পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
তালহা আবদুল রাজ্জাক, দি নিউ আরব : ২০ মার্চ নীরবে পার হয়ে গেল। আমাদের অধিকাংশের কাছেই দিনটি ছিল অন্য আর দশটি দিনের মতোই। কোনো বিশেষত্বহীন দিনের মতোই সাধারণ, স্বাভাবিকভাবে দিনটি কেটেছে আমাদের। সবাই যা করেছে তা হচ্ছে সকালে ঘুম থেকে উঠেছে, কিছু নাশতা করেছে। তারপর যে যার কাজে গেছে, শিক্ষার্থীরা গেছে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর কিছু মানুষ বসন্তের প্রথম দিনকে উপভোগ করেছে।
নিকট ইতিহাসের এক বিরাট ও নির্মম পরিহাস যে, নবজীবনের স্পন্দন বয়ে আনা ঋতুর এ দিন এ দিনটিতেই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইরাকের ললাটে সর্বনাশের পেরেক ঠুকে এবং ইরাকিদের জন্য দোজখের দরজা খুলে দেয়। ইরাকিরা তাদের যার স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল সে মুক্তি পায়নি, সন্ত্রাস তাদের জীবনকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে।
গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত হও
মনের কষ্টে যা-ই বলি না কেন, অধিকাংশ ইরাকিই আজ থেকে ১৪ বছর আগে এ দিনটিতে কী ঘটেছিল সে কথা স্মরণ করে। সেদিন যে ধ্বংস ও বিপর্যয়ের সূচনা হয়েছিল আজো তা চলছে, অদূরভবিষ্যতে তা শেষ হবে সে রকম কোনো লক্ষণ নেই।
ইরাকের বিরুদ্ধে সমর সজ্জার মনোযোগ নিবদ্ধ করা হয় ইরাকের প্রতি। এ জন্য অজুহাত হিসেবে ইরাকি স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেন কর্তৃক সম্ভাব্য ও আজগুবি হুমকির কথা বলা হয় যিনি কয়েক দশক ধরে লৌহকঠিন হাতে ইরাক শাসন করছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে ৯-১১-র দুর্ভাগ্যজনক হামলার টাটকা ক্ষত নিয়ে মার্কিন যুদ্ধোন্মাদরা ইরাকিদের রক্তপানের জন্য ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো হয়ে উঠেছিল। তারা খুঁজছিল শুধু একটি অজুহাত।
সাদ্দামের কাল্পনিক গণবিধ্বংসী অস্ত্র (ডবিøউএমডি) নিয়ে বানোয়াট অভিযোগের মধ্যে ইরাকি জনগণের কথা সামান্যই ছিল। তারা ইরাকিদের মাথায় পরবর্তী চিন্তা ঢুকিয়ে দেয় যে, স্বৈরাচারী সাদ্দামের হাত থেকে ইরাককে মুক্ত করার পর মার্কিন রফতানিকৃত গণতন্ত্র পেয়ে ইরাক এক মহান দেশ হয়ে উঠবে।
আধুনিককালের উপনিবেশোত্তর সভ্যতার প্রেসক্রিপশনে বলা হয়, বাথিস্ট স্বৈরশাসনের জোয়াল মুক্ত হওয়ার পর ইরাকিরা নিজেরাই তাদের ভাগ্যের নিয়ন্তা হবে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা পাবে এবং কিভাবে তারা তাদের দেশকে দেখতে চায় সে আকাক্সক্ষা প্রকাশ করতে পারবে।
পরিব্যাপ্ততা সত্তে¡ও গণতন্ত্রের প্রস্তুতি পর্যায় খুঁড়িয়ে চলছিল এবং ইরাকি জনগণের জন্য তা ছিল ভয়ঙ্কর যারা যারা পশ্চিমা গোলাবারুদ দ্বারা সুসভ্য ও মুক্ত হওয়ার আকাক্সক্ষা করছিল বলে মনে হয়।
১৯৯০ সাল থেকে ২০০৩ সালের আগ্রাসন পর্যন্ত সময়কাল ইরাক নির্মম নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়। এ সময় যত লোক মারা যায় তত লোক সাদ্দামের হাতেও মারা যায়নি। সাদ্দামের কুয়েত আগ্রাসনের শাস্তি হিসেবে এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, যা ছিল বাথিস্টদের বিপর্যয়কর, আত্মম্ভরি সিদ্ধান্ত। কিন্তু তার জন্য ইরাকি জনগণের দুর্দশায় নিপতিত করা কোনো যুক্তি হতে পারে না।
ইরাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সময় থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত এর শিকার হয়ে ৫ লাখ ইরাকি শিশু মারা যায়। আসলে এ নিষেধাজ্ঞার শিকার হয় ইরাক, বাথিস্টরা নয়।
তখনকার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাডেলিন অলব্রাইট এক টিভি সাক্ষাৎকারে তখন বলেছিলেন, ৫ লাখ নিষ্পাপ ইরাকি শিশুকে মাশুল দিতে হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
গণতন্ত্র নয়, শুধু মৃত্যু
নিষেধাজ্ঞার কারণে ১৯৯৫ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত আরো লাখ লাখ শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় মার্কিন নেতৃত্বে ইরাকে গণতন্ত্র আনয়নের ‘সুসভ্যকরণ মিশন’কে শুধু এক সর্বনাশ বলেই আখ্যায়িত করা যেতে পারে। ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল লানসেট প্রকাশিত এক জরিপে দেখা যায় যে, ইরাক আগ্রাসনের সরাসরি ফল হিসেবে শুধু ২০০৬ সালেই ৬ লাখ ৫৪ হাজার ৯৬৫ জন নিহত হয়।
যদি ধরে নেয়াও হয় যে, ইরাক আগ্রাসনের প্রথম দিকের বছরগুলোতে কোনো লোক মারা যায়নি তাহলেও এক দশক আগে ৫ লাখ ইরাকি শিশুর মৃত্যুসহ নিহত ইরাকিদের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১২ লাখ।
অবশ্যই নিহত ইরাকিদের সংখ্যা অনেক বেশি, বিশেষ করে আমরা যদি ল্যানসেটের জরিপের কথা হিসাবে নেই। ল্যানসেট সামারায় এক শিয়া মাজার আলকায়েদার বোমা হামলার পর গোষ্ঠীগত রক্তপাত শুরু হওয়ার কথা জানায়।
নেহাত সাধাসিধে লোকই শুধু বিশ্বাস করবে যে, আমেরিকানরা গণতান্ত্রিক পরিবর্তন ঘটাতে শুধু আদর্শিক লক্ষ্যেই ইরাকে আগ্রাসন চালিয়েছিল। অথবা তাদের লক্ষ্য ছিল শুধুই তেল। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ‘ডুবিয়া’ (বুশের ছোটবেলার একটি ডাক নাম) বুশ ছিলেন দুর্বল মেধার লোক যাকে আন্তর্জাতিকভাবে এখন নির্বোধের সমপর্যায়ে গণ্য করা হয়, মনে হয় আমেরিকার পেশি যে কত বড় বিশ্বকে সেটাই দেখাতে চেয়েছিলেন।
ইরাককে ধ্বংস করে তিনি সম্ভবত এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, আবার ৯/১১-র মতো কোনো ঘটনা রোধ করতে তিনি সক্ষম। এ হামলা বা যুক্তরাষ্ট্রের ভূখÐে কোনো সন্ত্রাসী হামলার সাথে বাথিস্টদের কোনো সম্পর্ক না থাকা সত্তে¡ও বুশের টার্গেট হয় ইরাক।
তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিশ্বযুদ্ধে’র লেন্সের ভেতর দিয়ে তাকালে দেখা যায় ইরাকে আগ্রাসন ছিল আরেকটি চরম ব্যর্থতা। একটি মার্কিনপন্থী, পশ্চিমাপন্থী দেশ হওয়ার বদলে ইরাক দ্রæত সন্ত্রাসের আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। ইরাক শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে উগ্রপন্থী গ্রæপগুলোর স্বর্গে পরিণত হয়েছে, একই সাথে তা শিয়া ইরানের কৌশলগত পশ্চাৎভূমি।
যে ইরাকে সাদ্দামের আমলে তার ভীতিকর মুখবারাত গোয়েন্দা সংস্থার কারণে আগে আলকায়েদা ছিল অনাকাক্সিক্ষত এবং তাদের খুঁজে বের করে নির্মূল করা হতো, সেই ইরাকেই তার সন্ত্রাসী সেল স্থাপন করে এবং প্রাধান্য বিস্তার করে, যা নয়া ইরাকি কর্র্তৃপক্ষ নির্মূল করতে দুর্বলতা ও দুর্নীতির পরিচয় দেয়।
সুন্নি আরব হস্তক্ষেপ ও মার্কিন দখলদারদের সাথে তাদের জোটবদ্ধতা আলকায়েদা ইন ইরাককে বিপর্যয়ের শিকার করে। কিন্তু বর্তমান ইরানপন্থী বাগদাদ কর্তৃপক্ষের বেপরোয়া গোষ্ঠীবাদের কারণে সুন্নিদের রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়া অব্যাহত রয়েছে। তারা সুন্নি হওয়ার কারণে লক্ষ্যবস্তু ও হত্যা এবং নির্যাতন ও লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছে।
এটা এমন মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ইরাকে পার্লামেন্টারি গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিদের শিয়া প্রাধান্যের মধ্যে সুন্নি সম্প্রদায়ের কণ্ঠ হারিয়ে যাচ্ছে। তাই পার্লামেন্টের ভোটাভুটিতে সময় নষ্ট না করে ২০১২ সালে দেশব্যাপী গণবিক্ষোভ প্রদর্শন করতে রাস্তায় নেমে আসেন। তাদের এ বিক্ষোভ শুধু শিয়াপ্রধান সরকারের বিরুদ্ধেই ছিল না, সুন্নি রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ ছিল।
এই নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের বিরুদ্ধে বাগদাদ সরকারের জবাব ছিল নির্মম। নিন্দিত সাবেক শিয়া প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান সরকারে ভাইস প্রেসিডেন্ট নূরী আল-মালিকির নির্দেশে হাবিজায় বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালিয়ে অনেককে হত্যা করা হয়। এ সময় সৈন্যরা গোষ্ঠীগত ¯েøাগান দেয়।
এসব নৃশংসতা ও পরবর্তীতে সুন্নিদের গণহত্যা আলকায়েদার ধ্বংসাবশেষ এবং কিছু ক্ষুব্ধ বাথপন্থী নেতাদের সমন্বয়ে তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের (আইএস) উত্থান ঘটায়। ২০১৪ সালে তারা দৃশ্যমান হয়। তারা স্বল্প সময়ে ব্যাপক সাফল্য লাভ করে। বর্তমানে ইরাকে আইএসের শেষ ঘাঁটি মসুল চূড়ান্ত পতনের মুখে।
সরকারি পদক্ষেপের প্রেক্ষিতে সুন্নিদের রক্ষক হওয়ার দাবি করতে পারত যদিও তাদের উচ্চাকাক্সক্ষা ছিল কুটিল ও অশুভ।
কথা হচ্ছে, আইএসের পরাজয় ঘটলেই কি ইরাকের সমস্যার সমাধান হবে? না, তা হবে না। কারণ আইএস হচ্ছে এক মহামারীর নাম, যার সৃষ্টি হয়েছে জাতীয় ঐক্য, পরিচিতি ও অভিন্ন স্বার্থের অভাবে।
এসব সমস্যা সমাধান না হলে ও আঞ্চলিক হস্তক্ষেপকারীদের দমন করা না গেলে অদূরভবিষ্যতে আরো ঘটনা ঘটতে পারে।
নিবন্ধকার এক্সিটার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্র্যাটেজি ও সিকিউরিটি ইনস্টিটিউটের গবেষক ও ২০১৫ সালের আলজাজিরা তরুণ গবেষক পুরস্কার বিজয়ী।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।