ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
আফতাব চৌধুরী : দুর্নীতি একটি কঠিন সামাজিক ব্যাধি। দেশবাসীর মনুষ্যত্ববোধ পুনরুজ্জীবিত না হলে কঠোর আইন করে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করা যাবে না। কেননা, আইন মানুষের দ্বারাই প্রণয়ন ও কার্যকরী করতে হবে। ব্যবহারিক জীবনে আইন কার্যকরী করার মতো দেশে এখন সৎ মানুষের বড়ই অভাব। যে দেশের সমাজে রন্ধ্রে রন্ধ্রে, পরতে পরতে দুর্নীতি ক্যান্সারের মতো ছেয়ে গিয়েছে, সেখানে কেবল কঠোর-কঠিন আইন প্রণয়ন করে দিলেই সুফল আসবে না আইনের রক্ষক যেখানে ব্যক্তিস্বার্থে ভক্ষক, সেখানে সুফল আশা করা শুধু বৃথা। আর আইনের রক্ষকরা যদি ভক্ষক না হতেন, তাহলে দেশজোড়ে প্রচলিত আইনসমূহের এরূপ করুণ পরিণতি হতো না। দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে বা তা নির্মূল করতে দেশের প্রচলিত আইনসমূহের জোরইবা কম ছিল কীসে? কেবল প্রশাসনিক সদ্ব্যবহারের অভাবেই এগুলো গুরুত্বহীন হয়েছে, তা বোধকরি কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না। এককথায় দেশের অধিকাংশ মানুষই আজ মনুষ্যত্বের অবক্ষয় ঘটিয়ে দুর্নীতির করালগ্রাসে গা ভাসিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে, সেখানে ব্যবহারিক জীবনে আইন কার্যকরী করার মতো সৎ মানুষের বাস্তবিকই অভাব রয়েছে।
দুর্নীতি নির্মূলী করণের মাধ্যমে দেশ গড়তে হলে প্রথমত মূল্যবোধযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে। দ্বিতীয়ত, অভিভাবকদের তাদের সন্তানদের দুর্নীতি না করার জন্য শিক্ষা দিতে হবে। তৃতীয়ত, প্রত্যেককেই লোভ সামলাতে হবে। এভাবে এই তিনটি সূত্র প্রয়োগের মাধ্যমে ও শক্তিশালী আইন প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি মহান দেশ হিসেবে গড়ে তোলা যাবে।
আদিকালে মানুষ ছিল অরণ্যচারী। মানুষ আগুন জ্বালাতে জানত না, কাপড় বুনতেও জানত না। প্রয়োজনও বোধ করত না। বনের ফলমূল, কাঁচা মাছ-মাংস ইত্যাদি ভক্ষণ করত। পশুর মতোই সবকিছু করত। এতে স্থান, কাল ও পাত্রে কোনও ভেদাভেদ ছিল না। আল্লাহ মানুষকে বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি দিয়েছেন। পশুকে তা দেননি। আজও পশুরা তাদের পশুত্ব ত্যাগ করেনি। কিন্তু মানুষ প্রকৃতি প্রদত্ত বুদ্ধি, চিন্তাশক্তি ও মনুষ্যত্বের অবক্ষয় ঘটাচ্ছে দ্রুতবেগে। মানুষে ও পশুতে আজ পার্থক্যটা ঠিক এখানেই। সোজা কথায়, পশু আজও তার ঠিক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে, মানুষ তার মনুষ্যত্ব থেকে সরে গিয়েছে। সরে যাচ্ছে। এ সম্পর্কে নিেম্নে দু’চারটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করছি।
প্রকৃতি প্রদত্ত বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তির জোরে মানুষ একদিন সোপান নির্মাণ করে ফেলল। যদিও বস্ত্র বোনার কৌশল আয়ত্ত করতে মানুষের আরও বহুবছর ব্যয় হয়ে গেল। তবুও কী করে শীত-তাপের প্রকোপ থেকে শরীরকে বাঁচিয়ে রাখা যায়, তার উপায় বের করে ফেলল। গাছের ছাল ও লতাপাতায় মানুষ তার দেহের আবরণ তৈরি করে নিল। এ ব্যাপারে যে কেবল শীত-তাপের প্রকোপই তাকে এ বিষয়ে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল তা-ই নয়, দেহের কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও আচ্ছাদিত করে ফেলার তাগিদেও মনের কোণে বাসা বেঁধে ফেলেছিল। মানুষ সাজতে শিখেছে মূলত প্রকৃতিকে দেখেই। মানবদেহের দৃষ্টিকটু অংশসমূহ আবৃত করে ফেলা এবং গো-মহিষাদির মতো পাত্র-পাত্রী বিচার না করে যত্রতত্র সহবাসে লিপ্ত না হওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করে মানুষ সভ্যতার উন্নততর সোপান গড়ে তুলল। অবশ্য এই পর্যায়ে উন্নীত হতে মানুষের আরও বহু হাজার বছর ব্যয় হয়ে গিয়েছে।
সৃষ্টির আদিতেই পশু সংঘবদ্ধভাবে বাস করত। দলবেঁধেই মানুষের ওপর আক্রমণ চালাত। এই আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে মূলত মানুষ সংঘবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করল। গঠিত হলো মনুষ্যসমাজ। বলা হলো, ‘প্রত্যেকেই আমরা পরের তরে।’ কিন্তু ঘাটতি থেকেই গেল। যেমন, এ যুগে আমাদের সবচেয়ে অবক্ষয় ঘটেছে মনুষ্যত্ব, বিবেক ও মানবিক মূল্যবোধের। সৃষ্টির আদিকালে মানুষ যখন পশুর মতো ছিল তখন সঙ্গত কারণেই খাদ্য বা শিকার পেলে তাদের কড়াকাড়ি লেগে যেত। অর্থাৎ, কোনও একজন একাই সবকিছু ভক্ষণ করতে চাইত। বলাবাহুল্য, বলবানরাই এতে সফলও হতো। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণকল্পে তথা সমাজে শৃঙ্খলা স্থাপনার্থে মানুষ রচনা করে ফেলল নানা আইন-কানুনও। মানুষ চলে গেল আইনের অধীনে। শুরু হলো সভ্যতার জয়যাত্রা।
সভ্যতার পতাকায় লেখা হলো, ‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে, সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকেই আমরা পরের তরে।’ এক সময় গণতন্ত্রের নামে দেশে দেশে মানুষের মধ্যে সমবণ্টনেরও ব্যবস্থা করা হলো। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় সম্পদ কেউ একা ভোগ করতে পারবে না। সকলেরই এতে সমান অধিকার থাকবে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয় নব্বই দশক পর্যন্ত মোটামুটি সবই ঠিক চলছিল। আমাদের মানবিক মূল্যবোধ মোটামুটি অক্ষুণœই ছিল। সব বিষয়ে দুর্নীতির এত রমরমা দেখা দেয়নি। সভ্যতার এতগুলো সোপান পেরিয়ে আজ শিক্ষিত বাংলাদেশি যেন সেখানেই ফিরে গিয়েছে! প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতা খুললেই দেখা যায়, একশ্রেণির মানুষ জনগণের বরাদ্দকৃত কোটি কোটি টাকা হাপিস করে দিচ্ছেন। নিম্ন-দরিদ্র মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে এরা ব্যাংকে কোটি কোটি টাকার ভান্ডার গড়ে তুলছেন, নানা স্থানে একের পর এক গগনচুম্বী বিলাসবহুল অট্টালিকা নির্মাণ করছেন। অন্যদিকে, বহু মানুষ বাড়িঘরের অভাবে খোলা আকাশের নিচে গাছতলায় বাস করছেন।
এ কথাটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আল্লাহ সৃষ্ট জীবসমূহের মধ্যে একমাত্র মানুষই আপন প্রগতির পথে বাধা মানেনি। তাই সে আল্লাহ প্রদত্ত চিন্তাশক্তিকে আপন চেষ্টায় শতগুণ প্রসারিত করতে পেরেছে। সে জল-স্থল-অন্তরীক্ষ জয় করে সমগ্র প্রকৃতির ওপর আধিপত্য স্থাপন করেছে, দূরকে নিকট করেছে, কালের ব্যবধানকে ঘুচিয়ে দিয়েছে। আজ আমাদের ঘরে ঘরে টিভি, ইন্টারনেট, কম্পিউটার, হাতে হাতে মোবাইল, সেলফোন ইত্যাদি। কিন্তু বিপত্তিটা হচ্ছে এখানে, সভ্যতায় আমরা যত এগিয়ে যাচ্ছি, মনুষ্যত্ব, বিবেক ও মানবিক মূল্যবোধে যেন আমরা ততই পিছিয়ে পড়ছি! তলিয়ে যাচ্ছি। আমাদের পূর্বপুরুষরা একদিন যেখান থেকে মনুষ্যত্ব, বিবেক ও মানবিক মূল্যবোধের কর্ষণ শুরু করেছিলেন, সভ্যতার নামে শিক্ষিত হয়ে অবক্ষয়ের পথ ধরে যেন আমরা আবার দ্রুতবেগে সেখানেই ফিরে যাচ্ছি।
মনুষ্যত্ববোধ হারিয়ে দেশজোড়া সীমাহীন দুর্নীতির সঙ্গে সমান তালে পালা দিয়ে চলচ্চিত্র, দূরদর্শন বিভিন্ন বেসরকারি টিভি এখন মেতে উঠেছে ললনাদের স্পর্শকাতর অনাবৃত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রদর্শনে। এসবে এদের কেবল নামমাত্র পোশাকেই হাজির করা হচ্ছে। ব্যবহারিক জীবনে তা অনুসরণ করছে কোটি কোটি ললনা। যারা এতে অগ্রণীর ভ‚মিকা পালন করছেন, তারা প্রত্যেকেই আজকের দিনের একশ্রেণির শিক্ষিত ও বড়লোকের আত্মজা অথবা জায়া। এদের পেছনে রাষ্ট্রযন্ত্রের একাংশের প্রচ্ছন্ন মদত রয়েছে। কারণ, এখানে দুর্নীতি বা টাকার খেলা। তা না হলে সেন্সর বোর্ড কী করে সিনেমা-টিভিতে আপত্তিকর দৃশ্যাবলির ছাড় দিচ্ছে? বলাবাহুল্য সম্মুখে দাঁড়ালেই দেখা যায়, কেবল স্বল্পবাসনা লাস্যময়ী নারীদের শরীরী আবেদনের ছড়াছড়ি। বলতে বাধা নেই নারীদেহে পোশাকের স্বল্পতা যেভাবে দ্রুতবেগে সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে তাতে সেই আদিমতায় ফিরে যেতে বোধকরি আমাদের আর বেশিদিন বাকি নেই।
পরিশেষে, বলব এই মুহূর্তে দুর্নীতির আঁতুড়ঘর বা গর্ভগৃহ নির্মূল করার ওপরই বেশি জোর দিতে হবে। আমাদের মিশন হতে হবে কীভাবে আমরা লোভ ও দুর্নীতিকে পরাজয় করব। দুর্নীতির জন্য অবশ্যই সাজা দেওয়া দরকার। কিন্তু এর চেয়েও বেশি দরকার সর্বাগ্রে দুর্নীতিকে পরাজয় করার। এজন্যই ত্রিধারা ফর্মুলার প্রয়োজন। আমাদের মানবিক মূল্যবোধ তথা মনুষ্যত্ববোধের অধঃপতন রোধকল্পে মূল্যবোধযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে। বাস্তবিকই আজ দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে কেবল ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার গড়ার ধুম লেগে গিয়েছে। ‘মানুষ গড়া’র কথা কেউই আর ভাবছেন না! যেন দেশ চালাবেন কেবল ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়াররাই! আমাদের আর যেন কোনও ভাল সিভিলিয়ানের প্রয়োজন নেই! প্রয়োজন নেই ভাল ভাল জজ, ব্যারিস্টার, ম্যাজিস্ট্রেট, আইনবিদ, শিক্ষাবিদ রাজনীতিবিদ, ইতিহাসবিদ, লেখক, সাহিত্যিক, উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা ইত্যাদির। আগের দিনে ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে অভিভাবকরা বলতেন, ‘শিক্ষকমশাই আমার ছেলেকে আপনি ‘মানুষ’ করে গড়ে তুলুন।’ আর আজকের অভিভাবকরা বলছেন, ‘শতকরা একশোভাগ নম্বর পাইয়ে দিন, ওকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার করে দিন।’ শিক্ষাবিভাগ স্কুল থেকে চরিত্রগঠন তথা নীতিশিক্ষার পাঠ উঠিয়ে দিয়েছে। আজকের দিনের শিক্ষাব্যবস্থায় ‘মূল্যবোধযুক্ত শিক্ষা’ ব্যবস্থার কোনো বালাই নেই। দিকে দিকে দুর্নীতির জোয়ার আটকাতে হলে ফের ওই মানুষ গড়ার শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে। চরিত্রগঠন ও নীতিশিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। আর তা করতে হলে ধর্মীয় শিক্ষার বিকাল্প নেই।
গোড়াতেই অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের দুর্নীতি না করার জন্য শিক্ষা দিবেন। সদা সত্য কথা বলতে শেখাবেন। এটা করতে হবে সেই মন্ত্রে- ‘আপনি আচরি ধর্ম পরের শেখায়।’ সন্তানদের সামনে অনেক অভিভাবকই মিথ্যে কথা বলে থাকেন। শিশুরা এটা শেখে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, কোনও এক পাওনাদার বাড়িতে এসে হাঁক দিলেন, ‘নরেনবাবু বাড়ি আছেন কি?’ নরেনবাবু তার ছোট ছেলেকে কানে কানে বলে দিলেন ‘বলে দে বাবা ঘরে নেই!’ এ থেকে ছেলে কী শিক্ষা পেল? ওই ছেলে বড় হলে একদিন ইঞ্জিনিয়ার বা আধিকারিক হয়ে ক’টা সত্য কথা বলবে? একশ’ বস্তা সিমেন্ট দিয়ে কোনও সেতু নির্মাণ করিয়ে দিয়ে এক হাজার বস্তা ব্যয় হয়েছে বলেই হিসাবটা সরকারের কাছে দাখিল করে দেবে।
আজকের দিনে এদের সকলের ক্ষেত্রেই তো ওই কথাটি সমান প্রযোজ্য। আজকের দিনের জনপ্রতিনিধি ও মন্ত্রীরাও তো ঠিক তা-ই। তাই তো দুর্নীতির রমরমা দেখা দিয়েছে। আমাদের শেষ কথা হলো, আমাদের প্রত্যেককেই লোভ সামলাতে হবে। অর্থাৎ, ইউরোপীয় ভোগবাদের প্রবল মোহ ছেড়ে দিয়ে আমাদের মূলমন্ত্র বৈরাগ্যের স্বর্ণখনিতে ফিরে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, ভোগে সুখ নেই, ত্যাগেই সুখ। এই ভোগবাদই ঘুষবাদের জন্ম দিয়েছে। আমার যা আছে তাতেই আমাকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। এই সন্তোষই সুখের মূল।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।