুধপত্রের দাম হয়ে যায়।
আজ বিশ্বায়নের জোয়ারে দেশে স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসা অঙ্গনে বেসরকারি সংস্থাগুলোর দ্রæত বিকাশ ঘটায় বিশ্বের নামকরা ওষুধ কোম্পানিগুলোরও লক্ষ্য হচ্ছে বেসরকারি এবং দামি হাসপাতাল গড়ে তোলা। যে দেশের বেশিরভাগ মানুষ গরিব সে দেশে ওষুধের দাম হাতের মুঠোর মধ্যে থাকার কথা নয়। সরকারের নিদিষ্ট কিছু অংশের মদদে বৃহৎ ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে চক্রান্ত করে বানচাল করছে। আজ দেশে উদার নৈতিক অর্থনীতিতে অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থেকেও সরকারকে সরিয়ে আনা হচ্ছে। দেশের অন্যান্য সেবার মতো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও চলে যাচ্ছে মুনাফাকারীদের হাতে। তাই স্বাভাবিকভাবে বেসরকারি হাসপাতাল এবং নার্সিংহোমগুলো অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ইত্যাদি দ্বারা সমৃদ্ধ হয়ে দিনে দিনে সেজে উঠে রমরমা ব্যবসা করে যাচ্ছে। আজ বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ বা বিদেশ থেকে যে সকল চিকিৎসক ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা ব্যয় করে উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হচ্ছেন তারাও ব্যবসার খাতিরে অধিক অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে সেসব বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে কাজে যোগ দিচ্ছেন, নতুবা যে পয়সা খরচ করে তারা ডাক্তার হয়েছেন সে পয়সা উপার্জন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠবে না। ফলে দেশের গরিব মানুষ ধীরে ধীরে এ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। চিকিৎসা ব্যবস্থা ক্রমশ ব্যয়বহুল হয়ে পড়ায় গরিব মানুষের পক্ষে সঠিক চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। সঠিক চিকিৎসা করানোর লক্ষ্যে যেসব গরিব মানুষ বেসরকারি হাসপাতালে পা বাড়াচ্ছেন সেখানে চিকিৎসাজনিত অত্যধিক ব্যয়ের জন্য অনেকের বাড়ি-জমিও বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে একথা সত্য যে, দেশে সরকার যে ভাবে জনস্বাস্থ্যকে অবহেলা করছে তা দেশের কোটি কোটি গরিব মানুষের ওপর নিঃসন্দেহে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। আর দীর্ঘদিন ধরে সমগ্র দেশজুড়ে বহু সেবা প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ক্লাব, এনজিও মানবিকতার পরিচয় দিয়ে নিঃস্বার্থভাবে বিনা পয়সা নতুবা স্বল্প পয়সার বিনিময়ে দেশের গরিব জনসাধারণের স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে আসছে বলে আজঅবধি হয়তো বা এর বিরুদ্ধে দেশজুড়ে কোনও আন্দোলন বা সংগ্রাম গড়ে উঠেনি। বাংলাদেশের মতো গরিব দেশে রোগ প্রতিরোধের ওপর গুরুত্ব দিয়ে এবং মৃত্যুর হার কমানোর লক্ষ্যে বহু চিকিৎসক স্বল্প পয়সার বিনিময়ে এ সকল সেবা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গরিব জনসাধারণের দিকে চিকিৎসার হাত বাড়িয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করছেন।
তবে লক্ষণীয়, আজ যে সব চিকিৎসক নিজস্ব চেম্বারে বসে বা বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে মোটা অঙ্কের টাকা গুনছেন এদের মধ্যেও বেশ কিছু সংখ্যক দরদি চিকিৎসক সে সব সেবা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিনা পয়সায় নতুবা স্বল্প পয়সায় পারিশ্রমিকে দিনে ২-৩ ঘণ্টা নতুবা সপ্তাহে ১-২ বা ৩ দিন নিঃস্বার্থভাবে দেশের গরিব জনসাধারণের সেবা করে যাচ্ছেন। সময় সময় গ্রামগঞ্জে গিয়ে মেডিক্যাল ক্যাম্প গঠন করে বিনা পয়সায় ওষুধপত্র সমেত রোগীর চিকিৎসা করছেন বলেই হয়তো বা দেশবাসীর গড় আয়ু বৃদ্ধি ঘটছে। কারণ সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দ্বারা আজ তা হবার নয়।
আমাদের দেশের বিভিন্ন শহরে এ ধরনের বেশ কয়েকটি সেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং এরমধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব হাসপাতালও রয়েছে। বাকিরা বিনা পয়সায় গ্রামগঞ্জে গিয়ে মেডিক্যাল ক্যাম্প করে রোগীর সেবা করে চলেছেন। যেসব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব হাসপাতাল রয়েছে সে সব প্রতিষ্ঠানে স্বল্প ব্যয়ে ভালো চিকিৎসা করানো যায় বলে দূর-দূরান্ত থেকেও অসংখ্য রোগী এসে স্বল্প পয়সার বিনিময়ে চিকিৎসা করে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন।
যাই হোক, জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি আজ কেবল যে বাংলাদেশের নিজস্ব সমস্যা তা নয়, গোটা বিশ্বে একই ধারা অব্যাহত। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার উপরও বিশ্বায়নের কু-প্রভাব পড়ছে। তবে আমাদের দেশের মতো বিশ্বের আর কোনও দেশে চিকিৎসাক্ষেত্রে এত বেশি পরিমাণে বেসরকারিকরণ বা বাণিজ্যিকীকরণ ঘটেনি। এদেশে চিকিৎসাসেবা দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির নাগালের বাইরে চলে গেছে। এর আশু প্রতিবিধান অত্যন্ত জরুরি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।