Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তারাই গ্রামীণ অর্থনীতির চালিকাশক্তি

| প্রকাশের সময় : ২৮ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

শান্তা মারিয়া : ছোটবেলা থেকেই জরিনা বেগমের সেলাইয়ের সুনাম ছিল। দাদীর কাছে সেলাই শিখেছিলেন তিনি। তবে তখনও জানা ছিল না এই সেলাই একদিন তার সংসারের চেহারা পাল্টে দেবে। দিন মজুর বাবার সংসারে আধপেটা খেয়ে অনেক কষ্টে বেড়ে ওঠেন জরিনা। স্কুলে মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর বিয়ে হয়ে যায় পাশের গ্রামের বরগা চাষি সদরুল মিয়ার সঙ্গে। বাবার বাড়ির মতো স্বামীর বাড়িতেও অভাবের মধ্য দিয়েই কাটছিল দিন। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। তবে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেয় একটি সমিতি। এই সমিতি থেকে অল্প কিছু টাকা ঋণ নিয়ে তিনি নকশি কাঁথা সেলাই ও বিক্রির উদ্যোগ নেন। নকশি কাঁথার নকশায় বেডকভার, বালিশের কভার, ছোট ছোট ব্যাগ, টেবিল ক্লথ ইত্যাদি তৈরি করেন তিনি। সমিতির মাধ্যমেই সেগুলো বিক্রির ব্যবস্থা হয়। জরিনা এখন মোটামুটি সচ্ছল। ছেলেমেয়েগুলোকে স্কুলে পড়াচ্ছেন। ছোট বয়সে মেয়েকে বিয়ে দিবেন না তিনি। বরং সেলাই শিখিয়ে তাকেও নিজের ব্যবসায় কাজ দিয়েছেন। ১৮ বছর বয়স হলে তারপর মেয়ের বিয়ে দিবেন। 

জরিনা বেগমের মতো সাহসী ও পরিশ্রম নারীরা ধীরে ধীরে পালটে দিচ্ছেন বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরের সনাতন অভাবের ছবিগুলো। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও এখন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা নারীর দেখা পাওয়া যায়। কাঁথা সেলাই, বিভিন্ন রকম পোশাক, ঘর সাজাবার বিভিন্ন সামগ্রী, মুড়িভাজা, পাতা পিঠাসহ নানা রকম সংরক্ষণযোগ্য পিঠা, পাঁপড়, আচার, মোমবাতি, ফুচকার খোল, খেলনা, ইত্যাদি নানা রকম জিনিস তৈরি করেন অনেক নারী। এরা এইসব সামগ্রী ঘরে তৈরি করে সেগুলো বিক্রি করেন এবং সংসারে সচ্ছলতার সুবাতাস বয়ে আনেন। এরা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে এরা খুঁজছেন ভালোভাবে বাঁচার পথ। এদের সঙ্গে আছেন ছোট মুরগির খামার কিংবা ছাগল পালন, গরু মোটা তাজাকরণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়া নারীরা।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা নারীদের অনেকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর গড়ে দুই লাখ নারী কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে যুক্ত হচ্ছেন। ২০১০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে প্রায় ৬ লাখ নারী বিভিন্ন কাজে যোগ দিয়েছেন। দেশের ২ হাজার ১৭৭টি ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ কারখানার মালিক নারী। প্রতিবছরই এ সংখ্যা বাড়ছে। সে হিসেবে বলা যায় দেশে এখন নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে। বাংলাদেশ সরকারের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের আওতায় সারা দেশে তৃণমূল পর্যায়ে ১৬ হাজারের বেশি রেজিস্ট্রি করা স্বেচ্ছাসেবী মহিলা সমিতি রয়েছে। এসব সমিতির মাধ্যমে নারীরা শিখছেন হাতের কাজ। তৈরি করছেন বøক বাটিকের বেডকভার, চাদর, বিভিন্ন পোশাক, কাঁথা, স্টিচের নানা রকম পোশাক, নকশীকাঁথা, ব্যাগ, কুশন কাভারসহ বিভিন্ন রকম সামগ্রী। তবে সমস্যা দাঁড়ায় এসব সামগ্রী বিপণনের সময়। কারণ গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরা জানেন না কিভাবে বা কোথায় এসব সামগ্রীর উপযুক্ত মূল্য পেতে পারেন। কিভাবে এগুলো শহুরে ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিতে পারেন সেটাও একটা বেশ বড় সমস্যায় পরিণত হয়। সেই সমস্যা নিরসনে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে।
ঢাকায় ধানমন্ডির রাজা প্লাজার চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় স্থাপিত হয় জয়িতা। জয়িতা হলো দুই ফ্লোরব্যাপী বিশাল দোকান কাঠামো বা বিপণন কেন্দ্র। এর মধ্যে রয়েছে সমিতিগুলোর ছোট ছোট স্টল। এসব স্টলে তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা রয়েছে। ‘জয়িতা বিপণন কেন্দ্র’ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা নারীদের আশার প্রতিষ্ঠান। ২০১১ সালের ১৬ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এর উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ক্রেতা-বিক্রেতা দু’দলেরই আস্থা অর্জন করে এগিয়ে যাচ্ছে জয়িতা। বিপণন কেন্দ্রে ১৩৯টি স্টল স্থাপন করা হয়েছে যা ১৮০টি সমিতির মধ্যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ১৩৯টি স্টলের মধ্যে ১০টি দেশীয় খাবার স্টল, ৬টি কৃষিপণ্য ও ১২৩টি হস্ত শিল্পজাত পণ্যের স্টল রয়েছে। ৫ম তলায় বিনোদনের জন্য একটি সাংস্কৃতিক মঞ্চ রয়েছে। যেখানে দেশীয় ও ঋতুভিত্তিক পালা পার্বন এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। ৫ম তলায় শিশুদের জন্য একটি চিলড্রেন কর্ণার রয়েছে। ৫ম তলায় জয়িতার একটি প্রশাসনিক অফিস ও সভাকক্ষ রয়েছে।
বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তাদের অনেক রকম সমস্যা রযেছে। প্রথমত সমাজে নারীর যেকোনো উদ্যোগকে পদে পদে বাধা দেয়া হয়। এবং নারীর স্বাবলম্বনকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য সমাজের কুসংস্কারগুলো সক্রিয় থাকে। নারীকে গৃহবন্দী করে রাখার প্রবণতা থাকে গ্রাম্য সমাজে। অনেক সময় নারীর সম্পত্তি ও অর্জিত টাকা পয়সা কুক্ষিগত করে নিতে চায় তার পুরুষ আত্মীয়রা। অনেক সময় গ্রাম্য সালিশ বৈঠকের মাধ্যমে তার স্বাধীন চলাচলকে রুদ্ধ করার চেষ্টা করে তথাকথিত সমাজপতিরা। আর দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসরত নারীদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণের সমস্যাগুলোতো রয়েছেই। জয়িতার মতো কেন্দ্র দরকার ঢাকা ও অন্যান্য বিভাগীয় শহরের প্রাণকেন্দ্রসহ অনেক জায়গায়। বিশেষ করে শপিংমলগুলোতে এ ধরনের বিপণন কেন্দ্র বেশি সংখ্যায় প্রয়োজন। যেমন ঢাকা শহরে গাউছিয়া মার্কেট বা নিউমার্কেটের মতো জায়গায় যদি জয়িতার শাখা থাকে তাহলে অনেক বেশি ক্রেতা পাওয়া সম্ভব। এই সববিপণন কেন্দ্রের আরও বেশি প্রচার দরকার। উৎপাদিত পণ্যের মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ের করার জন্য উদ্যোক্তাদের ব্যাপক উন্নততর প্রশিক্ষণও প্রয়োজন। ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তারা গ্রামীণ ও শহুরে নিম্ন মধ্যবিত্ত সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোয় বড় পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন। তাদের জন্য সার্বিক সহযোগিতা দরকার সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায় থেকেই। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহযোগিতা পেলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাই হতে পারে গ্রামীণ অর্থনীতির চালিকাশক্তি। ছোট বালুকার কণা এবং বিন্দু বিন্দু জল দিয়েই গড়ে ওঠে বড় মহাদেশ ও মহাসাগর। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাও তাদের ক্ষুদ্র সামর্থ্য দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছেন পরিবারের অভাব দূর করতে ও দেশের অর্থনীতির চাকাকে ঘুরিয়ে দিতে। তাদের এ প্রচেষ্টায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার কর্তব্য আমাদের সকলেরই।
পিআইডি ও নারী ও শিশুউন্নয়ন কার্যাক্রমÑফিচার



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন