ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
মো. ওসমান গনি : শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমে একজন মানুষের সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হয়। তাহলে সেই শিক্ষা হতে হবে মানসম্মত শিক্ষা। আর দেশে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার শিক্ষাব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। এ সুযোগে একশ্রেণির লোক দেশের শিক্ষাকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করেছে কিন্ডারগার্টেন (কেজি) নামক স্কুল ওই বাণিজ্যের একটি মাধ্যম। এসব স্কুলের হাতেগোনা ২/৪টি ছাড়া সবার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষার নামে বাণিজ্য করা। এগুলোতে সরকারের কোনো ধরাবাঁধা ও নিয়ন্ত্রণ নেই, যার কারণে সারা দেশের যে যেখানে পারছে ইচ্ছামতো কেজি স্কুলগুলো ছেলেমেয়েদের শিক্ষার নাম করে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছে। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর তারা এ বাণিজ্য করে যাচ্ছে। তাদের বিদ্যালয়ের পরিবেশ, পাঠদান পদ্ধতি ও শিক্ষক নিয়োগ কোনোটিই সরকারের শিক্ষা আইনের মধ্যে নেই। আবার কিছু কিছু কেজি স্কুলকে এলাকায় গ্রহণযোগ্য করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে নিজেদের ২/৪ জন লোক দিয়ে কমিটি করে বিদ্যালয় পরিচালনা করছে। এটাও তাদের শিক্ষা বাণিজ্যের একটা কৌশল মাত্র। এলাকার সহজ সরল লোকদের বোঝানোর জন্য এ কমিটি গঠন করা হয়। তখন কমিটির লোকজনও এলাকার লোকদের উৎসাহ দেয় তাদের ছেলেমেয়েদের ওই স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য। সাধারণ লোকজন কমিটির লোকদের কথায় তাদের ছেলেমেয়েদের সেখানে ভর্তি করায়। শুরু হয়ে যায় টাকার খেলা। তারা তাদের ভিতকে মজবুত করার জন্য কয়েকটি কেজি স্কুল একত্র হয়ে সমিতি বা অ্যাসোসিয়েশন গঠন করে। মাঝে মাঝে এসব অ্যাসোসিয়েশন হতে তাদের সমিতির অন্তর্ভুক্ত স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মাঝে বৃত্তি পরীক্ষার আয়োজন করে কৃতকার্য ছাত্রছাত্রীদের মাঝে নগদ টাকা বিতরণ করে। এটাও তাদের ইনকামের একটা কৌশল মাত্র। দেশের বিবেকবান লোকদের প্রশ্ন হলো, ওইসব স্কুলে যারা শিক্ষকতা করছেন তাদের যোগ্যতা নিয়ে। তারা কী জানে? কী পড়ায়? তাদের নেই কোনো উচ্চশিক্ষা, নেই কোনো শিক্ষকতা করার প্রশিক্ষণ। তাহলে তারা কিসের ওপর ভিত্তি করে ছেলেমেয়েদের পড়ায়? তাদের কাছ থেকে ছেলেমেয়েরা কী শিখবে? ছেলেমেয়েদের মা-বাবারা তাদের সন্তানদের কাছ থেকে কী আশা করতে পারবেন? সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে সারা দেশে দিন দিন এসব স্কুলের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারিভাবে এসব স্কুল নিয়ন্ত্রণের জন্য চেষ্টা করা হলেও মাঠ প্রশাসনের অবহেলার কারণে সারা দেশে অবৈধভাবে পরিচালিত ৭০ হাজার কিন্ডারগার্টেন (কেজি) স্কুলের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এসব প্রতিষ্ঠানের তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে করণীয় নির্ধারণের জন্য কয়েক মাস আগে সারা দেশে ৫৫৯টি টাস্কফোর্স গঠন করে মন্ত্রণালয়। মাঠ প্রশাসনকে ডেকে সাড়া না পেয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবার দ্বারস্থ হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নজরুল ইসলাম খানের মতে, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে গঠিত টাস্কফোর্সের কাছে তথ্য চেয়ে বারবার পত্র দেওয়া হলেও তারা মন্ত্রণালয়ে কোনো তথ্য দেননি। তথ্য না পাওয়ায় কেজি স্কুলের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না। দ্রæত তথ্য পাঠানোর জন্য মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনকে নির্দেশ দিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো পত্রে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী সারা দেশের বেসরকারি প্রাথমিক (বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম) বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন যাচাই ও করণীয় নির্ধারণ করতে গত বছরের ১৬ আগস্ট একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। এক মাসের মধ্যে টাস্কফোর্সকে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ প্রেরণ করতে বলা হয়। ওই পত্রে বলা হয়, বারবার তাগাদা দেওয়া হলেও মন্ত্রণালয়ে কোনো সুপারিশ পাঠানো হয়নি। ১ নভেম্বর ফের বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের তাগিদ দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের তথ্য প্রদানের জন্য নির্দেশনা প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হলো।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, অধিকাংশ কেজি স্কুল বৈধভাবে গড়ে ওঠেনি। সারা দেশে এসব স্কুলের সংখ্যা কত, স্কুলের পাঠ্যক্রম কী, সরকারি বই পড়ানো হয় কিনা, শিক্ষকদের যোগ্যতা, কী প্রক্রিয়ায় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়, তাদের বেতন-ভাতা কত, কোন কোন খাতে অর্থ আদায় করে, স্কুল প্রতিষ্ঠার অর্থের উৎস কী, আয়ের অর্থ কোথায় ব্যয় হয়, ব্যয়ের ক্ষেত্রে সরকারি বিধিবিধান মানে কিনা- এসব প্রশ্নের জবাবসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের পর সুপারিশ মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
সরকার দেশের সমস্ত কেজি স্কুলের তথ্য সংগ্রহের জন্য দেশের ৪৮৭ উপজেলায় একটি, ৬৪ জেলায় একটি এবং ৮ বিভাগে একটি করে মোট ৫৫৯টি টাস্কফোর্স গঠন করে। প্রতিটি টাস্কফোর্সের সদস্য পাঁচজন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে টাস্কফোর্স কমিটি উপজেলার কেজি স্কুল নিয়ে কাজ করবে। জেলা প্রশাসক জেলা শহরের ভেতরের বা উপজেলার বাইরে যা থাকবে। বিভাগীয় কমিশনারদের মহানগর বা মেট্রোপলিটন শহরের স্কুলের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) সূত্র জানায়, কেজি স্কুলগুলো লাগামহীনভাবে চলছে। কোনো কোনো বেসরকারি প্রকাশকদের কাছ থেকে উৎকোচ নিয়ে শিশুর ওপরও বইয়ের অত্যাচার চালানো হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে অনেক শিক্ষক আছেন যাদের ন্যূনতম যোগ্যতা নেই। নেই শিক্ষক হওয়ার প্রশিক্ষণ। অনেক স্কুলের মালিক তার স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে স্কুল পরিচালনা করেন। শিক্ষার মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এসব স্কুল কর্তৃপক্ষ অভিভাবকদের কাছ থেকে মোটা অংকের টিউশন ফি আদায় করছে। তবে শিক্ষকদের নামমাত্র বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। এক কথায় রমরমা শিক্ষা বাণিজ্য চালাচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান। এসব অভিযোগের প্ররিপেক্ষিতে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। এর মাধ্যমে স্কুলগুলোর তথ্য সংগ্রহ করে আইনের আওতায় নিয়ে এসে কথিত স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হবে।
সরকার ১৯৬২ সালের স্কুল নিবন্ধন আইনের আলোকে ২০১১ সালে একটি বিধিমালা করে। কেজি স্কুলগুলো ওই বিধিমালার অধীনে নিবন্ধন করবে। কিন্তু মাত্র ৩০২টি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন করে। অথচ কেজি স্কুলের বিভিন্ন সমিতির তথ্যমতে, সারা দেশে এ ধরনের অন্তত ৭০ হাজার স্কুল আছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লাখ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করলেও এর ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
সরকারের সিদ্ধান্ত দেশে কোনো প্রতিষ্ঠান নিবন্ধনের বাইরে থাকবে না। জাতীয় শিক্ষানীতির নির্দেশনাও তাই। যেহেতু এক দফায় উদ্যোগ নিয়ে সফল হওয়া যায়নি। তাই সরকার এবার টাস্কফোর্সের মাধ্যমে সব তথ্য তুলে এনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশের ছেলেমেয়েদের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যে প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হবে দেশের সরকারের আইনের মাধ্যমে। ছেলেমেয়েরা পাবে সরকারি সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা। স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষিকাদের থাকবে সরকারের কাছে জবাবদিহিতা। বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সঠিকভাবে পাঠদান করানোর জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের বিকল্প নেই। অনেক কেজি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা নিজেরাও শুদ্ধভাবে বাংলা উচ্চারণ করে পড়তে পারে না, ইংরেজি তো দূরের কথা। এসব ভুইফোঁড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার জন্য সরকারের পাশাপাশি দেশের শিক্ষিত ও বিবেকবান মানুষদের এগিয়ে আসতে হবে। তাদের সন্তানদের কাছাকাছি যে কোনো সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করতে হবে মানসম্মত শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ এ শ্লোগানকে মনেপ্রাণে ধারণ করে দেশের সকল অভিভাবককে তাদের সন্তানের সুশিক্ষার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।