Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

আইনবহির্ভূত বয়ান নয়

অভিভাবক ও ইমামদের প্রতি হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ

| প্রকাশের সময় : ৩ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মালেক মল্লিক : একজন ইমামের দায়িত্ব হলো মুসল্লিদের নামাজ পড়ানো। ইসলাম সম্পর্কে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করা। তিনি এমন কোনো বয়ান দেবেন না যা দেশের প্রচলিত আইনবহির্ভূত। যদি কেউ ইসলাম এবং নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) অথবা যে কোনো ধর্ম নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে অথবা ফেসবুকে পোস্ট দেন তাহলে দেশের প্রচলিত আইনের আওতায় আনার সুযোগ রয়েছে। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার অধিকার কারো নেই। আদালত আরো বলেন, এ মামলার একজন ছাড়া বাকি সবাই মেধাবী শিক্ষার্থী। তারা কেন এই পথে এসেছে তা বোধগম্য নয়। সন্তানদের সঠিক পথে রাখতে অভিভাবকদের আরও বেশি দায়িত্ব পালন করতে হবে। গণজাগরণের কর্মী ও বøগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের হাইকোর্টের রায়ের পর্রবেক্ষণে এমন বক্তব্যই ওঠে এসেছে। গত রোববার বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর  হোসেন ও জাহাঙ্গীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রাজিব হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতের রায় বহাল রেখে এসব পর্যবেক্ষণে দেন।
রায়ে দুইজনের মৃত্যুদন্ড, একজনের যাবজ্জীবন কারাদন্ডসহ আট আসামিকে নিম্ন আদালতের দেয়া সাজা বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। ডেথ রেফারেন্স এবং আসামিদের আপিলের ওপর শুনানি শেষে এ রায় দেয়া হয়। রায়ের পর রাজিবের বাবা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, এটা খন্ডিত রায়। আমি হতাশ। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে।
রায়ে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র রেদোয়ানুল আজাদ রানা ও ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দীপকে মৃত্যুদন্ড, মাকসুর হাসান অনিককে যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং এহসান রেজা রুম্মান, নাঈম ইরাদ ও নাফিজ ইমতিয়াজকে দশ বছর করে সশ্রম কারাদন্ড, আনসারুল্লা বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসীমউদ্দিন রাহমানিকে ৫ বছর সশ্রম কারাদন্ড ও সাদমান ইয়াছির মাহমুদকে ৩ বছর সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জহিরুল হক জহির, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আতিকুল হক সেলিম ও বিলকিস ফাতেমা। আসামিপক্ষে  ছিলেন অ্যাডভোকেট রেজাক খান, মোশাররফ হোসেন কাজল, কামাল হোসেন মিয়া।
গতকাল বেলা ১১ টার দিকে এ মামলার রায় বাংলায় পড়ে শোনান আদালত। আদালত বলেন, মামলার আপিলের শুনানি ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয়েছিল। মাতৃভাষার প্রতি সম্মান জানিয়ে এ মামলার রায় বাংলায় ঘোষণা করা হয়েছে।  
রায়ে আদালত বলেছেন, আসামিদের অপরাধ এতই ভয়ংকর ও নৃসংশ যে তাদের সাজা কমানোর কোনো সুযোগ নেই। এছাড়া আসামিদের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, অপরাপর সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যে আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। রায়ে ৫ আসামিকে সাজা কম দেয়ার বিষয়ে বলা হয়, নিম্ন আদালত সব সাক্ষ্য সঠিকভাবেই পর্যালোচনা করে সাজা দিয়েছে। তাই ওই রায়ে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই। বিচারিক আদালতের রায় পরিবর্তনের কারণ খুঁজে পাইনি। এ কারণে বিচারিক আদালতের রায়ই বহাল রাখা হলো।
এই মামলার বাদী রাজীব হায়দারের সাজা বৃদ্ধিও যে আবেদন করেছিলেন তার খারিজের কারণও ব্যাখ্যা করা হয়েছে রায়ে। আদালত বলেন, এই মামলায় আসামিদের সাজা বৃদ্ধির জন্য বাদীর পক্ষ থেকে একটি রিভিশন আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু আবেদনের শুনানির জন্য কোনো আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন না।
আদালতের পর্যবেক্ষণ : পর্যবেক্ষণে বলা হয়, এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ মামলায় সেসব ব্যক্তিকে নিয়োগ করা উচিত যার দেশের জনগণের জন্য কাজ করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। আন্তরিকতার সঙ্গে সর্বোচ্চটুকু দেয়ার চেষ্টা করবে। তাহলে এ ধরনের অপরাধ সমাজ তথা দেশ থেকে কমবে। দেশের স্বার্থে আইজিপি অবশ্যই বিষয়টি আন্তরিকতার সঙ্গে দেখবেন। আমরা অনেকটা তাই মনে করি। এ মামলার আসামিদের সকলের পিতা-মাতা উচ্চ শিক্ষিত। তাদের উচিত ছিল সন্তানদের সঠিক শিক্ষা দেয়া। কিন্তু তারা তা দিতে পারেনি। সে কারণে তারা গোল্লায় গেছে। পর্যবেক্ষণে আরো বলা হয়, আমরা নিজেদের লাইফ স্টাইল কীভাবে উন্নত করা যায় সেটা নিয়েই ব্যস্ত থাকি।
শিশু সন্তানদের মানসিক অবস্থার কথা, তারা কি করতে চায়, কোন্ বিষয়ে পড়তে চায়, তা না জেনে তার (শিক্ষার্থী) মনের বিরুদ্ধে অনেক কিছু চাপিয়ে দেয়া হয়। এতে তাদের সঠিকভাবে বাড়তে দেয়া হয় না। ফলে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়ে। এ কারণে এ প্রবণতা বন্ধ হওয়া উচিত। এমনকি রাষ্ট্রসহ সচেতন নাগরিকদের চিন্তা করতে হবে সুস্থ রাজনীতি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, ধর্মীয় সম্প্রীতি সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান, স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে জনগণকে সচেতনা গড়ে তুলতে হবে। নিঃসন্দেহে অভিভাবকরা শিশুর প্রাথমিক শিক্ষক। তাই তাদের সেভাবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হবে।  শরিয়া আইন প্রসঙ্গে আদালত বলেন, এ  বিষয়ে আপিল বিভাগের রায় রয়েছে।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জহিরুল হক সাংবাদিকদের বলেন, আজকের তরুণরা কেন বিপথগামী হচ্ছে তা খতিয়ে দেখতে সামাজিক শক্তিগুলোকে তাগিদ দেয়া হয়েছে পর্যবেক্ষণে। সন্তানরা যেন ভালোভাবে গড়ে উঠতে পারে সেজন্য সচেষ্ট থাকতে অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
মামলার প্রক্রিয়া : ২০১৩ সালে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে রাজধানীর পল্লবীতে তার বাসার সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় রাজীবের বাবা ডা. নাজিম উদ্দিনের করা মামলায় ২০১৪ সালের ২৮ জানুয়ারি আট আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। এর পরের বছর ২০১৫ সালের ১৮ মার্চ বিচারিক আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার শুরু করে। সাক্ষ্য গ্রহণ ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে একই বছরের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার ৩ নম্বর দ্রæত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক সাঈদ আহম্মেদ  রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে দুইজনকে মৃত্যুদন্ড, একজনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও ৫ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড ও অর্থদন্ড করা হয়। এ রায়ের পর গত বছর ১৭ জানুয়ারি মামলার নথিপত্র হাইকোর্টে পাঠানো হয়। একই সঙ্গে কারাবন্দি আসামিরা আপিল করে। পরে প্রধান বিচারপতি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মামলার পেপারবুক তৈরির নির্দেশ দেন। এ নির্দেশে মামলাটির পেপারবুক তৈরি হওয়ার পর শুনানির জন্য হাইকোর্ট বেঞ্চে পাঠানো হয়। গত বছর ৩১ অক্টোবর মামলাটি ওই বেঞ্চের কার্য তালিকায় আসে। ৭ নভেম্বর থেকে শুনানি শুরু হয়। নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রানা ছাড়া অপর সাত আসামির আপিলের ওপর শুনানি সম্পন্ন হয় ৯ জানুয়ারি। পরে গত ফেব্রুয়ারিতে রানাকে গ্রেফতার করা হয়। এ অবস্থায় রানা মামলা বাতিল চেয়ে এবং ডেথ রেফারেন্সে শুনানিতে অংশ নেয়ার সুযোগ চেয়ে আবেদন করে। হাইকোর্ট রুল জারি করেন। আদালত সাজা বাতিলের রুল খারিজ করেন এবং ডেথ রেফারেন্সের শুনানিতে অংশ নেয়ার সুযোগ দেন। এরপর তারপক্ষে ২৯ মার্চ শুনানি শেষে ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিলের ওপর একসঙ্গে রায় দিলেন হাইকোর্ট।
রায়ের পর নিহতের বাবার প্রতিক্রিয়া :  রাজিবের পিতা ডা. নাজিম উদ্দিন অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, এটা খন্ডিত রায়। এ রায় প্রত্যাখ্যান করছি। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে। তিনি বলেন, যারা আমার সন্তানকে যারা মেরেছে তারা স্বীকৃত ও প্রমাণিত সন্ত্রাসী। তারা অপরাধের কথা স্বীকার করেছে। তাই তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়েছিলাম। কিন্তু তা হয়নি। তিনি বলেন, সরকার বলছে যে তাদের নীতি হলো জঙ্গিদের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স। সরকার জঙ্গিদের শাস্তি চায়। অথচ এই রায়ের তার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি।  



 

Show all comments
  • Sohaibctg ৩ এপ্রিল, ২০১৭, ১:৪৭ এএম says : 0
    Quran hadither boho bani prosolito ainer shatay shang-gorshik .shongbidanay jekanay dormer moulik odikar shorokkar kotha bola hoyaysay.shekany adaltot kibabay rai deay" ain bohirboto boyan noi" tobay ki ekhon shob imam k roman lawyer hotay hobay.karon shay , ajibon jeai islami shoriyar law faculty podaysay ta ki roman (christiyo) law er podabonoto takibay .iha ki dormoniropekkota na dormo-poradinota?
    Total Reply(0) Reply
  • Mohammed Shah Alam Khan ৩ এপ্রিল, ২০১৭, ৮:৫২ পিএম says : 0
    রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন নিম্ন আদালতের রায় বহাল। সাথে আরো বলেছেন ইমামের দায়িত্ব মুসল্লিদের নামাজ পড়ানো; এটা সত্য তবেঁ নামাজের আগে বয়ান হয়ে থাকে সেই বয়ানটা অবশ্যই কোরান বা হাদিস থেকে আসলে কোন কথা নেই নয়ত ইমামকে অবশ্যই প্রচলিত আইনের বাইরে কোন কথা বলা যাবে না। রায়ে নির্দিষ্ট করে আরো বলা হয়েছে যদি কেউ ইসলাম এবং নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) অথবা যে কোনো ধর্ম নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে অথবা ফেসবুকে পোস্ট দেন তাহলে দেশের প্রচলিত আইনের আওতায় আনার সুযোগ রয়েছে। কাজেই আইন নিজের হাতে নেয়া যাবে না এটাই সত্য। আদালত আরো বলেন, এ মামলায় একজন ছাড়া বাকি সবাই মেধাবী শিক্ষার্থী। তারা কেন এ পথে এসেছে তা বোধগম্য নয়। সন্তানদের সঠিক পথে রাখতে অভিভাবকদের আরও বেশি দায়িত্ব পালন করতে হবে। আদালত তার রায়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন কেন ইমামদেরকে নামজ পড়ানোর কথা স্মরণ করিয়েছেন। কারন আজকাল আমরা ইমামদের কিংবা আলেমদেরকে জিহাদ সম্পর্কে কথা বলতে শুনি বা নাস্তিক বলে তাদেরকে হত্যা করার কথা বলতে শুনা যায় তাই এসব মেধাবী শিক্ষার্থিরা বিপথে যাচ্ছে এর কারন বয়ান ও অভিভাবকদের অবহেলা এটা স্পষ্ট। কাজেই আমিও মনে করি এই রায় যথা যথ মর্যাদার সাথে পালিত হউক এবং যারা এটা মানবেনা তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হউক। আমীন
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ