Inqilab Logo

রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

দক্ষিণাঞ্চলে অসময়ের অতিবর্ষণে তরমুজ চাষিরা সর্বস্বান্ত

প্রকাশের সময় : ৪ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:২২ পিএম, ৩ এপ্রিল, ২০১৭

উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে এক-তৃতীয়াংশ
নাছিম উল আল : সর্বকালের সর্বাধিক জমিতে আবাদের পরেও দেশের সিংহভাগ তরমুজ উৎপাদকারী দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকদের এবার মাথায় হাত। গত কয়েক বছরের তুলনায় অধিক আবাদ করেও বসন্তের শুরুর মাঝারী থেকে ভারিবর্ষণে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষককূল। ফলন যখন পরিপক্ব হবার পথে, তখনই গত ১০-১২ মার্চের শতাধিক মিলিমিটার বর্ষণে ভোলা, পটুয়াখালী ও বরগুনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের সবগুলো জেলার তরমুজের জমি প্লাবিত হয়।
এটেল-দোআশ মাটির দক্ষিণাঞ্চলের তরমুজের জমি থেকে পানি সরতে না পাড়ায় বেশীরভাগ ফলই মাঠে বিনষ্ট হয়েছে। হাজার হাজার হেক্টর জমির তরমুজ মাঠ থেকে তুলতেই পারেননি কৃষকগণ। আরো বর্ষণের আতঙ্কে কম ক্ষতিগ্রস্ত জমির অপরিপক্ব তরমুজও কৃষকগণ আগাম তুলে ফেলেছেন। ফলে এবার দক্ষিণাঞ্চলের বাজারে ভালমানের তরমুজের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। মানসম্মত তরমুজ বাজারে না আসায় দক্ষিণাঞ্চল থেকে দেশের অন্যত্র এ ফল রফতানিও হচ্ছে না। কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর-ডিএই’র মতে কৃষি মন্ত্রণালয় চলতি মৌসুমে সারা দেশে প্রায় ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। এর মধ্যে শুধুমাত্র বরিশাল অঞ্চলের ৬টি জেলাতেই ৩৫ হাজার ২৯১ হেক্টরে এ রসালো ফলের আবাদ হয়েছে। কিন্তু গত ১০ থেকে ১২ মার্চের তিনদিনের টানাবর্ষণে এর প্রায় অর্ধেক জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ডিএই’র মতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৩শ’ কোটি টাকা। এর আগে মৌসুমের প্রথম কালবৈশাখীতে ভোলাতেই ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। অথচ দক্ষিণাঞ্চলে মোট আবাকৃত তরমুজের সিংহভাগেরও বেশী ভোলাতেই আবাদ হয়েছে। একই সময়ে বরিশাল, পটুয়াখালী ও বরগুনাতেও বৃষ্টিতে বিপুল পরিমাণ তরমুজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ডিএই’র প্রথমদিকে ক্ষয়ক্ষতির তেমন কোন তথ্য সংগ্রহ না করলেও বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশের পরে তারা মাঠে নামে। ডিএই’র পরিচালক-মনিটরিং ইনকিলাবকে জানান, সারা দেশে চলতি মৌসুমে প্রায় ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদের লক্ষ স্থির করা হলেও শুধুমাত্র বরিশাল অঞ্চলেই ৩৫ সহস্রাধিক হেক্টর জমিতে এ রসালো ফলের আবাদ হয়। কিন্তু অসময়ের অধিক বর্ষণ দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকদের জন্য দুর্ভাগ্য নিয়ে এসেছে। বরিশাল অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক জানান, এ অঞ্চলে যে ৩৫ হাজার ২৯১ হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়, তার প্রায় ৩২% ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ ১১ হাজার ২৫৫ হেক্টর। টাকার অংকে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৩শ’ কোটি টাকা।
তবে বাস্তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৫০ ভাগেরও বেশী বলে জানা গেছে। অবশিষ্ট জমির ফসল ততটা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও তা মান হারিয়েছে। ফলে তরমুজের এ ক্ষতি দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিতে এবার যথেষ্ট বিরূপ প্রভাব ফেলছে। গতবছর ৩২ হাজার ২১৫ হেক্টর জমিতে আবাদের মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের ৬টি জেলায় প্রায় ১৬ লাখ টন তরমুজ উৎপন্ন হয় বলে ডিএই’র দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে। সে হিসেবে চলতি মৌসুমে ৩ হাজার হেক্টর অতিরিক্ত জমিতে তরমুজ আবাদ হলেও উৎপাদন অর্ধেকে হ্রাস পাবার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের তরমুজ চাষিদের প্রায় সকলেই কমবেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বাজারে এর দামও এবার ইতোমধ্যে দেড়গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মানও যথেষ্ট খারাপ।
কৃষিবীদদের মতে, খরা প্রতিরোধক ফসল-তরমুজ অপেক্ষাকৃত শুষ্ক পরিবেশে বেড়ে ওঠে। এমনকি ১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচের তাপমাত্রা তরমুজের গাছ ও এর ফলনের জন্য ক্ষতিকর। ২২ ডিগ্রী থেকে ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসে এ ফসল ভাল হলেও অতিরিক্ত আপেক্ষিক আদ্রতা ও স্যাঁতস্যাঁতে মাটিতে ফুল ও বীজের গুণগত মান বিনষ্ট এবং পু®পায়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাশাপাশি রোগ বালাইয়ের আশঙ্কাও বৃদ্ধি পেয়ে থাকে বলে জানিয়েছেন কৃষিবীদগণ। প্রখর সূর্যালোকসহ শুষ্ক পরিবেশ আগাম পরিপক্বতা এবং ফলের মিষ্টতা ও সুগন্ধ বৃদ্ধি করে থাকে। খরা প্রতিরোধক ফসল-তরমুজ অপেক্ষাকৃত শুষ্ক পরিবেশে বেড়ে ওঠে।
আফ্রিকা মহাদেশর উৎপত্তিস্থল ছাড়িয়ে কুমড়া পরিবারের সুমিষ্ট ফল তরমুজ এখন বাংলাদেশ। এ সুমিষ্ট ফল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশেই এখন আবাদ হচ্ছে। উন্নত বিশ্বে সরাসরি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা ছাড়াও তরমুজ দিয়ে নানা ধরনের শরবত, জ্যাম, সিরাপ, গুড়সহ এ্যালকহলও তৈরী হচ্ছে। চীনা ভেষজবীদদের মতে তরমুজের রস রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে। কৃষি বিজ্ঞানী ও পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে তরমুজে যথেষ্ট পরিমাণ ভিটামিন-এ, রিবোফ্লাভিন, থায়ামিন ও পেকটিন বিদ্যমান রয়েছে। পাকা তরমুজের রসালো শাস স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় হবার পাশাপাশি তা খুবই তৃপ্তিদায়ক ও তৃষ্ণা নিবারক। এমনকি সাইট্রেন শ্রেণীর তরমুজ দিয়ে জেলীও তৈরী হচ্ছে। কৃষি উপযোগী জলবায়ু ও মৌমাছির সাহায্যে পরাগায়িত হয়ে এ ফলের উৎপাদন নিশ্চিত হয়ে থাকে।
গত কয়েক বছরে দক্ষিণাঞ্চলে তরমুজের আবাদ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। কৃষি স¤প্রসারণ অধিদফতরের দায়িত্বশীল সূত্রের মতে ২০১০-১১ সালে বরিশাল কৃষি অঞ্চলের জেলাগুলোতে ১৮ হাজার ৪২৯ হেক্টরে প্রায় ৭ লাখ ৭৯ হাজার টন তরমুজ উৎপাদন হয়। হেক্টর প্রতি উৎপাদন ছিল প্রায় ৪২.২৭ টন। যা পরের বছরে, অর্থাৎ ২০১১-১২তে ২১ হাজার ৫৩৩ হেক্টরে উন্নীত হয়। উৎপাদনও দাঁড়ায় প্রায় ১০ লাখ টনের কাছাকাছি। ২০১২-১৩’তে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে তরমুজের আবাদ প্রায় ১০ হাজার হেক্টর বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩১ হাজার ৪২৪ হেক্টরে। উৎপাদনও ছিল প্রায় ১৩ লাখ ৩৬ হাজার ৭২৬ টন। ২০১৫-১৬তে দক্ষিণাঞ্চলে তরমুজের আবাদ ৩২ হাজার ২১৫ হেক্টরে উন্নীত হয়। উৎপাদনও ছিল প্রায় ১৫.৮৬ লাখ টন। চলতি ২০১৬-১৭তে দক্ষিণাঞ্চলে সর্বকালের সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার ২৯১ হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হলেও তার অর্ধেকই বিনষ্ট হয়েছে অসময়ের অতিবর্ষণে। ফলে উৎপাদনও গতবছরের এক-তৃতীয়াংশে হ্রাস পেয়ে ১০ লাখ টনে সীমাবদ্ধ থাকার আশঙ্কা করছেন মাঠ পর্যায়ের কৃষিবীদগণ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ