Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গুম খুনের রহস্য উদ্ঘাটনে পুলিশি তৎপরতা নেই

| প্রকাশের সময় : ২ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম


পরিবারগুলোতে থামছে না আহাজারি
রফিকুল ইসলাম সেলিম : ‘আমি বাবার খুশবু পাচ্ছি না কেন, বাবাকে এনে দাও, আমি তার সাথে স্কুলে যাব, তার হাতেই ভাত খাব’। বালিশে মুখ গুঁজে এভাবে আহাজারি করছে শিশু এস এম ইসমাইল (৫)। গত ৯ দিন ধরে সে কাঁদছে। তার কান্নায় কাঁদছে পরিবারের সবাই- স্বজনদেরও চোখে পানি। ইসমাইলের পিতা পরিবহন ব্যবসায়ী এস এম শফিকুর রহমানকে গত ২৪ মার্চ চট্টগ্রাম নগরীর আল-ফালাহ গলির বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।
তার সাথে তুলে নেয়া হয় তার দুই শ্যালক মো. হাসান তারেক ও মোয়াজ্জেম হোসেন সাথীকেও। বাবা আর দুই মামাকে না পেয়ে অঝোরে কাঁদছে ইসমাইল। তার স্কুলে যাওয়াও বন্ধ। তার প্রশ্ন হঠাৎ কেন এমন হলো, আমিও স্কুলে যেতে চাই। পিতার জন্য অবুঝ শিশুটির এ হাহাকার পরিবারের সবাইকে বিমর্ষ করে তুলেছে। একই অবস্থা দুই সহোদর হাসান তারেক ও মোয়াজ্জেম হোসেনের পরিবারেও। হঠাৎ গুম হয়ে যাওয়া ওই তিনজনের পরিবারের মতো চট্টগ্রামে গুম, খুনের নির্মম শিকার যারা তাদের পরিবারে আহাজারি যেন থামছেই না। বিশেষ করে যারা নিখোঁজ কিংবা গুম হয়েছেন তাদের পরিবারে নেমে এসেছে বিষাদের কালো ছায়া।
একের পর এক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নামে তুলে নিয়ে খুন ও গুমের ঘটনা ঘটলেও এসব ঘটনার রহস্য উদঘাটনে পুলিশি তৎপরতা চোখে পড়ছে না। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো যথাযথ আইনি সহায়তাও পাচ্ছে না। নিজেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করে হাত গুটিয়ে বসে থাকছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা- এমন অভিযোগ করে ভুক্তভোগী পরিবারের কয়েকজন সদস্য জানান, কারা লোকজনকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে কিংবা তুলে নিয়ে গুলি করে মারছে তার রহস্য উদঘাটন করার দায়িত্ব পুলিশের। অথচ এক্ষেত্রে পুলিশের নিরবতা কিংবা নির্লিপ্ততায় বড় অসহায় হয়ে পড়েছে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা।
চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত ঘটছে গুম, খুন, অপহরণের ঘটনা। গত ৭ বছরে নিখোঁজের ঘটনায় থানায় ৩ শতাধিক সাধারণ ডায়েরি হয়েছে। আর গত ৫ বছরে নগরীর থানাগুলোতে আড়াইশ’টি অপহরণের মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে নগরীতে অপহরণের মামলা হয় ৫০টি তার আগের বছর হয় ৪৮টি। অপহৃতদের অনেকের লাশ মিলছে অজ্ঞাত হিসেবে। আবার কারও লাশও পাওয়া যাচ্ছে না। মুক্তিপণের দাবিতে অপহৃত হয়েছে এমন অনেকে পণের টাকা দিয়ে মুক্ত হয়ে আসছেন। র‌্যাব-পুলিশের অভিযানেও উদ্ধার হয়েছে অপহৃতদের অনেকে।
এরপরও এখনও নিখোঁজ রয়েছে অসংখ্য মানুষ। নিখোঁজ আর গুমের তালিকায় যোগ হচ্ছে নতুন নাম। অভিযোগ রয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়েই লোকজনকে তুলে নেয়া হচ্ছে। তবে থানা-পুলিশের কাছে গিয়ে প্রতিকার মিলছে না তেমন। নগরীর আল-ফালাহ গলি থেকে তুলে নেয়া তিনজনের কোন খবর গতকাল পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এস এম শফিকুর রহমানের স্ত্রী সুলতানা রাজিয়া টুম্পা ইনকিলাবকে বলেন, আমরা এখনও তার পথ চেয়ে অপেক্ষায় আছি। তিনি বলেন, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে আমরা এখন দিশেহারা। আমার ছেলে কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তার আকুতি আমার স্বামী যদি কোন অপরাধ করে থাকে তাকে আদালতে হাজির করা হোক। তাকে জীবিত ফেরত দেয়া হোক। তিনি বলেন, ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তাকে আধা ঘণ্টার কথা বলে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। অথচ ৯ দিন পার হয়ে গেছে এখনও তার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশের দায়িত্ব তাদের খুঁজে বের করা। কিন্তু আমরা পুলিশের কাছে কোন সহযোগিতা পাচ্ছি না।  
শফিকের সাথে তুলে নেয়া হয় তারেক ও মোয়াজ্জেমকে। তাদের মা মিনা বেগম দুই সন্তানের চিন্তায় এখন শয্যাশায়ী। তারেকের সন্তানসম্ভবা স্ত্রী ফৌজিয়া আইনুন নাহার রুমিও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ৫ এপ্রিল তার সন্তান জন্মের সম্ভাব্য তারিখ দিয়েছে চিকিৎসক। তারেক ও মোয়াজ্জেমের ছোট বোনের এইচএসসি পরীক্ষা আজ থেকে। তারও পড়ালেখার পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে। বাসাজুড়ে চলছে কান্না আর আহাজারি।
ডিবি পরিচয়ে তুলে নেয়া তিনজনের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে নগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আনোয়ার হোসেন বলেন, সিএমপির কোন টিম তাদের গ্রেফতার করেনি। তবে ঢাকা থেকে ডিবির কোন টিম তাদের আটক কিংবা গ্রেফতার করেছে কিনা তাও আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। তিনি বলেন, ঘটনার পর থেকে এ বিষয়ে আমরা খোঁজখবর নিয়েছি। তবে তারা কোথায় তা আমরা জানি না।
বুধবার রাতে তুলে নেয়ার পর বৃহস্পতিবার সকালে রাউজানে পাওয়া যায় ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহ-সম্পাদক নুরুল আলম নুরুর লাশ। পরিবারের অভিযোগ, পুলিশ তাকে তুলে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে। যদিও পুলিশ এ অভিযোগ অস্বীকার করছে। পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ করলেও নুরুল আলমের খুনী কারা কিংবা এ হত্যাকান্ডের রহস্য কি তা উদঘাটনেও কোন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। হত্যাকান্ডের তিনদিন পার হলেও পুলিশ এ ঘটনায় জড়িত কাউকে গ্রেফতারও করেনি।
অন্যদিকে ছাত্রদল নেতা নুরু হত্যার ঘটনায় শুক্রবার গভীর রাতে রাউজান থানার উপ-পরিদর্শক (এস আই) মো. কামাল বাদী হয়ে হত্যা মামলা রুজু করেছেন থানায়। রাউজান থানার ওসি কেফায়েত উল্লাহ বলেন, আমরা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম।  তাদের কাছ থেকে মামলা দায়েরের বিষয়ে সদুত্তর পাইনি। এ কারণে আমরা নিজেরাই মামলা করেছি। এখনও পর্যন্ত এ ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। এ বিষয়ে নুরুর পরিবারের একজন সদস্য জানান, পুলিশ তাকে তুলে নিয়ে হত্যা করেছে- আমরা পুলিশকে আসামী করেই খুব শিগগির আদালতে মামলা করব। পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে থানা কখনও মামলা গ্রহণ করবে না এ কারণেই আমরা থানায় মামলা করিনি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ’র (ব্যবস্থাপনা) ছাত্র তারিকুল ইসলাম রনিরও কোন হদিস মেলেনি গত ৬ দিনে। ২৫ মার্চ নগরীর মুরাদপুর থেকে কয়েকজন তাকে তুলে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় পাঁচলাইশ থানায় রনির এক আত্মীয় বাদী হয়ে একটি অভিযোগ দায়ের করেন। পরে পুলিশ দুজনকে আটক করে। এখনও তাকে উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পাঁচলাইশ থানার এস আই পলাশ সরকার ইনকিলাবকে বলেন, রনিকে অপহরণ করা হয়েছে এটা আমরা নিশ্চিত হয়েছি। দুই আসামীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের একজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে ঘটনা স্বীকার করেছে। তবে রনিকে কোথায় জিম্মি করে রাখা হয়েছে তা এখনও আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি।
গুম, নিখোঁজ হওয়াদের পরিবার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর অজানা আতঙ্ক নিয়ে এখনও স্বজনদের ফিরে আসার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। চট্টগ্রামে গুম হওয়াদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- আলোচিত সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলার প্রধান আসামী আবু মুছা সিকদার। পুলিশের দাবি ওই হত্যাকান্ডের মূলহোতা মুছা। তাকে ধরতে ৫ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করা হয় পুলিশের পক্ষ থেকে। তবে তার খোঁজ মেলেনি এখনও। মুছার স্ত্রী তামান্না সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেছেন গত বছরের ২৩ জুন পুলিশ তাকে তার বাসা থেকে তুলে নিয়ে গেছে। যেসব পুলিশ কর্মকর্তারা তাকে ধরতে বাসায় যান তাদের নামও জানান তামান্না। তবে পুলিশের দাবি তারা তাকে তুলে নেননি।
সম্প্রতি গুম হয়েছেন রাউজানের বাগোয়ান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আবু জাফর, একই উপজেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নের শীর্ষ সন্ত্রাসী আজিমউদ্দিন মাহমুদ ও পশ্চিমগুজরা ইউনিয়নের বদিউল আলম এবং পূর্বগুজরা ইউনিয়নের বড় ঠাকুরপাড়ার নুরুল আজিম। বোয়ালখালী উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও করলডেঙ্গা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ওরফে বাচাকে তার মাইক্রোবাস থেকে নামিয়ে নিয়ে যায় পুলিশ পরিচয়ে একদল লোক। তিনি চট্টগ্রাম থেকে নিজের গাড়িতে ঢাকায় যাওয়ার পর তাকে তুলে নেয়া হয়। তার সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি। তার পরিবারের সদস্যরা এখনও তার পথ চেয়ে আছেন।
নগরীর ব্যবসায়ী ফাহাদ চৌধুরী, ঠিকাদার মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, তরুণী চিকিৎসক ডা. নুসরাত ও মনির হোসেনসহ অনেকে এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। ঠিকাদার মোজাফফর আহমদ চৌধুরী আগ্রাবাদের অফিস থেকে সিডিএ আবাসিক এলাকার বাসায় ফেরার পথে হারিয়ে যান। দীর্ঘ তদন্তের পরও পুলিশ ও সিআইডি এ মামলার কোন কিনারা করতে পারেনি। তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যারা এখনও তার পথ চেয়ে আছেন। মোজাফফর আহমদের কন্যা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের প্রফেসর সুরাইয়া নাজনীন বলেন, আমরা এখনও জানিনা আমাদের বাবা কোথায়। বাবাকে হারানোর কষ্ট বুকে নিয়েই আমরা বেঁচে আছি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ