Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রস্তুতি ছিল বড় নাশকতার!

| প্রকাশের সময় : ১৭ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : সীতাকুন্ডের দু’টি জঙ্গি আস্তানা ‘নব্য জেএমবি’র। বড় ধরনের নাশকতাই ছিল তাদের লক্ষ্য। বিদেশিদের উপর হামলা অথবা মহাসড়কে বড় অঘটনের প্রস্তুতি ছিল তাদের। এর মাধ্যমে আবারও বিশ্বব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। তবে ত্বরিত হস্তক্ষেপে বড় ধরনের নাশকতা থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে বলে মন্তব্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের।
দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের খুব কাছে সীতাকুন্ড শহরের প্রেমতলা এলাকার ‘ছায়ানীড়ে’ গতকাল অভিযানকালে ৫ জন নিহত হয়।
অভিযানে নেতৃত্বদানকারী কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তাদের ধারণা নিহতদের মধ্যে ২জন বোমা ও বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ। অভিযানের একপর্যায়ে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা। আর এর মধ্যদিয়ে টানা ২০ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর এক সাঁড়াশি অভিযানের সমাপ্তি হয়। জঙ্গি আস্তানা থেকে পাওয়া যায় বিপুল সংখ্যক বোমা ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম।
এর আগে গত ৭ মার্চ কুমিল্লায় দুই জঙ্গিকে আটক করার পর তাদের একজনকে নিয়ে ওই রাতেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের অদূরে মিরসরাইয়ের একটি বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় ২৯টি হাতবোমা, ৯টি চাপাতি, ২৮০ প্যাকেট বিয়ারিংয়ের বল এবং ৪০টি বিস্ফোরক জেল।
সম্প্রতি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় জঙ্গি তৎপরতার কথা শোনা গেলেও চট্টগ্রাম অঞ্চলে তাদের কোন তৎপরতা ছিল না। তবে হঠাৎ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের আশপাশে জঙ্গি আস্তানা আবিষ্কার হওয়ার ঘটনায় নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সর্বশেষ দেশের বাণিজ্যিক রাজধানীখ্যাত বন্দরনগরী চট্টগ্রামের নিকটবর্তী সীতাকুন্ড শহরে ভয়ঙ্কর জঙ্গি আস্তানার সন্ধান মেলে। আর সেখানে আত্মঘাতী বিস্ফোরণের মতো ঘটনাও ঘটে।
এরা কারা, এদের উদ্দেশ্য বা কি এমন প্রশ্ন এখন এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। এমন এক প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, এরা নব্য জেএমবির সদস্য। এসব জঙ্গির লক্ষ্য ছিল বিদেশিদের ওপর হামলা করে বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের আশপাশে বড় বড় উন্নয়ন কাজ চলছে। সেখানে অনেক বিদেশি নাগরিক কাজ করছেন। হয়তো তাদের টার্গেট করেই এখানে গ্রেনেড ও বিস্ফোরক মজুদ করা হয়েছিল। ডিআইজি বলেন, আমরা নিশ্চিত এরা নিষিদ্ধ ঘোষিত উগ্র সংগঠন ‘নব্য জেএমবি’। এখানকার দুটিই নব্য জেএমবির আস্তানা।
পৌর এলাকার ৫ নম্বর প্রেমতলা ওয়ার্ডে ‘ছায়ানীড়’ নামের ওই দ্বিতল ভবন বুধবার বিকাল থেকে ঘিরে রেখেছিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। শুরুতে জঙ্গিদের তরফ থেকে কয়েক দফা গ্রেনেড হামলা এবং রাতভর গোলাগুলির পর গতকাল সকালে শুরু হয় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট ও সোয়াটের ‘অপারেশন অ্যাসল্ট সিক্সটিন’ সোয়াট সদস্যরা পাশের একটি বাড়ি থেকে ছাদ হয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলে জঙ্গিরা সেখানে বড় ধরনের আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটায় বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান।     
ডিআইজি শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আমরা প্রথমে চারটি লাশ পেয়েছি। তাদের দু’জনের শরীরে ছিল সুইসাইড ভেস্ট। বিস্ফোরণে তাদের মৃত্যু হয়েছে। দেহগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। দু’জন মারা গেছে পুলিশের গুলিতে।  
দুই তলা ছায়ানীড়ের চারটি ইউনিটের একটিতে আস্তানা গেড়েছিল জঙ্গিরা। বাকি তিন ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সারা রাত আতঙ্কের মধ্যে ভেতরে আটকে থাকতে হয়। সকালে নারী-শিশুসহ ২০ জনকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায় পুলিশ।
ডিআইজি শফিকুল ইসলাম বলেন, সাধারণ নাগরিকদের বের করে আনার জন্য গত রাতে আমরা কয়েকবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। সকালে তারা আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটানোর পর আবার চেষ্টা শুরু করি। পরে জানালার গ্রিল কেটে বিভিন্ন ঘরের বাসিন্দাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসি।
এদিকে জঙ্গি আস্তানায় নিহত অন্তত ২জন নব্য জেএমবির বোমা ও বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ রয়েছে বলে ধারণা কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এডিসি কাজী সানোয়ার আহমেদের। তিনি বলেন, ছায়ানীড় ভবনের এই জঙ্গি আস্তানায় বোমা বানাতে দক্ষ দু’জন বোমারু আছে বলে আমাদের কাছে তথ্য ছিল। সোয়াত টিমের সদস্যরা যখন পাশের আরেকটি ভবনের ছাদে উঠে ছায়ানীড় ভবনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে তখন জঙ্গিরা সোয়াত টিমকে লক্ষ্য করে ৩ থেকে ৪ কেজি ওজনের একটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। আত্মঘাতী জঙ্গিদের আত্মহননের ক্ষেত্রে এত শক্তিশালী বোমার ব্যবহার অতীতে বাংলাদেশে ঘটেনি।
তিনি বলেন, ওই আস্তানায় যেসব সরঞ্জাম পাওয়া গেছে সেগুলো দিয়ে ৪০ থেকে ৫০ কেজি বোমা বানানো যেত। সেখান থেকে বোমা তৈরির এক্সক্লুসিভ সব সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি কার্টনে এসিড, লিকুইড কেমিক্যাল ও ১২ সেট জেল এক্সক্লুসিভ পাওয়া গেছে।
তিনি বলেন, জঙ্গিদের টার্গেট ছিল বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্যের প্রাণহানি ঘটানো। এজন্য আত্মহত্যার আগে তারা আস্তানার প্রবেশপথে, বিভিন্ন কক্ষে পাইপবোমা ও হ্যান্ডমেড গ্রেনেড ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখে। তাই আস্তানার প্রবেশপথেই বড় আকারের একটি বোমা পাই আমরা। এটি নিষ্ক্রিয় করা হয়। ফ্ল্যাটের বাম পাশের তোষকের ওপর আরও একটি বোমা ছিল, যা নিষ্ক্রিয় করা হয়। ছায়ানীড় ভবনের সিঁড়িতে যে নারী জঙ্গির লাশ পাওয়া যায় তার শরীরে অবিস্ফোরিত একটি গ্রেনেড ও সুইসাইডাল বেস্ট বাঁধা ছিল।
চট্টগ্রামে এর আগে বিগত ২০০৫ সালের ২৯ নভেম্বর চট্টগ্রাম আদালত ভবনের প্রবেশপথে পুলিশ চেকপোস্টে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মোজাহেদীন বাংলাদেশ-জেএমবি। ওই হামলায় আত্মঘাতী জেএমবি জঙ্গি হোসেন আলী ওরফে হোসেন মাহমুদসহ ৩জন মারা যায়। অপর ২জন হলেন, পুলিশ কনস্টেবল রাজিব বড়–য়া ও সীতাকুন্ডের সাবেক ফুটবলার শাহাবুদ্দিন। তখন নগরীর কাট্টলী এলাকায় জেএমবির একটি আস্তানার সন্ধান পায় র‌্যাব। আর সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ বোমা ও বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছিল।
গত বছর নগরীর কাট্টলী এলাকা থেকে জেএমবির আরও একটি আস্তানা আবিষ্কার করে র‌্যাব। সেখান থেকে ২জনকে গ্রেফতারও করা হয়। ২০০৫ সালের পর জেএমবির তৎপরতা শুরু হলে সীতাকুন্ড এবং মিরসরাই এলাকায় তাদের কোন আস্তানা পাওয়া যায়নি। তবে বাংলা ভাইসহ জেএমবির শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতিতে সীতাকুন্ডের পাহাড়ে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল বলে তখন জবানবন্দিতে জানায় কয়েকজন জঙ্গি।
এদিকে মহানগরীর নিকটবর্তী এলাকায় জঙ্গি আস্তানা আবিষ্কার এবং অভিযান ও আত্মঘাতী হামলায় ৪ জঙ্গি নিহত হওয়ার ঘটনায় বন্দরনগরী চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে পুলিশ। নগর বিশেষ শাখার সহকারী কমিশনার কাজিমুর রশিদ জানান, জঙ্গি প্রতিরোধে মহানগর পুলিশ সক্রিয় রয়েছে। তবে সীতাকুন্ডের ঘটনার পর সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থান নেয়া হয়েছে। নগরজুড়ে চেকপোস্ট বসিয়ে আকস্মিক তল্লাশি অভিযান ও বøক রেইড শুরু হয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ