Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধানের দর ও সেচ ব্যয় খাদ্য উৎপাদনে প্রধান অন্তরায়

দেশে ১ কোটি ৯১ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যে ৪৭ লক্ষাধিক হেক্টরে বোরো আবাদ

| প্রকাশের সময় : ২৩ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নাছিম উল আলম : চলতি রবি মওসুমে দেশে প্রায় ১ কোটি ৯১ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে ৪৭ লক্ষাধিক হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ সম্পন্ন হয়েছে। ৪৮ লাখ হেক্টরে আবাদ লক্ষ শতভাগ পূরণ না হলেও উৎপাদন লক্ষ্য অর্জনে আশাবাদী কৃষি স¤প্রসারণ অধিদফ্তর-ডিএই’র দায়িত্বশীল মহল। বড় ধরনের কোন প্রকৃতিক দুর্যোগ না ঘটলে উৎপাদন লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে বলে আশাবাদী ডিএই। তবে ইতোমধ্যে দেশের দক্ষিণাঞ্চল সহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলা ছাড়াও মুন্সিগঞ্জে শিলাবৃষ্টিতে বোরো ধানসহ রবি ফসলের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। তবে এবার সময়মত বৃষ্টিপাতের কারণে সেচ সংকট থাকছে না। বিগত খরিপ-২ মওসুমে দেশে ৫৫.৬০ লাখ হেক্টরে আমন আবাদ লক্ষ অতিক্রম করে অতিরিক্ত কুড়ি হাজার হেক্টরে আবাদ সম্পন্ন করেন দেশের কৃষকগণ। যা থেকে প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ টনের মত চাল উৎপাদন হয়েছে বলে আশাবাদী দায়িত্বশীল মহল।
চলতি রবি মওসুমেও হাইব্রীড, উচ্চ ফলনশীল-উফশী ও স্থানীয় জাতের বোরো ধানের আবাদ সম্পন্ন করেছেন কৃষকগণ। এমনকি গত এক যুগে দেশে ধীরে ধীরে হাইব্রীড ধানের আবাদের স¤প্রসারণ ঘটছে। তবে হাইব্রীড ধানের ভাল বীজ সংকট রয়েছে। বীজের কারণে মাঝে মধ্যেই কৃষকগণ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এ ধানের আবাদে কৃষকগণ সব সময়ই আস্থা সংকটে ভোগেন। বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে এখনো স্থানীয়জাতের বোরো ও আমন আবাদের আধিক্য রয়েছে।
বোরোসহ বিভিন্ন ধান উৎপাদনের কারণে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বিশ্বের ৪র্থ ধান উৎপাদনকারী দেশের গৌরব অর্জন করেছে। ইতোমধ্যে দেশে ধানের গড় উৎপাদন ৪.০১ টনে উন্নীত হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-ব্রি। চীন, জাপান ও কোরিয়াতে ধানের গড় ফলন ৫-৬ টনের মত।
দেশের ক্রমবর্ধনশীল জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদার কারণে ধানের ফলন বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই। অর একারণে সনাতন জাতের পরিবর্তে উচ্চ ফলনশীল-উফশী জাতের ধান আবাদ বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই বলে মনে করছেন কৃষিবিদগণ। আর এক্ষেত্রে বোরো ধান ইতোমধ্যে দেশের প্রধান খাদ্য ফসলে পরিণত হয়েছে।
১৯৬৮ সালে ‘আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-ইরি’ থেকে ‘আইআর-৮’ নামের উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ সংগ্রহ করে দেশের মাঠ পর্যায়ে চাষাবাদ শুরু হয়। খাটো আকৃতির এ উফশী ধানের ফলন ছিল হেক্টরপ্রতি ৫-৬ টন। ১৯৭০ সালে ‘বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-ব্রি’ প্রতিষ্ঠার পরে প্রতিষ্ঠানটির বিজ্ঞানীগণ এপর্যন্ত ৭৫টিরও বেশী উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। যার মধ্যে বেশ কয়েকটি হাইব্রীড ধানও রয়েছে। ব্রি উদ্ভাবিত আউশ, আমন ও বোরো ধানের জাতগুলোর মধ্যে লবণ, বন্যা ও খরা সহিষ্ণু ধানের জাতও রয়েছে। ইতোমধ্যে সারা দেশে ব্রি উদ্ভাবিত ধান আবাদের পরিমাণ ৮০ ভাগে উন্নীত হবার পাশাপাশি উৎপাদিত মোট ধানের প্রায় ৯০ ভাগের কাছাকাছি স্থানে পৌঁছেছে।
কিন্তু বাংলাদেশে ধান উৎপাদনে সেচ ব্যয় এখনো দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সর্বাধিক বলে জানিয়েছেন কৃষিবিদগণ। যেখানে বাংলাদেশে ধানের মোট উৎপাদন ব্যয়ের ২৮%ই সেচ ব্যয়, সেখানে থাইল্যান্ডে তা ৮%, ভিয়েতনামে ৬% আর ভারতের মরু প্রবণ পাঞ্জাবে ১৩%-এর বেশী নয়। উপরন্তু গত এক দশকে কয়েক দফায় ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে দেশে সেচ ব্যয় আরো বেড়েছে বলে দাবী মাঠ পর্যায়ের কৃষিবিদদের। অথচ বিদ্যুতায়িত সেচ ব্যবস্থায় ব্যয় কম হবার পরেও ২০০৩ সাল থেকে এখাতে সরকার ২৫% ভর্তুকি প্রদান করছে। অথচ দেশের সিংহভাগ সেচ ব্যবস্থাই এখনো ডিজেল নির্ভর। সর্বপ্রথম ২০০৭-০৮ সালে ডিজেলের ওপর শতাংশ প্রতি নগদ আড়াইশ’ টাকা করে ভর্তুকি প্রদান করা হয়। কিন্তু ২০০৮-০৯সেচ মওসুমে এ কার্যক্রম বন্ধ করে পরবর্তীতে পুনরায় ২০০৯-১০সেচ মওসুমে সেচ কাজে ব্যবহৃত ডিজেলের ওপর ভর্তুকি প্রদান করা হলেও তা অব্যাহত রাখা হয়নি। তবে গতবছর সেচ মওসুম শেষ হবার পরে ডিজেলের দাম লিটার প্রতি ৩ টাকা হ্রাস করা হয়। উপরন্তু এবার ধানের দাম মণপ্রতি ১শ’ দেড়শ’ টাকা বৃদ্ধির কারণে কৃষকগণ বোরো আবাদে কিছুটা আগ্রহী হয়েছে বলে দাবী করছেন ডিএই’র দায়িত্বশীল মহল।
ফলে ইতোমধ্যে প্রায় শতভাগের কাছাকাছি বোরো আবাদ সম্পন্ন হয়েছে বলে সূত্রটির দাবী। এতেকরে দেশে চলতি মওসুমে অন্তত ১কোটি ৯১লাখ টন বোরো চাল পাবার ব্যাপারে আশাবাদী মহলটি।
গাছের অধিক সার গ্রহণ ক্ষমতা আর বেশী উৎপাদনের কারণে উফশী জাতের বোরো ধান খুব দ্রæততম সময়ে দেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এসব ধানের গাছ স্থানীয় জাতের চেয়ে যথেষ্ট মজবুত এবং পাতা খাড়া থাকে। এমনকি শিষের ধান পেকে গেলেও এর মূল গাছ সবুজ থাকে। হালকা ও হালকা-মাঝারী ঝড় বাদলে এধানের গাছের তেমন কোন ক্ষতিও হয় না।
ব্রি’র মতে, ১৯৬৫-৬৬ সালে দেশে মোট ধানের উৎপাদন ছিল ৭০ লাখ টনের মত। যা ৭০ সালে-৭১ সালে প্রায় ১ কোটি টনে উন্নীত হয়। কিন্তু ২০০৮-০৯ সালে দেশে ধানের উৎপাদন ৩ কোটি ৩৪ লাখ টনে উন্নীত হয়। বর্তমানে দেশে গম ও বিভিন্ন জাতের ধানসহ দানাদার খাদ্য উৎপাদন ৪কোটি টানের কাছাকাছি বলে জানা গেছে। যা দেশকে খাদ্যে স্বয়ম্ভরতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে। তবে কৃষক পর্যায়ে ধানের ন্যায্য দর নিশ্চিত করাসহ বিএডিসি থেকে উন্নত বীজের সরবরাহের পাশাপাশি সেচকাজে ডিজেলে ভর্তুকি প্রদান করলে আগামী কয়েক বছরে দেশে দানাদার খাদ্য ফসলের উৎপাদন প্রায় ৫ কোটি টনে উন্নীত করা সম্ভব বলে মনে করছেন মাঠ পর্যায়ের কৃষিবিদগণ।
চলতি মওসুমে বৃহত্তর বরিশাল ও ফরিদপুর অঞ্চলসহ দক্ষিণাঞ্চলের ১১টি জেলায় প্রায় সোয়া ৩ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদের লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। যা থেকে অন্তত ১৪ লাখ টন চাল পাবার আশা করছে ডিএই’র দায়িত্বশীল মহল।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ