Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আস্থা ফেরাতে নিরাপত্তার জোরদার

| প্রকাশের সময় : ২২ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম


সংসদভবন, বিমানবন্দর, কারাগারসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বিশেষ সতর্কতা : পর্যটনখাতে ৭৬ ভাগ বিদেশি কমে গেছে
উমর ফারুক আলহাদী : জঙ্গিবিরোধী অভিযান জোরদার করে কঠোর অবস্থানে রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। রাজধানীর কূটনৈতিক পাড়ায় রয়েছে তিন স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনী। বিমানবন্দর সংসদভবন কারাগার  ইপিজেড, চট্রগ্রাম সমুদ্রবন্দরসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নেয়া হয়েছে নিñিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা।  বিদেশিদের আস্থা ফেরাতে এতসব উদ্যোগ এবং নিরাপত্তা জোরদার। তারপরেও আস্থার সঙ্কট কাটছে না। অনেক বিদেশি নাগরিক আতঙ্কে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। দূতাবাসগুলো বার বার তাদের নাগরিকদের সর্তক থাকার নির্দেশ দিচ্ছে। কয়েকটি দেশ তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশে ভ্রমণের  ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এত দেশের প্রতি বিদেশিদের আস্থার সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। কমে গেছে বিদেশি বিনিয়োগ। শুধু পর্যটন খাতেই গত এক বছরে শতকরা ৭৬ ভাগ বিদেশি পর্যটক কমে গেছে বলে জানিযেছে সংশ্লিষ্টরা। ফলে এখাতে মারাত্মক ধস নামতে শুরু করেছে।
বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এক বক্তব্যে  বলেছেনÑ হলি আটিজানে জঙ্গি হামলার পর আশঙ্কাজনক হারে পর্যটকদের আগমন কমে গেছে। অন্যদিকে সকল বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে জোরদার করা হলেও আতঙ্ক কাটেনি। সরকার জঙ্গিবিরোধী অভিযান জোরদার করে সারা দেশে জঙ্গি দমনের সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত রেখেছে। বিদেশিদের আস্থা ফিরে আনতে গত কয়েকদিন ধরে ঢাকা, চট্রগ্রাম, রাজশাহী সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন নগরীতে বøক রেইড দিয়ে জঙ্গি সন্ত্রাসীদের আটক করা হচ্ছে। তবু জঙ্গি হামলার ভয়ভীতি কিছুতেই কমছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জঙ্গি আস্তানায় র‌্যাব পুলিশের দফায় দফায় সাঁড়াশি অভিযান, রাস্তার মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট বসিয়ে ব্যাপক তল্লাশি, বাসা-বাড়ি, ছাত্রবাস-মেসে মধ্যরাতে হানা, পোষাকধারী র‌্যাব পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোষাকেও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হলেও আতঙ্ক কাটছে না। জঙ্গিবিরোধী অভিযান জোরদার হলেও আস্থা ফেরেনি। বরং বিদেশি দূতাবাসগুলোসহ তাদের দেশের নাগরিকদের বিভিন্ন স্থানে চলাফেরাও সীমিত করেছে । গত কয়েক মাস ধরেই নিজেদের কর্মসূচি ও চলাচল নিয়ে খানিকটা গোপনীয়তা ও সতর্কতা বজায় রাখছে বিদেশি দূতাবাসগুলো। এমনকি বিদেশি মন্ত্রী বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সফরের কথাও আগে ঘোষণা করা হচ্ছে না। পর্যটকদের আগমন কমে গেছে।  নিরাপত্তা নিয়ে পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে না পারায় জাইকার প্রকল্পগুলোতে সীমিত পরিসরে কাজ করে আসছেন জাপানিরা। বিদেশিরা অবস্থান করেন এমন সব হোটেল-রেস্টুরেন্টে কঠোর নিরাপত্তা তল্লাশির নির্দেশ দেয়া হলেও আগের মতো বিদেশিরা আসছেন না। প্রত্যেক হোটেল-রেস্টুরেন্টের প্রবেশপথে  আর্চওয়ে ও লাগেজ স্ক্যানার ও ডাবল গেট ব্যবহার করার পাশাপাশি ক‚টনৈতিক জোনে তিন স্তরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশের কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এসব ব্যবস্থা ছাড়া হোটেল রেস্টুরেন্টগুলো চালু থাকতে পারবে না বলেও কঠোর অবস্থান ঘোষণা করেছে পুলিশ। এসব হোটেল- রস্টুরেন্টে প্রত্যেককে নিরাপত্তা তল্লাশি শেষ করেই ঢুকতে হচ্ছে। এছাড়া গুলশান-বনানী ও বারিধারায় পুলিশের প্যাট্রোল ডিউটি বাড়ানো ও পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। তারপরেও আতঙ্ক-উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাটছেনা। বিদেশিরা এসব নিরাপত্তায় আস্থা রাখতে পারছেন না। ফলে বিদেশিদের আগমন সীমিত হয়ে পড়ছে বলে জানিয়েছে পর্যটন করপোরেশনসহ বিভিন্ন সূত্র।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, পুরো মহানগরী এখন আমাদের নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে। সিসি ক্যামেরায় সবকিছু মনিটরিং করা হচ্ছে। তিনি বলেন, মন্ত্রী পাড়া, কূটনৈতিক পাড়া এগুলো স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। সব সময়ই সেখানে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে। এসব এলাকায় ভিআইপিদের বসবাস। তাই নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, মূলত রাজধানী জুড়েই নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, পুরো রাজধানীতে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলা হয়েছে। প্রায় ১০ হাজার পুলিশ সদস্য সার্বক্ষণিক দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। রাজধানীর মন্ত্রী পাড়ায়, কূটনৈতিক পাড়ায় এবং সংসদ ভবন এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। মন্ত্রী পাড়া হিসেবে পরিচিত রাজধানীর মিন্টো রোডে, বেইলি রোড ও হেয়ার রোড এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় গ্রহণ করা হয়েছে। এসব এলাকা সিসি ক্যামেরায় সন্দেহভাজনদের গতিবিধি মনিটরিং করা হচ্ছে। গুলশানের ঘটনার পর থেকে মিন্টো রোড ও আশপাশের প্রবেশ পথে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও অন্যান্য ভিভিআইপিদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে এ পথে যানবাহন চলাচল একেবারে বন্ধ হয়নি বলে তিনি জানান। গুলশান জোনের একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ বিরতিহীন দায়িত্ব পালন করছে। পুলিশের সব ধরনের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকেও পুলিশ কাজ করছে।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ বলেন, রাজধানীর মোড়ে মোড়ে র‌্যাবের টহল জোরদার করা হয়েছে। আছে গোয়েন্দা টিম। তিনি বলেন, নাশকতা ও জঙ্গি তৎপরতা রোধে আমাদের গোয়েন্দা কার্যক্রম ব্যাপক হারে বাড়ানো হয়েছে। আমরা শুধু রাজধানী নয়, দেশব্যাপীই নিরাপত্তা জোরদার করেছি। র‌্যাবের প্রতিটি সদস্য সার্বক্ষণিক দায়িত্বে নিয়োজিত আছে।  
পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, জঙ্গি হামলা ও নাশকতা রোধে শুধু পোশাকধারী নয়, সাদা পোশাকেও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা কড়া নজরদারিতে রেখেছেন। মন্ত্রী পাড়া ও আশপাশ এলাকায় অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এসব এলাকার বিভিন্ন প্রবেশমুখে ব্যারিকেড বসিয়ে যানবাহনে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। প্রাইভেট কার, সিএনজিচালিত ট্যাক্সিক্যাব ও মোটরসাইকেলসহ অন্যান্য যানবাহনকে ভিন্ন রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। পায়ে হেঁটে যারা এসব রাস্তায় ঢুকছেন তাদেরও তল্লাশি করে তারপর ঢুকতে দেয়া হচ্ছে।
জানা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশে জাইকার বিনিয়োগ প্রায় ১ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা। এসব প্রকল্প দেশের বিভিন্ন স্থানে বাস্তবায়ন হচ্ছে। এসব প্রকল্পে জড়িত রয়েছেন জাপানের প্রকৌশলীসহ বিশাল একটি দল। তাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে জাপানের। কারণ ঢাকায় হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে নিহতদের মধ্যে সাত জন ছিলেন জাপানের নাগরিক। তারা সবাই মেট্রোরেল প্রকল্পে কর্মরত ছিলেন। আবার রংপুরে জঙ্গি আক্রমণে নিহত হোসি কোনিও ছিলেন একজন জাপানি। অবশ্য সেসময়ই জাইকার বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবকদের জাপানে ফিরিয়ে নেয়া হয়। প্রত্যন্ত এলাকা থেকে শহরাঞ্চলে নিয়ে আসা হয় জাপানি নাগরিকদের। জাইকার প্রেসিডেন্ট ঢাকা সফরে আসতে চেয়েও শেষ মুহূর্তে সেই সফর বাতিল করেন। এক প্রকারের স্থবিরতা সৃষ্টি হয় জাইকার প্রকল্পগুলোতে। পরে জাপানিদের নিরাপত্তার জন্য নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনীকে অস্ত্রের অনুমতি দেয়ার আবেদন জানায় জাপান। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এ অনুরোধ রাখা সম্ভব হয়নি। এর পরিবর্তে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত অস্ত্রধারী আনসার নিয়োগ দেয়ার সুযোগ তৈরি করে সরকার।
এদিকে চট্টগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদেশি নাগরিকদের ওপর হামলার শঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। পুলিশের এ বক্তব্য প্রকাশের পর ফের আলোচনায় এসেছে বিদেশিদের নিরাপত্তার বিষয়টি। গুলশান বনানী ও বারিধারায় নতুন করে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। কয়েকটি দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক সংস্থা  নিরাপত্তার বিশেষ সতর্ক বাড়তি সশস্ত্র আনসার নিযুক্ত করার আগ্রহ দেখিয়ে সরকারের কাছে আবেদন করেছে। তাদের উদ্বেগ নিরসনে আজ রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বিশেষ বৈঠকের আয়োজন করেছে সরকার। বৈঠকে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং নিরাপত্তা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা বিদেশিদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কথা শুনবেন এবং সরকারের গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের জানাবেন। সেখানে উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিনিধিরাও।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গত বছর থেকে সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশিদের নিরাপত্তা দেয়ার বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া আছে। কিন্তু কয়েকদিন আগে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকেই বিদেশিদের নিরাপত্তা আরও জোরদারের উদ্যোগ নেয়া হয়। গোয়েন্দা তথ্যের কথা জানানো হয় বিদেশি দূতাবাসের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। কূটনৈতিক জোন এবং বিদেশিরা অবস্থান করেন এমন সব হোটেল ও রেস্টুরেন্ট, বিমানবন্দরের মতো স্থানে নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ দেয়া হয়। দূতাবাসগুলোও নিজেদের মতো করে বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানী ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিসান বেকারি রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলার পর থেকে এথন পর্যন্ত  মার্কেটের দোকান-পাট, রেস্তোরাঁগুলোতে ব্যবসায় ধস নেমেছে। কমে গেছে বিদেশি ক্রেতাদের আগমন। দেশি-বিদেশি অভিজাত শ্রেণির মানুষের আনাগোনায় মুখর গুলশানে উচ্চবিত্ত মানুষের রসনা বিলাসের জন্য গড়ে তোলা ছোটবড় নানা ধরনের রেস্তোরাঁ, চাইনিজ, থাই, স্প্যানিশ, জাপানি ও ইন্ডিয়ান খাবারের রেস্টুরেন্টগুলোতে বিদেশি ক্রেতাদের আনাগোনা নেই আগের মতো। লোক সমাগম হচ্ছে না বললেই চলে, ব্যবসা নেমে এসেছে প্রায় শূন্যের কোঠায়। এমনটি জানালেন একজন হোটেল ব্যবসায়ী। বনানী থেকে গুলশান ২ এর আশেপাশের কাপড়, গয়না, জুতা, ফল ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে দেখা যায় সবাই হতাশ কবে এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে এ নিয়ে। তাদের অনেকের মতে, রিকশা, বাস বন্ধ হওয়া, অতিরিক্ত সিকিউরিটি সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করছে।



 

Show all comments
  • Md.Nur Alam ২২ মার্চ, ২০১৭, ১২:৩৬ এএম says : 0
    লোক না দেখিয়ে এদের মূল উৎপাটন করুন।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ