Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মানুষের নিরাপদ বাসস্থান নিশ্চিত করতে হবে

অভিমত

| প্রকাশের সময় : ২ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম


মো. ওসমান গনি. : পৃথিবীর সব মানুষই একটু সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন ধারণ করতে ভালোবাসে, সুখ-শান্তিতে থাকতে চায়। এ কারণে এখন অনেক গ্রামের মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তাদের ধারণা, গ্রাম ছেড়ে হয়তো শহরে গেলে পাল্টে যাবে তাদের জীবনযাত্রার মান। হতে পারবে তারা অতি তাড়াতাড়ি বড়লোক। এ কারণে শহরমুখী গ্রামীণ জন স্রোত বাড়ছে। এতে গ্রামীণ জনজীবনে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা ক্রমেই সুস্পষ্ট হচ্ছে। গ্রামগুলো আগের আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছে। গ্রাম উজাড় হয়ে যাচ্ছে নানাবিধ কারণে। গ্রাম উজাড় হচ্ছে প্রধানত দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়ণে। অপেক্ষাকৃত ভালো জীবনযাপনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে নিম্নবিত্ত, দরিদ্র শ্রেণি গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হচ্ছে। শহরে পা রাখতে পারলে রিকশা চালিয়ে, শ্রমিক হিসেবে কাজ করে মোটামুটি ভালো উপার্জন সম্ভব। গার্মেন্ট কর্মী হিসেবে কাজ করলে প্রতিমাসে নির্ধারিত বেতন পাওয়া যায় যা গ্রামে বসে অর্জন সম্ভব নয়। অধিকতর উপার্জনের আশায় ঢাকা, চট্টগ্রাম মহানগরী এবং আশপাশের শিল্প এলাকাগুলোতে গ্রাম থেকে আসা নারী-পুরুষের ভিড় বেড়েই চলেছে। এর ফলে শহরে বসবাসকারী লোকজন এখন আর আগের মতো সুন্দর জীবনযাপন করতে পারে না। গ্রামের লোকজন অতিমাত্রায় শহরে আসার কারণে বসবাসের জায়গা দিন দিন কমে যাচ্ছে। ঘেঁষাঘেষি করে বসবাস করতে হচ্ছে এখন শহরে বসবাসকারী লোকজনকে। শহরের লোকজন কোনদিন চিন্তাভাবনাও করেনি যে, এক সময় শহর জীবন এতটা দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। শহরে গ্রামের লোকজনের অতিমাত্রায় আগমনের ফলে বাড়ছে বস্তিবাসী মানুষের সংখ্যা। যারা গ্রামের সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে অধিকতর ভালোভাবে জীবন ধারণের জন্য শহরে পাড়ি জমায় তারা সেখানে গিয়ে বস্তিবাসী হয়ে যায়। অনেক সময় এই বস্তির লোকজন তার গ্রামের লোকজন দেখলে মান ইজ্জতের ভয়ে পালিয়ে থাকে। যারা অধিকতর ভাল জীবনের আশায় গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমায় তাদের দিনকাল গ্রামের চেয়ে খারাপ। বস্তিতে বসবাস করার কারণে তাদের চলাচল, স্বভাব-চরিত্র দিন দিন খারাপ হয়ে যায়। বস্তির লোকজন বর্তমানে মাদক ব্যবসা হতে শুরু করে সকল ধরনের খারাপ ব্যবসার সাথে জড়িত। শহরের খুন-খারাপির সাথেও জড়িত। লেখাপড়ার কোনো সুযোগ তাদের থাকে না। মা, ছেলে, মেয়ে, বাপ সবাই মিলে অন্ন জোগানের চিন্তায় ব্যস্ত থাকার কারণে তারা লেখাপড়া করতে পারে না বা তাদের কেউ লেখাপড়া করার জন্য বলে না বা উদ্যোগ নেয় না। শহরের রাজনৈতিক দলের নেতারা তাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। সবাই তাদের ব্যবহার করে স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করে। তাদের একটু সচ্ছল হয়ে বসবাস করার জন্য কেউ কোনোদিন উদ্যোগ নেয় না বা এগিয়ে আসে না। অনেক সময় দেখা যায়, বস্তির লোকজন সরকারি জায়গায় থাকার কারণে তাদের উচ্ছেদ করে দেয়া হয়।
দেশের সচেতন নাগরিকদের  প্রত্যাশা, দেশের লোকজন যে যেখানে যে অবস্থায় আছে তাদের সেখানে সুস্থভাবে বসবাস করার জন্য পরিকল্পিতভাবে তাদের বাসস্থান নির্মাণ করা হোক। পরিকল্পিত নগরায়ণ হোক বাংলাদেশে। যেখানে থাকবে প্রশস্ত রাস্তা, বিস্তৃত খেলার মাঠ, লেক, সবুজ গাছপালা বনবনানী সমৃদ্ধ পার্ক, সুদৃশ্য বাসযোগ্য টেকসই ইমারত, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, বিনোদনের জন্য অডিটরিয়াম, হল প্রভৃতি। সেখানে যানজট, লোডশেডিং এবং ভোগান্তি, বছরজুড়ে পানি সরবরাহে ঘাটতি, গ্যাস সংকট, ময়লা-আবর্জনার স্তূপ, দুর্গন্ধময় অস্বস্তিকর পরিবেশ কোনোটাই থাকবে না। বর্ষাকালে রাজপথগুলো হাঁটুসমান, কোমর সমান পানির নিচে তলিয়ে গিয়ে দুর্বিষহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না। আলো বাতাসহীন অস্বাস্থ্যকর দুর্গন্ধময় বস্তির বিস্তৃতি ঘটবে না।
এক সময় গ্রাম ছেড়ে শহরে লোকজন চলে যাওয়ার বড় কারণ ছিল দারিদ্র্য। প্রচন্ড অভাব ছিল গ্রামগুলোতে। কৃষকরা তাদের ন্যায্যমূল্য পেত না তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের। আবাদি জমি ছিল অনুর্বর। সেখানে বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষাবাদের তেমন উদ্যোগ ছিল না। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ না থাকার কারণে ফসলের পরিমাণ হতো অত্যন্ত কম। সে সময়ে উৎপাদিত ফসল দিয়ে তাদের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করা যেত না। এ কারণে গ্রামে অভাব, মঙ্গা, দুর্ভিক্ষ লেগেই থাকত। তখন কেউ কেউ অভাবের যন্ত্রণা সইতে না পেরে সচ্ছলতাও সমৃদ্ধির আশায় শহরে পা রাখত। তখন মানুষ অন্নের অভাবে শহরমুখী হতো কোনোভাবে কাজ করে পেট চালানোর জন্য। কিন্তু গত দেড় দুই দশকে গ্রামগুলোর অর্থনৈতিক ভিত্তি আগের চেয়ে অনেকটা মজবুত ও সবল হয়েছে। গ্রামের মানুষ এখন দেশে কৃষি কাজের পাশাপাশি আর ও অনেক কর্ম করে থাকে। গ্রামে এখন এমনও মানুষ রয়েছে যাদের দৈনিক এক থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত আয় বিদেশি রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং গ্রামীণ শিল্প ব্যবসা-বাণিজ্যে অনেক উত্তরণ ঘটেছে এই সময়ের মধ্যে। গ্রামীণ অবকাঠামো বদলে গিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে গতির সঞ্চার করেছে। গ্রামের যে মানুষটি আগে সামান্য আয়ে সন্তুষ্ট থাকত, এখন দেশ-বিদেশে চাকরির সুবাদে প্রতিমাসে হাজার হাজার টাকা পরিবারের জন্য পাঠাতে পারছে। দেশের গার্মেন্ট শিল্পে নিয়োজিত নারী-পুরুষ শ্রমিক-কর্মীদের সবাই গ্রাম থেকেই আসা। ফলে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ সমাগম হচ্ছে গ্রামে। এসব কারণে গ্রামের অর্থনীতি অনেক চাঙ্গা বর্তমানে। বাস্তব অবস্থা হলো, এখন গ্রামবাংলায় কাঁচা ঘরবাড়ি দেখা যায় না। গ্রামে কাজ করার জন্য কৃষি শ্রমিক পাওয়াটা কঠিন ব্যাপার হয়ে গেছে।
গ্রামের লোকজনের অনেকেই মনে করে, শহরের আকাশে বাতাসে টাকা উড়ে বেড়ায়, গিয়ে তা ধরতে পারলেই হলো। এটা যে কত বড় ভুল ধারণা, তা শহরে পা রাখার পর তারা উপলব্ধি করতে পারে। ‘ তখন আর করার কিছুই থাকে না। দু চোখে নানা রঙিন স্বপ্ন নিয়ে গ্রাম থেকে শহরে পা রাখা নারী-পুরুষগুলো প্রত্যাশা অনুযায়ী নিজেকে দাঁড় করাতে পারে না, গ্রামের ভিটেমাটি বিক্রি করে প্রতারকের খপ্পরে পড়ে বিদেশে চাকরি নিয়ে যেতে পারে না। সবকিছুতে ব্যর্থ হয়ে তখন শহরে কোনোভাবে মাথা গুঁজে থাকতে আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করে। ভাড়া করা বাসায় পরিবার নিয়ে বসবাস করতে থাকে। সেখানে অনেক সময় সুস্থভাবে বসবাসের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা থাকে না। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর বস্তিগুলোতে কী নিদারুণ মানবেতর জীবনযাপন করছে লাখ লাখ নারী-পুরুষ-শিশু। এক ধরনের কুৎসিত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কোনোভাবে বেঁচে থাকাটা জীবনযাপন নয়। অথচ গ্রামে তাদের চমৎকার সুন্দর ছিমছাম বসতবাড়ি ছিল। সামনে একটি উঠোন। বাড়ির পাশের আঙিনায় সবজি চাষ হতো যা দিয়ে একটি সংসারের চাহিদা মিটিয়ে বাজারে বিক্রি করে বাড়তি টাকা পয়সা ও রোজগার করা যেত। সারা বছর টাটকা শাকসবজি পাওয়াটা কোনো সমস্যা নয় সেখানে। মিথ্যে স্বপ্নে বিভোর হয়ে শহর নামক তথাকথিত স্বর্গে এসে দারুণ দুর্বিষহ জীবনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাদের। অথচ তারা যদি গ্রামে থেকে বিদ্যমান সামাজিক, অর্থনৈতিক অবকাঠামোতে তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের, উন্নত জীবনযাপনের চেষ্টা চালিয়ে যায় তাহলে অপরিকল্পিত নগরায়ণের অভিশাপ মুক্ত হতে পারব আমরা। এতে করে গ্রাম-শহর সকল শ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রার মান ও চলাফেরায় এসে যাবে গতিশীলতা, কেটে যাবে তাদের দুর্বিষহ জীবনের কষ্ট। বিশ্বের অনেক দেশেই তাদের নাগরিকদের পরিকল্পিত বাসস্থানের কারণে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষের জীবন বিভিন্ন দুর্ঘটনা হতে বেঁচে যায়। অগ্নিকান্ড, ভূমিকম্পসহ আরও অন্যান্য সমস্যার হাত থেকে আমাদের বাঁচতে হলে অবশ্যই পরিকল্পিত বাসস্থান নির্মাণ করতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ বাসস্থান নির্মাণ করে যেতে হবে আমাদের যাতে তারা তাদের জীবন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে অতিবাহিত করতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক কলামনিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন