Inqilab Logo

বুধবার ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, ০৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামের প্রথম খলিফা

| প্রকাশের সময় : ৩১ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

কে এস সিদ্দিকী
(২৪ মার্চ প্রকাশিতের পর)
আম্বিয়ায়ে কেরামের পর বিশ্বের বুকে শ্রেষ্ঠ মানব হিসেবে খ্যাত (আফজালুন্নাস) ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর খেলাফতকাল ছিল মাত্র দুই বছর তিন মাস এগারো দিন। এ স্বল্প শাসনামলে তিনি ইসলামের যে অনন্য খেদমত আনজাম দিয়েছেন তার একটা ঝাপসা চিত্র আমরা পূর্বে তুলে ধরেছি। তার অন্তিমকালটাও ছিল তার শাসনামলের অন্তর্ভুক্ত এবং তার এ সময়ের কর্মগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি ইসলামী গণতন্ত্রের এমন এক আদর্শ-নমুনা রেখে গেছেন যা ছিল মুসলিম শাসকদের জন্য অনুকরণের-প্রেরণার উৎস। তিনি পরবর্তী খলিফা মনোনয়ন ও তার জন্য যে ‘অছিয়ত’ বা উপদেশনামা রেখে যান, তা এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত।
হজরত সিদ্দিকের (রা.) সম্পর্কে খোদ রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমার পরে যদি কোনো নবীর আবির্ভাব ঘটত তাহলে আবুবকর সিদ্দিক (রা.) নবী হতেন। যেহেতু হুজুর (সা.)-এর পর আর কোনো নবী হবে না নবুওয়াতের দরজা কেয়ামত পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে, এমনকি নবী হজরত ঈসা (আ.) শেষ জমানায় আসমান হতে অবতরণ করে দুনিয়ায় আগমন করার শেষ নবী হজরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর উম্মত পরিচয়ে নিজেকে অভিহিত করতেন, যেহেতু নবীর পরে সিদ্দিকের মর্যাদা, তাই হজরত আবু বকর (রা.) সেদিক থেকেও সিদ্দিক।
ইসলামের এ মহান খলিফার অন্তিমকালও আদর্শের নমুনায় ভরপুর, তার পীড়িত হওয়ার একটি ঘটনা বিখ্যাত মোহাদ্দেস ও সিরাত লেখক ইবনে শাহাব উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, একবার হজরত সিদ্দিকে আকবর (রা.)-এর নিকট হাদিয়া হিসেবে কিছু গোশত আসে। তিনি এ গোশত হারেস ইবনে কুলাহসহ খাচ্ছিলেন। এ সময় হারেস বললেন, আমিরুল মোমেনীন আপনি এটি খাবেন না, আমার সন্দেহ হচ্ছে এতে বিষ মেশানো হয়েছে। এ কথা শুনে খলিফা এ গোশত খাওয়া হতে বিরত থাকেন, কিন্তু সেদিন থেকেই তারা উভয়ই অসুস্থতা বোধ করতে থাকেন। হিজরি ১৩ সালের ৭ জমাদিউসসানি সোমবার তিনি গোসল করেন। এদিন তার ঠাÐা লাগে এবং জ্বর হয় এবং অব্যাহত থাকে। যতক্ষণ সক্ষম ছিলেন, মসজিদে গমন করে নামাজ পড়াতে থাকেন। কিন্তু যখন রোগ তীব্র আকার ধারণ করে হজরত উমর (রা.)-কে ডেকে বললেন : ‘আগামীতে আপনিই নামাজ পড়াবেন।’ কোনো কোনো সাহাবি উপস্থিত হয়ে আরজ করলেন, ‘আপনি অনুমতি দিলে আমরা আপনাকে দেখার জন্য একজন তবীব (চিকিৎসক) ডেকে আনব।’ তিনি বললেন, ‘তবীব আমাকে দেখেছেন’। সাহাবি জিজ্ঞাসা করলেনÑ ‘তবীব কী বলেছেন?’ খলিফা বললেন, ‘ইন্নিফাআআ লুলুললিমা ইউরিদু’। তবীব বলেছেন, ‘আমি যা ইচ্ছা, তা করি’।
হজরত সিদ্দিকে আকবর (রা.)-এর শারীরিক অসুস্থতা যখন বেড়ে যায়, তখন তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতিনিধি মনোনীত করার বিষয়ে চিন্তা করতে থাকেন। তিনি চাইতেন যে, মুসলমানগণ যেভাবে হোক ফেতনা, বিরোধ এবং মোনাফিকি- বিশ্বাসঘাতকতা হতে নিরাপদে থাক। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, সুচিন্তাশীল সুবিবেচক সাহাবায়ে কেরামের এ ব্যাপারে মতামত গ্রহণ করা উচিত এবং তাদের মতামতের ভিত্তিতে তিনি নিজেই কাউকে মনোনয়ন করবেন যাতে কোনো প্রকারের বিরোধের সুযোগ না থাকে। এ পর্যায়ে তিনি সর্বপ্রথম হজরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.)-কে তলব করেন এবং জিজ্ঞাসা করেন, ‘উমর (রা.) সম্পর্কে আপনার কী মত?’ তিনি নিবেদন করলেন : ‘আপনি তার সম্পর্কে যতই উত্তম ধারণা করেন, আমার মতে তিনি তার চেয়েও উত্তম, তবে তিনি অবশ্যই কিছুটা কঠোর।’ হজরত সিদ্দিকে আকবর (রা.) বললেন : ‘তার কঠোরতা এ জন্যই ছিল যে, আমি ছিলাম নরম। যখন তার ওপর দায়িত্ব পড়বে তখন তিনি আপনাআপনিই নরম হয়ে যাবেন।’ হজরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) বিদায় নিয়ে যান। এবার খলিফা সিদ্দিক (রা.) হজরত উসমান (রা.)-কে তলব করেন এবং তার মতামত জানতে চান। হজরত উসমান (রা.) আরজ করলেন : ‘আপনি আমার চেয়ে ভালো জানেন।’ তিনি বললেন, ‘এরপরও আপনার মত কী?’ উসমান (রা.) আরজ করলেন, ‘আমি এটুকু বলতে চাই যে, উমরের ভেতর বাইর থেকে উত্তম এবং তার দৃষ্টান্ত আমাদের মধ্যে আর কেউ নেই।’ অনুরূপভাবে হজরত সাঈদ ইবনে জাঈদ (রা.) এবং ওসাঈদ ইবনে হোজাইর (রা.)-এর মতামত গ্রহণ করেন। হজরত ওসাঈদ (রা.) বললেন, ‘উমরের বাতেন (ভেতর) পবিত্র। তিনি সৎলোকদের বন্ধু এবং মন্দলোকদের দুশমন। ইসলামের খেদমতের জন্য তার চেয়ে শক্তিশালী ও উদ্যোগী আর কাউকে আমি দেখছি না।’
বিশিষ্ট সাহাবাগণের সাথে পরামর্শ শেষ করার পর হজরত সিদ্দিকে আকবর (রা.) হজরত উসমান (রা.)-কে তলব করে বলেন : ‘খেলাফতের অঙ্গীকারনামা লিপিবদ্ধ করুন’। মাত্র কয়েক লাইন লেখা হয়েছিল হঠাৎ খলিফা অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এ অবস্থা দেখে হজরত (রা.) এই বাক্যগুলো নিজের পক্ষ হতে লিখেছেনÑ ‘আমি উমরকে খলিফা নিয়োগ করছি।’ কিছুক্ষণ পর খলিফার জ্ঞান ফিরে আসলে হজরত উসমান (রা.)-কে বলেন, ‘যতটুকু লিখেছেন আমাকে পড়ে শোনান।’ হজরত উসমান (রা.) পুরোটাই পড়ে শোনান। হজরত সিদ্দিকে আকবর (রা.) স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে বলে ওঠেন, আল্লাহু আকবর এবং অতঃপর বলেন : ‘আল্লাহতায়লা আপনাকে উত্তম পুরস্কার দান করুন।’ অছিয়তনামা প্রস্তুত হয়ে যাওয়ার পর হজরত উসমান (রা.) ও একজন আনসারীর মাধ্যমে মসজিদে নববীতে প্রেরণ করেন, যাতে মুসলমানদের শুনিয়ে দেওয়া যায় এবং খলিফা নিজেও ঘরে চলে যান। অত্যন্ত দুর্বলতার কারণে দাঁড়াতে পারছিলেন না, তাই তার কন্যা হজরত আসমা (রা.), তার দুই হাতের সাহায্যে সামলিয়ে রাখেন। ঘরের বাইরে লোকেরা সমবেত হয়েছিল, তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন :
‘তোমরা কি সে ব্যক্তিকে গ্রহণ করবে যাকে আমি তোমাদের খলিফা নিয়োগ করেছি? আল্লাহর শপথ, আমি চিন্তা-ভাবনায় কোনো ত্রæটি করিনি। তাছাড়া আমি নিজের কোনো আপন স্বজনের নাম প্রস্তাব করিনি। আমি উমর ইবনুল খাত্তাব (রা)-কে আমার স্থলাভিষিক্ত নিয়োগ করছি। আমি যা কিছু করেছি তা তোমরা গ্রহণ কর।’
অছিয়তনামার পূর্ণ বিবরণ
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। এটি আবু বকর ইবনে আবু কোহাফার অছিয়তনামা, যা তিনি দুনিয়া ত্যাগ করার শেষ সময়ে এবং আখেরাতের প্রারম্ভে, ঊর্ধ্ব জগতে প্রবেশের সময়ে লিপিবদ্ধ করিয়েছেন। এটি এমন এক সময়ের উপদেশ যখন কাফেরগণ ঈমান আনে এবং বদকার মন্দ লোক সামলিয়ে চলে। এবং মিথ্যাবাদীরা সত্যের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। আমি নিজের পরে ওমর ইবনুল খাতাবকে তোমাদের আমির নিয়োগ করেছি। সুতরাং তোমরা তার নির্দেশ মেনে চলবে এবং তার অনুগত থাকবে। আমি এ ব্যাপারে আল্লাহর রাসূলের ইসলামের এবং খোদ আমার ও তোমাদের খেদমত ও কল্যাণের বিষয় সামনে রেখেছি এবং কোনো প্রকারের ত্রæটি করিনি। উমর যদি ইনসাফ করেন তাহলে তার সম্পর্কে আমার ইলম ও উত্তম ধারণা এটাই। আর তিনি যদি বদলে যান, তাহলে প্রত্যেকেই নিজের কাজের জন্য জবাবদিহি করবে। আমি যা করেছি সৎ উদ্দেশ্যে করেছি। আর অদৃশ্যের খবর একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত আর কারো জানা নেই। যেসব লোক জুলুম-নির্যাতন চালায় তারা অচিরেই তাদের পরিণতি দেখতে পাবে। ওয়াসসালামু ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। অতঃপর হজরত উমর (রা.)কে নির্জনে ডেকে উপযুক্ত উপদেশবলী প্রদান করেন। এরপর আল্লাহর দরবারে হাত উত্তোলন করে দোয়া করেন :
‘হে খোদা! আমি এ নির্বাচন এ জন্যই করেছি যে, মুসলমানদের কল্যাণ হোক। আমার ভয় ছিল যে, হয়তো তারা ফেতনা-ফাসাদ ও মোনাফিকিতে লিপ্ত হয়ে পড়বে। হে মালিক! আমি যা কিছু করেছি তা তুমি ভালোভাবে জানো, আমার চিন্তাভাবনা এ রায় দিয়েছিল এবং এ রায়ে আমি এমন এক ব্যক্তিকে শাসনকর্তা নিয়োগ করেছি, যিনি আমার নিকট সর্বাধিক স্বাধীনচেতা এবং মুসলমানদের সবচেয়ে কল্যাণকামী। হে আল্লাহ! তোমার নির্দেশে আমি এ ক্ষণস্থায়ী জগৎ ত্যাগ করছি। এখন তোমার বান্দাদের তোমার হওলা করছি, তারা সবাই তোমার বান্দা, তাদের লাগাম তোমার হাতে। হে আল্লাহ! মুসলমানদেরকে নেক (সৎ) শাসক দান কর এবং উমরকে খোলাফায়ে রাশেদিনের সারিতে স্থান দান কর এবং তার প্রজাদেরকে যোগ্যতায় ভরপুর করে দাও।’
পূর্বকালের মুসলমানদের ফতোয়া ছিল যে, হজরত সিদ্দিকে আকবর (রা.) কর্তৃক হজরত ওমর (রা.)-কে খলিফা মনোনীত করা ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর জন্য এমন এক মহান অবদান কেয়ামত পর্যন্ত যার দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে না। হজরত উমর (রা.) তার খেলাফতের কয়েক বছরের মধ্যে যা কিছু করেছেন তার সঠিক মূল্যায়ন এই যে, তিনি ইসলামকে একটি শক্তি হিসেবেÑ যা জমিনে বিক্ষিপ্ত পড়েছিল, সেখান থেকে একত্রিত করে সুদৃঢ় ও সুবিন্যস্তভাবে আরশে আজিম পর্যন্ত পৌঁছে দেন বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। হজরত সিদ্দিকে আকবর (রা.)-এর জীবনের শেষ দিন, নায়েবে সেনাপতি মোসান্না ইরাক হতে প্রত্যাবর্তন করেন। সে সময় আমিরুল মোমেনীনের শেষ অবস্থা। খবর শুনে তিনি অজানা বিপদে শংকিত হয়ে পড়েন এবং তৎক্ষণাৎ মোসান্নাকে তলব করেন। তিনি খলিফার এ অন্তিম মুহূর্তে তাকে রণাঙ্গনের পরিস্থিতি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেন এবং জানান যে, কেসরা (ইরানের বাদশাহ) তার নতুন বাহিনী রণাঙ্গনে প্রেরণ করেছে। খলিফা সঙ্গে সঙ্গে হজরত উমর (রা.)-কে তলব করেন এবং বলেন, উমর আমি যা বলছি তা শ্রবণ কর এবং সে অনুযায়ী কাজ কর। আমার ধারণা, আজই আমার জীবনের অবসান ঘটতে যাচ্ছে। যদি দিনে আমার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ হয় তাহলে সন্ধ্যের আগে, আর যদি রাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ হয় তাহলে ভোর হওয়ার পূর্বেই মোসান্নার জন্য সাহায্য প্রেরণ করবে। ওমর! যে কোনো বিপদের কারণে দ্বীন ইসলামের খেদমতে ও আল্লাহর হুকুমের ওপর আমল করা মুলতবি করবে না। হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর ওফাত অপেক্ষা বড় বিপদ আমাদের জন্য আর কী হতে পারে। কিন্তু তুমি দেখেছ সেদিন আমার যা কিছু করণীয় ছিল, আমি তা করেছি। আল্লাহর কসম, আমি যদি সেদিন আল্লাহর হুকুমের তামিল করা হতে অসতর্ক থাকতাম তাহলে আল্লাহতায়ালা আমাদের ওপর ধ্বংসের শাস্তি প্রদান করতেন এবং মদিনার আনাছে-কানাছে ফেতনা-ফ্যাসাদের আগুন জ্বলে উঠত। আল্লাহতায়ালা যদি মুসলমানদেরকে সিরিয়ায় বিজয় দান করেন তাহলে খালেদের সৈন্যদের ইরাকের ফ্রন্টে প্রেরণ করবে। কেননা খালেদ একদিকে যেমন অভিজ্ঞ তেমনি ইরাকের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত।
হজরত সিদ্দিকে আকবর (রা.) ৬৩ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দিনটি ছিল সোমবার, হিজরি তেরো সালের ২২ জমাদিউসসানি, এশা ও মাগরিবের মধ্যবর্তী সময়। তার মোহতারামা স্ত্রী হজরত আসমা বিনতে উমাইস (রা.) গোসল দেন। হজরত আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর (রা.) পবিত্র দেহে পানি ছিটিয়ে এবং হজরত উমর ফারুক (রা.) নামাজে জানাজা পড়ান। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কবর মোবারকের পাশে তাকে দাফন করা হয়। হজরত উমর (রা.), হজরত তালহা (রা.), হজরত উসমান (রা.) এবং আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) লাশ মোবারক কবরে রাখেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
(সমাপ্ত)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন