পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলনসহ বাংলার চিরায়ত রূপ দেখে বিস্মিত বিশ্ব নেতারা
সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ এখন নির্দিষ্ট কোন দেশের সমস্যা নয়, এটি বৈশ্বিক সমস্যা
বিশ্ব শান্তি স্থাপনে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
পঞ্চায়েত হাবিব : বিশাল আয়তনের নৌকার মঞ্চ। সেখানে শিশু, কিশোর, যুবক, বৃদ্ধসহ নানা পেশাজীবি মানুষ। কারো মুখে ট’ু শব্দটি নেই। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সবাই শুনছেন। মঞ্চের একপাশ থেকে ভেসে আসছে একটি বজ্রকণ্ঠ। ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি.........’। প্রথমবারের মতো ঢাকায় অনুষ্ঠিত ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) ১৩৬তম সম্মেলনের উদ্ধোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল আলো আর শব্দের সমন্বয়ে এমনই এক চিত্ররূপের মাধ্যমে। গতকাল (শনিবার) সন্ধ্যায় জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা যেন এক ভিন্ন রূপ পেয়েছিল। যেন সংসদ ভবন নয়, এটিই রেসকোর্স ময়দান।
গত সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় বিশ্বের বৃহত্তম এই সংস্থাটির সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের নেতা শেখ হাসিনা। এসময় তিনি আইপিইউ ওয়েভ টিভির উদ্বোধন ও স্মারক ডাক টিকেট অবমুক্ত করেন। জাতীয় সংসদের স্পিকার ও ১৩৬তম আইপিইউ অ্যাসেম্বলির সভাপতি ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরো বক্তৃতা করেন আইপিইউ প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন চৌধুরী ও আইপিইউ সেক্রেটারি জেনারেল মার্টিন চুংগং। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, রেসকোর্স ময়দান, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণসহ বাংলার চিরায়ত রূপ ফুটিয়ে তোলা হয়।
জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে শুরু হওয়া উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ছিলো ৩৫ মিনিটের সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রথমে কোরিওগ্রাফির মাধ্যমে বাঙালির লড়াই-সংগ্রামের সুদীর্ঘ ইতিহাস ও আবহমান বাংলার সংস্কৃতির চিত্র তুলে ধরা হয়। এরপর থ্রিডি ম্যাপিং ও অটো প্রজেকশনের মাধ্যমে তুলে ধরা হবে বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনার শাসনামল পর্যন্ত বিভিন্ন উন্নয়ন ও বাংলার ঐতিহাসিক স্থাপনার চিত্র। যেখানে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখানো হয় পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর বর্বতার চিত্র।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শুরুতেই ভাষা আন্দোলনের উপর একটি বেদনা বিধূর সংগ্রামের কোরিওগ্রাফি দেখানো হয়। হঠাৎ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, বাংলা চাই শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে নৌকার উপর বসানো মূলমঞ্চ। এরপর ভাষা সংগ্রামীদের উপর নির্মম অত্যাচারের চিত্র। এরপর চলে আসে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের চিত্র। মাটিতে বসে লক্ষাধিক জনতা। মঞ্চে ভাষণ দিচ্ছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ঐতিহাসিক এই ভাষণ শুনে শিহরিত হয়ে ওঠেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া কয়েক হাজার দর্শক।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ নিজ দেশে বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে বিশ্বকে শান্তি, উন্নতি ও প্রগতির পথে আগত বিশ্ব নেতারা এগিয়ে নিয়ে যাবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, বর্তমান বিশ্বের একটি বড় ধরনের সমস্যা হলো সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ। এগুলো মানুষের শান্তি নষ্ট করছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ এখন নির্দিষ্ট কোন দেশের সমস্যা নয়, এটি বৈশ্বিক সমস্যা। এ সমস্যা মোকাবিলায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। তবে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম মূল সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্ষুধা ও অপুষ্টি। বিশ্বের প্রায় ৮০ কোটি শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোতে শিশুরা পুষ্টির অভাবে পিছিয়ে পড়ছে। কিন্তু অন্যদিকে বিশ্বে একদল মানুষ প্রাচুর্যের মধ্যে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দরকার একটু সহযোগিতা। পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে সবাই এগিয়ে এলে বিশ্বকে এক মুহূর্তে ক্ষুধামুক্ত করা সম্ভব। এসময় বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি পেয়েছি। কিন্তু আমাদের লক্ষ আরও অনেক দূর যাওয়া। আমরা বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করতে চাই। আর ২০৪১ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লক্ষে কাজ করে যাচ্ছি। কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী কমিটির চেয়ারপারসন হিসেবে ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী ও আইপিইউ’র প্রেসিডেন্ট হিসেবে সাবের হোসেন চৌধুরীকে নির্বাচিত করায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের এমপিদের ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আইপিইউ প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন চৌধুরী সম্মেলনে আগত সব দেশের জনপ্রতিনিধিসহ পর্যবেক্ষকদের ধন্যবাদ জানান। পাশাপাশি এই সম্মেলনে আতিথেয়তা দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়ে সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, নারীর ক্ষমতায়নের এক রোল মডেল বাংলাদেশ। আজকের সম্মেলনে উপস্থিত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, সংসদের বিরোধী দলের নেতা সবাই নারী। এমন একটি দেশে আইপিইউ’র সম্মেলন এই প্রথম।
‘সমাজের বৈষম্য নিরসনের মাধ্যমে সবার মর্যাদা ও মঙ্গল সাধন’ এই শ্লোগানকে সামনে রেখে আয়োজিত সম্মেলনে সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ১৩২টি সদস্য দেশ ও ৪২টি সহযোগী সংস্থা অংশগ্রহণ করেছে। আর অংশগ্রহণকারী স্পিকারের সংখ্যা ৫৩জন ও ডেপুটি স্পিকার ৪০জন। অংশগ্রহণকারী ৮৯৬ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে ২০৯ জন নারী। এছাড়া সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষক রয়েছেন দু’শরও বেশি। যারা ইতোমধ্যে ঢাকায় পৌঁছেছেন। আর ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বী মিয়ার নেতুত্বে বাংলাদেশের ১৭ সদস্যের প্রতিনিধি দল এই সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন। প্রতিনিধি দলে বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদও রয়েছেন। আগামীকাল (রোববার) থেকে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হবে। চলবে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত।
সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে নিয়ে ১৮৮৯ সালে গঠিত আইপিইউ’র বাংলাদেশ সদস্যপদ পেয়েছে ১৯৭২ সালে। আর জাতীয় সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী ২০১৪ সালের ১৬ অক্টোবর প্রথমবারের মতো আইপিইউ’র প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এরপর আইপিইউ সম্মেলনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। নিরাপত্তা শঙ্কা ও নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা শেষে শুক্রবার সন্ধ্যায় সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছে। পরিবেশ বান্ধব এই সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশের পরিবেশে যতোটা কার্বণ নিঃস্বরণ হবে, সম্মেলন শেষে ততোটা কার্বণ কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে।
সম্মেলনকে ঘিরে নেয়া হয়েছে ব্যাপক নিরাপত্তা। এরআগে নিরাপত্তার শঙ্কায় সিপিএ সম্মেলন বাতিল হওয়ায় বাংলাদেশ নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। তাই সম্মেলনকে সামনে রেখে পুরো রাজধানীতে নিñিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ১০ হাজারেরও বেশি সদস্য এই নিরাপত্তা ব্যবস্থায় দায়িত্ব পালন করছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল সকালে অনুষ্ঠানস্থল ঘুরে দেখেছেন এবং নিরাপত্তার খোঁজ-খবর নিয়েছেন। এসময় পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তার সঙ্গে ছিলেন।
এদিকে সংসদ ভবন এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের পাশাপাশি সম্মেলন চলাকালে সংসদ ভবনে দর্শনার্থী প্রবেশ বন্ধ রাখা হয়েছে। বিমানবন্দরেও দর্শনাথীদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এছাড়া সম্মেলন চলাকালে রাজধানীর কয়েকটি সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। সম্মেলন উপলক্ষে বিমানবন্দর থেকে বিজয় সরণি হয়ে জাতীয় সংসদ ও অন্যদিকে হোটেল সোনারগাঁও পর্যন্ত সড়ক এখন বাহারি সাজে সজ্জিত। বর্ণিল সাজে সেজেছে রাজধানীর অন্যান্য ভিআইপি সড়কগুলোও। এ সড়কপথে দু’টি ফ্লাইওভার জুড়ে রয়েছে আলোর ঝলকানি। পহেলা বৈশাখ (১৪ এপ্রিল) পর্যন্ত এই আলোকসজ্জা থাকবে। আনুষ্ঠানস্থলের পাশাপাশি সংসদ ভবন ও বিআইসিসিতেও বর্ণাঢ্য আলোকসজ্জা করা হয়েছে। ডিজিটাল ডিসপ্লের মাধ্যমে তুলে ধরা হচ্ছে আইপিইউ’র নানা কর্মকান্ড। ব্যানার ফেস্টুনে শোভা পাচ্ছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পিকার ও আইপিইউ প্রেসিডেন্টের ছবি। সেখানে সংসদ ভবনসহ অন্যান্য স্থাপনার ছবিও রয়েছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।