Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব কী হচ্ছে?

| প্রকাশের সময় : ৩১ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

স্টালিন সরকার : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় দেশের সাংস্কৃতির রাজধানী। কেউ বলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য-ভূস্বর্গের লীলাভূমি। ক্যাম্পাসের চিরসবুজ প্রকৃতিতে রয়েছে দেশী-বিদেশী কয়েকশ’ প্রজাতির গাছ। আম, কাঁঠাল, শিমুল, কৃষ্ণচূড়া, বহেরা, সেগুন, পলাশ, ছাতিম ছাড়াও অসংখ্য বাহারী ফুলের গাছ। মন যদি খারাপ হয় তাহলে চলে যান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য মন ভরিয়ে দেবে। আহা শীতকালে সাইবেরিয়া থেকে আসা অতিথি পাখির কলতানের অপরুপ দৃশ্য! শুধু কী তাই? রাজধানীর অদূরে দেশের একমাত্র আবাসিক এই বিশ্ববিদ্যালয়টি নানা কারণে আলোচিত। ১৯৭০ সালে ‘জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৭৩ সালে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে নামকরণ করা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে অনেক বরেণ্য শিক্ষাবিদ, জ্ঞানতাপস এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন; করছেন। এ ছাড়াও এশিয়ার বৃহত্তম গবেষণা কেন্দ্র, নাট্টচর্চা, যৌন নিপীড়ন সেলসহ স্বাতন্ত্র কিছু কর্মকাÐের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি গর্ব করার মতোই। উয়ারী-বটেশ্বরে প্রতœতত্ত¡ বিভাগের খননকার্য, দেশীয় নাট্যচর্চায় নাটক ও নাট্যতত্ত¡ বিভাগ, ইতিহাস বিভাগের ‘ক্লিও’ নৃবিজ্ঞান বিভাগের ‘নৃবিজ্ঞান পত্রিকা’ বাংলা বিভাগের ‘ভাষা ও সাহিত্য পত্র’ ইংরেজি বিভাগের ‘হারভেস্ট’ দর্শন বিভাগের ‘কপুলা’সহ বিভিন্ন বিভাগের গবেষণা-প্রকাশনা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে গেছে। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিংয়ের নামে এসব কী হচ্ছে? যে বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের নাট্ট আন্দোলনের আতুরঘর বলা হয় সেখানে বিধর্মী গ্রিক কালচার র‌্যাগের নামে নতুন শিক্ষার্থীদের ওপর নিত্যদিনই শারীরিক-মানসিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে; অসভ্যতা হচ্ছে। এটা কেমন সভ্যতা?
মিডিয়ায় খবর বের হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিংয়ের নামে নতুন শিক্ষার্থীদের মা-বাবা তুলে গালি দেয়া হচ্ছে; কান ধরে উঠবস করানো এবং হাই ভোল্টেজের লাইটের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে। দাঁড় করিয়ে রাখা হচ্ছে ক্যাম্পাসের লাইব্রেরির সামনে এক পা কাটা ও অন্যহাতে অস্ত্র ধরা সংসপ্তক ভাষ্কর্যে মতো করে। গ্রাম থেকে উচ্চশিক্ষা নিতে আসা ছাত্রদের আবাসিক হলে মুরগী বা ব্যাঙ-এর মতো আচরণ করতে বাধ্য করে মজা করা হচ্ছে। বাধ্য করছে জানালার রড ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঝুলে থাকতে নিরীহ গোবেচারা ছাত্রদের। নতুন ছাত্রদের ওপর চালানো হচ্ছে আরো নানা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। অশ্লীল বিষয় নিয়ে নিত্যরাতে ডিবেট করানো র‌্যাগিংয়ের নিয়মিত বিষয়বস্তু হয়ে গেছে। এমন নির্যাতন সয়ে সয়ে অনেক শিক্ষার্থীই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। নির্যাতন সইতে না পেরে হল ছেড়ে দিচ্ছেন কেউ কেউ। প্রশ্ন হলো কর্তৃপক্ষ কী এসব দেখছেন না? নাকি তারা এখন ছাত্রলীগ নেতা জসিম উদ্দিন মানিকের ‘মানসিকতা’ লালন করছেন? ১৯৯৮ সালে জসিম উদ্দিন মানিক একশত মেয়েকে ধর্ষণের বিভৎসতা করে গৌরবের সঙ্গে ‘ধর্ষণের সেঞ্চুরি’ উদযাপন করেছিল। ওই সময় সাধারণ ছাত্রছাত্রী ও অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলো তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে ধর্ষক মানিককে ক্যাম্পাস ছাড়া করে। পরবর্তীতে আরো কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। শুধু কী তাই! কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধেও ছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগ উঠে। যার কারণে ‘যৌন নিপীড়ন সেল’ গঠন করা হয়েছে। সেগুলো অন্য প্রসঙ্গ। বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল সেন্টারে সাংবাদিকরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন প্রতিরাতে বিভিন্ন হলে র‌্যাগিংয়ের ‘শিকার’ শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে। সিনিয়র ছাত্রদের হাসিঠাট্টা মেটাতে বাধ্য হয়ে রাত জেগে র‌্যাগ দেয়ার কারণে ঠাÐা জ্বরেও আক্রান্ত হচ্ছে। গত ৯ মার্চ থেকে ১ম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু হয়েছে। এই কয়েকদিনে প্রতি হলে র‌্যাগিংয়ের কারণে ২০ থেকে ২৫ জন ছাত্র অসুস্থ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যালে চিকিৎসা নিয়েছে। র‌্যাগিংয়ের শিকার শিক্ষার্থীরা দুঃখ করে বলেছেন, কত স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হয়েছি। এখন দেখছি এটা বিশ্ববিদ্যালয় নামের জাহান্নাম! উচ্চশিক্ষা নিতে এসে প্রতি মুহূর্তে মানসিক-শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। কিন্তু আমরা তো কোন অপরাধ করিনি। র‌্যাগিং-এর নামে আমাদের কেনো এভাবে শান্তি দেয়া হবে? এই র‌্যাগিং এর খবর কর্তৃপক্ষের নজরে আছে। সে জন্যই ২১ মার্চ প্রাধ্যক্ষ কমিটির জরুরি সভায় র‌্যাগিং ঠেকাতে হলের শিক্ষকদের রাত পর্যন্ত ‘হলে’ অবস্থান করার সিদ্ধান্ত হয়। ওই পর্যন্তই। তাহলে কী গ্রাম থেকে পড়তে আসা ছাত্ররা র‌্যাগিং এর নামে জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেই যাবে?
র‌্যাগিং কী? র‌্যাগ শব্দটি মূলত ইংরেজি র‌্যাগিং থেকেই এসেছে। এটা আসলে গ্রিক কালচার। সপ্তম-অষ্টম শতকে ইউরোপে খেলার মাঠে ‘টিম স্পিরিট’ বাড়াতে র‌্যাগিংয়ের প্রচলন শুরু হয়। অষ্টদশ শতকে ‘র‌্যাগ সপ্তাহ’ প্রচলন শুরু হয় আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। র‌্যাগ ডে’র উদ্দেশ্যে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা নতুন ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে পুরনোদের আনন্দের মাধ্যমে পরিচিত হয়ে তাদের সংকোচ কাটিয়ে তোলার দিন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটছে উল্টো ঘটনা। র‌্যাগের নামে নতুন ছাত্রদের শাস্তি দিয়ে ভীত-আতঙ্কিত করে তোলা হচ্ছে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিংয়ের বিকৃত মানসিকতার সিনিয়র কিছু ছাত্র নিজের জীবনের কিছু অতৃপ্ত কামনা-বাসনা, মানসিক ও শারীরিক অতৃপ্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে র‌্যাগিং করছে। এ ছাড়া নতুন ছাত্রছাত্রীদের ওপর নিজেদের ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো, সিনিয়র দ্বারা নিজেদের পূর্ব র‌্যাগিংয়ের প্রতিশোধ নেয়া, ভবিষ্যৎ জোরপূর্বক অনৈতিক কাজে সাহায্যকারী হিসেবে তাদের ব্যবহার করার মানসিকতা থেকে র‌্যাগ পালন করছে বিকৃত রুচির কিছু শিক্ষার্থী। প্রশ্ন হলো, এসবে কী বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম বাড়ে না কমে? দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগরে ভাইস চ্যান্সেলর একজন নারী। অথচ সেই বিশ্ববিদ্যারয়ে ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনা অহরহ ঘটছে। এখন র‌্যাগিং-এর নামে নতুন ছাত্রদের ওপর জুলুম-নির্যাতন-পীড়ন হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সাংস্কৃতির রাজধানী খ্যাত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গর্ব করার অনেক কিছুই আছে। সেই গর্ব কী র‌্যাগিং-এর ময়লায় কুখ্যাতির ভাগারে পরিণত হবে?



 

Show all comments
  • তাহসিন ৩১ মার্চ, ২০১৭, ১১:২০ এএম says : 0
    এগুলো বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে কঠোর হতে হবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ