Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপেক্ষিত মির্জা গালিব

| প্রকাশের সময় : ২৮ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মুজিবুর রহমান মুজিব : উর্দু-ফার্সি সাহিত্যের কালজয়ী প্রতিভা মির্জা আসাদ উল্লাহ খাঁ গালিব ১৭৯৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর ভারতের বিখ্যাত শহর আগ্রায় জন্মগ্রহণ করলেও তার পূর্ব পুরুষগণ আদিভারতীয় নন। প্রাচীন ভারতবর্ষের ধন-দৌলত, শানশওকত, মান-মর্যাদা এবং ভারতবাসীর মায়া-মমতা ও অফুরান আন্তরিকতায় আকৃষ্ট ও বিমুগ্ধ হয়ে মির্জা গালিবের দাদা কোকান বেগ খান মোগল সম্রাট শাহ আলমের শাসনামলে সমরকন্দ থেকে ভারতে আসেন। মির্জা গালিবের পূর্বপুরুষ ছিলেন পেশাদার যোদ্ধা। মুঘল সেনাবাহিনীতে চাকরি নেন মির্জা গালিবের দাদা কোকান বেগ এবং পিতা মির্জা আব্দুল্লা বেগ খাঁ। পিতা-মাতার প্রথম সন্তান মির্জা গালিবের একজন কনিষ্ঠ ভ্রাতাও ছিলেন, যার নাম মির্জা ইউসুফ খাঁ। মুঘল ভারতে রাজভাষা ছিল ফার্সি। ফার্সি তখন প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় ভাষা।
মির্জা গালিবের গৃহশিক্ষা শুরু হয় ফার্সি ভাষায়। তার গৃহশিক্ষক ছিলেন প্রখ্যাত পন্ডিত আবদুস সামাদ। পন্ডিত আব্দুস সামাদ মেধাবী মির্জা গালিবকে মমতা ও দায়িত্বের সাথে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন। বাল্য-কৈশোরকাল থেকেই মির্জা গালিব পূর্ব পুরুষের পেশা যুদ্ধ-বিগ্রহের চাইতে জ্ঞানার্জন ও কাব্য চর্চায় অধিকতর আগ্রহী ছিলেন। ১৮০৬ সালে মাত্র নয় বছর বয়সে মির্জা গালিব ফার্সিতে শায়েরী লেখা শুরু করে তার কাব্য জীবনের শুভ সূচনা ঘটান। পাড়ি জমান দিল্লি। রাজধানীতে এসে হিন্দুস্তানি আরেকটি বহুল প্রচলিত ভাষা উর্দু ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পঠন-পাঠন জ্ঞানার্জন শুরু করেন মির্জা গালিব।
দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীতে দিল্লি সালতানাত (দাস, খিলজি, তুঘলক, সৈয়দ ও লোদি-এই পাঁচ বংশের আমল) সংস্কৃত, প্রাকৃত ও ফার্সি ভাষার আন্তঃসংমিশ্রণে উর্দু ভাষার জন্ম। গবেষকদের মতে, উর্দু শুরুতে ফৌজি ভাষা হলেও পরবর্তীকালে হিন্দুস্তানি ভাষায় রূপ নেয়। হিন্দুস্তানি ভাষাই আধুনিক উর্দু ভাষা। উর্দু ভাষায় ফার্সি, আরবি ও তুর্কি শব্দের প্রাধান্য আছে। মুঘল ভারতে রাষ্ট্র ভাষা ফার্সি হলেও উর্দু ভারতব্যাপী দ্বিতীয় রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে খ্যাত ও স্বীকৃত ছিল। মির্জা গালিব উর্দু ভাষায় বুৎপত্তি অর্জন করে ফার্সি ভাষার পাশাপাশি উর্দু ভাষায়ও কবিতা ও গদ্য চর্চা করে প্রতিভার ছাপ রাখেন। ১৮৩৭ সালে দিল্লির শেষ মুঘল সম্রাট  আবু জাফর সিরাজুদ্দিন মোহাম্মদ বাহাদুর শাহ্ যখন দিল্লির নাম মাত্র সম্রাট  হিসেবে অভিসিক্ত হন তখন ভারতব্যাপী মুঘল সাম্রাজ্যের সূর্য অস্তাচলগামী। তখন সম্রাট  বাহাদুর শাহ রাজ্য শাসনের পরিবর্তে কাব্য চর্চা ও মোশায়েরা করেই কাল কাটাতেন। মির্জা গালিব তখন নামের আদ্যাংশ আসাদুল্লা পরিত্যাগ করে শুধু মির্জা গালিব নাম ধারণ করেন। ভারত বিজেতা সম্রাট  বাবরের পিতা ওমর শেখও মির্জা পদবিধারী ছিলেন। মির্জা গালিব সম্রাট বাহাদুর শাহের সভাকবি নিযুক্ত হয়ে আরেক সভাকবি জওকসহ কবিতা, গান, শায়েরী, মোশায়েরায় মাতোয়ারা হয়ে মুঘল দরবারকে মাতিয়ে রাখতেন। এ সময় মির্জা গালিব ফার্সি ভাষায় তার প্রথম কবিতার সংকলন তৈরি করেন। ১৮৫০ সালে সম্রাট  বাহাদুর শাহ মির্জা গালিবকে বার্ষিক ছয়শত টাকা বেতনে তৈমুর বংশের ইতিহাস রচনার দায়িত্ব দেন। ১৮৫৪ সালে মির্জা গালিব তার প্রজ্ঞা ও পান্ডিত্য, মেধা ও মনন এবং আনুগত্যের কারণে সম্রাট  বাহাদুর শাহের সভাকবি থেকে বন্ধু এবং বন্ধু থেকে কবিতার ওস্তাদে পরিণত হন। সম্রাট  বাহাদুর শাহও একজন উঁচু দরের কবি ও দার্শনিক ছিলেন। স্বদেশপ্রেম ও স্বাদেশিকতায় উদ্বুদ্ধ ভারত সম্রাট  বাহাদুর শাহ ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ নামে খ্যাত সর্বভারতীয় সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগামের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন। কিছু রাজ কর্মচারী ও রাজন্যবর্গের বিশ্বাসঘাতকতা ও বেইমানির ফলে জীবনের প্রথম ও শেষ যুদ্ধে পরাজয়বরণ করেন সম্রাট  বাহাদুর শাহ জাফর। সিপাহি বিদ্রোহে পরাজয়ের পর কোম্পানি বিচারের নামে প্রহসন করে তাকে রেঙ্গুনে নির্বাসনের রায় দেয়। ভারতপ্রেমিক বাহাদুর শাহ্ মর্মাহত হন। তার শেষ ইচ্ছা ছিল এ দেশেই চিরশায়নে শায়িত হবেন। তার শেষ ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি। নির্বাসনের রায় শুনে কবি বাহাদুর শাহ কাঠখড়ি দিয়ে লাল কেল্লার দেয়ালে লেখেন
“কিত্মা বদনসিব হ্যায় তু জাফর
দাফন কে লিয়ে,
দু’গজ জমিন ভি মিল না ছেকে
সারি হিন্দুস্থান মে।”
প্রবন্ধকে বলা হয়, মৌলিক চিন্তাধারার ফল ও ফসল, কবিতাকে বলা হয় হৃদয়ের রক্তক্ষরণ। মির্জা গালিব উর্দু গদ্য ও কবিতায় নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। গালিবের উর্দু গ্রন্থগুলোর মধ্যে গুল-এ-রানা, দেওয়ান-এ-গালিব, উদ-এ-হিন্দ, উর্দু এ মুআল্লা, মক্কাতিব-এ-গালিব, খুতুন-এ-গালিব, নফাত-এ-গালিব, কাদির নামা উল্লেখযোগ্য। ফরাসি ভাষায় রচিত গালিবের গ্রন্থগুলোর মধ্যে কল্লিয়াত এ নজম-এ-ফরাসি পঞ্জজ আল মেহের-এ-নিম রোজ, দাস্তাম্বু, রাকাত-এ-গালিব, কাতে বুরহান, সরদ এ চীন, দোয়ায়ে সবাহ, ময়খান এ আরজু, মুতফর্কাতে গালিব, মুযাসির এ গালিব উল্লেখযোগ্য।
    মির্জা গালিব এর কাব্য প্রতিভা ছিল জন্মগত। তার পূর্ব পুরুষ ছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের তীর্থস্থান সমরকন্দের অধিবাসী। গালিবের কবিতার মূল বিষয় ছিল প্রেম। স্রষ্টাও মানব প্রেমের জয়গান গেয়েছেন তিনি। ফরাসি ও উর্দু-শের-শায়েরীর সংখ্যা দুই হাজারের বেশি বলেও অনেক গবেষক মনে করেন। তার দেওয়ান এ গালিব প্রকাশিত হয় ১৮৪২ সালে। এতে ১৫০টি কবিতা ও ১০৭০টি শের আছে।
সিপাহি বিদ্রোহের সময় মির্জা গালিব গৃহবন্দী ছিলেন। তার চোখের সম্মুখে বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ ঠিকানা দিল্লির পতন হয়। মর্মাহত হন মানবপ্রেমিক মির্জা গালিব। চাপ ও ভয়ভীতির মাঝেও তিনি কোম্পানির পক্ষাবলম্বন করেননি। পলাশীর যুদ্ধের পর নবাব সিরাজুদ্দৌলার আত্মীয় সৈয়দ গোলাম হোসেন খান তবাতবায়ী-সিয়ার-উল-মুতাখখিরিন- লিখে সিরাজ চরিত্রে মিথ্যা কলংক এনেছেন। কোম্পানিও ইংরেজদের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। মুঘল দরবারের কবি মির্জা গালিব তা করেননি। গালিবীয় জীবন-দর্শন প্রসঙ্গে মোঃ আব্দুল মান্নান তার মির্জা গালিব ও তার রঙিন দুনিয়া নিবন্ধে বলেন, গালিব চিরদিনই প্রেমের কবি ভালোবাসার কবি, আপন অস্তিত্বকে তিনি প্রবল করে তুলেছিলেন রূপ রস সৌন্দর্যের মাঝে।
উর্দু ও ফার্সি সাহিত্যের কালজয়ী প্রতিভা মির্জা গালিব পারিবারিকভাবে মির্জা, বেগ ও খাঁ এই তিন পদবিধারী হলেও আগ্রা থেকে দিল্লিতে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করে সব পদ-পদবী পরিহার করে এমনকি বাহারি নামের বৃহদাংশ আসাদুল্লা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র মির্জা গালিব নামে কাব্য চর্চা করে ফার্সি ও উর্দু সাহিত্যে নিজের আসন পাকাপোক্ত করে নেন। কবি হিসেবে মির্জা গালিব ছিলেন নির্লোভ, নির্মোহ। জাগতিক-লোভলালসা বৈষয়িক প্রাপ্তি যোগের চাইতে তিনি সাহিত্যের ভুবনে নিজেকে বিলিয়ে দেন, উজাড় করে দেন। সভাকবি ও সম্রােটের  বন্ধু হয়েও তিনি আধুনিক জামানার মতো বাণিজ্যায়ন-দুর্বৃত্তায়ন করেননি। সভাকবি হিসেবে সম্রাটের নাম ভাঙিয়ে কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজে আর্থিকভাবে লাভবান কিংবা তৎকালীন প্রথা মোতাবেক জায়গীর-চাননি, পাননি। বরং বেহিসেবী মির্জা গালিব নিদারুণ অর্থকষ্টে ভুগে ঋণের দায়ে মামলা-মোকদ্দমার সম্মুখীন হয়েছেন, কারা যাতনা ভোগ করেছেন। তবুও অসত্যের সাথে আঁতাত-আপস করেননি। কবি ও দার্শনিক মির্জা গালিব যে মহৎ মানসিকতা ও উন্নত নৈতিকতা বোধের পরিচয় দিয়েছেন তা প্রশংসনীয় অনুকরণীয় অনুসরণীয় বটে।
উর্দু-ফার্সি সাহিত্যের দিকপাল, মির্জা গালিব ভারত তো বটেই, নিজ শহর আগ্রাতেও এখন অনালোচিত, বিস্মৃতিপ্রায়। আগ্রার মানুষ ভুলে গেছেন কবি গালিবকে। আগ্রার পৌর কর্তৃপক্ষ গালিবের স্মৃতি রক্ষার্থে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আগ্রার মির্জা গালিব একাডেমির পরিচালক সাঈদ জাফরির মতে, আগ্রায় উর্দু সাহিত্যের বিকাশে গালিবের অবদান থাকলেও দিল্লি-আগ্রায় মির্জা গালিবের সম্মান ও স্মরণে কোনো স্মৃতিসৌধ নেই।
আমাদের এই দেশে কত জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী তো উদযাপন করা হয়। কবি মির্জা গালিবের জন্মবার্ষিকীও পালিত হতে পারে। তার কর্ম ও জীবন দর্শন আলোচনা করলে জাতি হিসেবে আমরা গৌরবান্বিত হব বৈকি।
দিল্লিতে হযরত নিজাম উদ্দিন আওলিয়ার মাজার প্রাঙ্গণে চির শয়ানে শায়িত উর্দু ও ফার্সি সাহিত্যের কালজয়ী প্রতিভা মির্জা আসাদুল্লা খাঁ গালিব। আমরা তাকে স্মরণ করছি এবং তার রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।
লেখক : সেক্রেটারি, মৌলভীবাজার জেলা জামে মসজিদ। সিনিয়র অ্যাডভোকেট, হাইকোর্ট। সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেস ক্লাব। মুক্তিযোদ্ধা। কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন