Inqilab Logo

সোমবার, ০১ জুলাই ২০২৪, ১৭ আষাঢ় ১৪৩১, ২৪ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

পশুর মনুষ্যত্ব : উল্টো পথে মানুষ

| প্রকাশের সময় : ১৭ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সৈয়দ শামীম শিরাজী
মানুষের শ্রেষ্ঠ কাজ মানবসেবা। এ সেবা কোনো ইবাদতের চেয়ে কম নয়। মানুষকে পরম করুণাময় বিবেক, বুদ্ধি, বিবেচনার জ্ঞান দান করেছেন। এটা কোনো পশুর মধ্যে নেই। পশুর কোনো ইবাদত নেই। নেই তার বেহেস্ত কিংবা দোজখ। এক কথায়, পশুর কোনো আমল নেই। কোনো বন্দেগীও নেই। অথচ কখনো কখনো তার বিবেক, বিবেচনাবোধ, দায়িত্ববোধ, কৃতজ্ঞতাবোধ অকল্পনীয় বলে প্রতিভাত হয়। আর বিবেক-বুদ্ধি, বিবেচনাবোধ সম্বলিত মানুষ চলছে উল্টো পথে। হাঁটছে বিপরীত দিকে। তাই তো আজ শান্তি আর বিবেকের ‘মা’-কে খুঁজে পাওয়া দায় হয়ে পড়েছে। পশুর মনুষ্যত্ব আজ অনেক মানুষের জন্য পরম শিক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত ৩ ফেব্রæয়ারি আজব দুনিয়ায় প্রকাশিত ডাস্টবিনে পড়ে থাকা তিন দিনের শিশুকে ‘বাঁচাল কুকুর’ শীর্ষক সংবাদটি অত্যন্ত রোমাঞ্চকর ও হৃদয়বিদারক। একটি ক্ষুধার্ত কুকুর পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য খাবারের সন্ধানে ডাস্টবিনের চারদিকে ঘোরাঘুরি করছিল। খাবারের খোঁজ করতে করতে হঠাৎ সে খুঁজে পায় তিন দিন বয়সের এক নবজাত শিশুর দেহ। জন্মের পরে তার নাভিটিও কাটা ছিল না। ঘটনাটি ঘটে বুড়িমারী বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকায়।
বিস্ময়কর বিষয় হলো, প্রচÐ ক্ষুধার্ত কুকুরটি নরম তুলতুলে শিশুর দেহটি দেখতে পেয়েই তড়িঘড়ি করে মুখে তুলে নেয় এবং বুঝতে পারে শিশুটির দেহে প্রাণ আছে, তার শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে। অতঃপর কুকুরটি শিশুটিকে নিয়ে একটি বাড়ির দরজার সামনে রাখে। সেই সাথে ঘেউ ঘেউ করে জানান দেয় : কে কোথায় আছ দেখ, আমি মানব সন্তানকে ডাস্টবিন থেকে তুলে এনেছি, যার ‘মা’-এর বুক এতটুকু বিচলিত হয়নি তারই গর্ভজাত জীবন্ত শিশুকে ছুড়ে ফেলে দিতে।
কুকুরের ঘেউ ঘেউ চিৎকার শুনেই ওই বাড়ির মালিক দরজা খুলতেই দেখতে পায় একটি সদ্যজাত নিষ্পাপ শিশু পড়ে রয়েছে। আর বাড়ির মালিককে দেখেই কুকুরটি দায়মুক্ত হয়ে ফের ছুটে যায় তার খাবারের খোঁজে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এই যে, কুকুরটি নিজে চরম ক্ষুধার্ত হয়েও শিশুটির দেহে একটি দাঁতের কামড়ও বসায়নি। ফলে মৃতপ্রায় শিশুটি বেঁচে যায়।
আরেকটি ঘটনা। ঘটনাটির সঠিক সন তারিখ মনে নেই। বাড়ির গৃহকর্ত্রীর সঙ্গে গৃহকর্তার পোষা বিড়াল নিয়ে বিরোধ চলছিল। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ঘটনাটি ফলাও করে প্রকাশ করা হয়। এ পোষা বিড়াল নিয়ে সংসার ভাঙার উপক্রম হয়। গৃহকর্ত্রীর শেষ কথা : হয় বিড়াল বাড়িতে থাকবে, না হয় আমি থাকব। চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে পরের দিন।
আগের দিন রাতের ঘটনা। গৃহকর্তার ছিল হার্টের অসুখ। হঠাৎ রাতে তিনি অসুস্থ হয়ে বিছানা থেকে মাটিতে পড়ে যান। অনেক চেষ্টা করে তিনি ওষুধটি টেবিল থেকে নিতে পারছেন না। এমন দৃশ্য দেখে বিড়ালটি গৃহকর্ত্রীকে ডাকতে যায়। তিনি তাকে মারপিট করেন। তারপরেও বার বার তার কাছে যায় এবং মার খায়। এরপরেও বিড়ালটি থেমে থাকেনি। একপর্যায়ে গৃহকর্ত্রীর কাপড়ের আঁচল ধরে ঘরের ভেতর টেনে আনে। তিনি দেখতে পান তার স্বামী মাটিতে পড়ে টেবিল থেকে ওষুধ হাতে নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। এ দৃশ্য দেখে তিনি দ্রæত ছুটে গিয়ে তাকে ওষুধ খাওয়ানোর পর গৃহকর্তা বেঁচে যান। বিড়ালটির এমন মনুষ্যত্ববোধ দেখে খুশি হন গৃহকর্ত্রী। অবশেষে বিড়ালটির চিরস্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ ঘটে।
কুকুরের এমন উদাহরণ আমরা হরহামেশাই পাই যে, আঁস্তাকুড়ে পরিত্যক্ত সদ্যজাত সন্তানের রাতভর পাহারায় ছিল মাংস খাওয়া কুকুরের দল। সকাল হতেই তারা ঘেউ ঘেউ করে ডেকে লোক জড়ো করে তাদের হাতে শিশু-সন্তানকে তুলে দিয়ে নিজেদের কর্তব্য থেকে ছুটি নেয়। নিজের চিন্তা-চেতনা, বিবেক-বুদ্ধি নিয়ে গভীরভাবে ভাবি, মহান স্রষ্টা পশুকুলের কোনো হিসাব-নিকাশ নেবেন না। তাদের যেমন কোনো বন্দেগী নেই তেমনি নেই। কোনো দোজখ কিংবা বেহেস্ত। অথচ তারা কতটা প্রভুভক্ত। তারা কথা শোনে, আদেশও মানে। অথচ নিজেদের সন্তানেরা কথা শোনে না, মান্য করে না। গরু-ছাগলদের কেউ বলেনি, এটা তোর গোয়ালঘর। হাঁস-মুরগিকে বলা হয়নি, এটা তোদের খোঁয়াড়। সন্ধ্যা হলেই তারা নিজ নিজ ঘরে চলে যায়। আর মানব সন্তানকে বার বার নিষেধ করা সত্তে¡ও চুরি, ডাকাতি কিংবা বলাৎকারের জন্য অন্যের ঘরে প্রবেশ করে। অভিভাবকের কথা সন্তানরা না শুনলেও পশুরা শুনে থাকে।
আমাদের ভাবতে হচ্ছে মানুষের অমানবিক মুখগুলো দেখে। উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার সিরাজগঞ্জ বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমাংশের বিশ্বরোডে গত ১ ফেব্রæয়ারি বুধবার সকালে সাইকেলে চড়ে কাজে যাচ্ছিল যুবক। পথে একটি সরকারি গাড়ি তাকে চাপা দেয় এবং সে রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে। পথচারীরা তাকে দেখেও না দেখার ভান করে। ঘটনাস্থলের কাছেই ছিল হাসপাতাল। লোকজন দেখছে, ভিড় জমাচ্ছে কিন্তু কোনো মানবিক মুখ চোখে পড়ল না। তাকে বাঁচানোর জন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে কেউ এগিয়ে এলো না। কয়েকজন মোবাইল ক্যামেরায় যন্ত্রণাকাতর যুবকটার ছবি তুলতে ব্যস্ত। প্রাণের চেয়ে ছবির মূল্য কি বেশি?
এক সময়ে বিদেশি এক প্রখ্যাত ফটোগ্রাফার একজন মানুষকে পেটে চাকু মারছে, এমন এক ছবি তুলে পুরস্কৃত হলেন, বাহবা পেলেন। কিন্তু কয়েক দিন পর আবার তার সেই পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়া হলো। বিখ্যাত ফটোগ্রাফার জানতে চাইলেন, তার অপরাধ কি? জুড়িবোর্ড জানালেন, তুমি চাকু মেরে মানুষকে হত্যা করার ছবি তুলে ভালো কাজ করেছো সন্দেহ নেই। কিন্তু এ ছবি তোলা বাদ রেখে তাকে বাঁচানোর জন্য ছুরিটা যদি ধরে ফেলতে তবে তার জীবনরক্ষা পেত। এখানে ছবির চেয়ে জীবন রক্ষাটা বড় বিষয় ছিল। তুমি সেটা না করায় তোমার পুরস্কার কেড়ে নেয়া হয়েছে। এমন ঘটনা হামেশাই ঘটছে। পথে দুর্ঘটনাস্থলে মানুষ রাস্তায় পড়ে থাকছে। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। তাদের সাহায্যের ক্ষেত্রে মানবতার মুখ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। বিখ্যাত শিল্পী ভুপেন হাজারিকার সেই মানবদরদী গানের কথাই মনে পড়ছে : মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য... একটুখানি সহানুভ‚তি মানুষ কি পেতে পারে না...। অথচ একটু সহানুভ‚তিও মানুষ পাচ্ছে না। দুঃখটা এখানেই।
এক্ষেত্রে সদ্যজাত শিশুকে আহারে পরিণত না করে তাকে বাঁচানোর প্রাণপণ চেষ্টা মানুষকে শিক্ষা দেয় বৈকি। এখানে প্রশ্ন জাগে, পশুদের কোথা থেকে আসে মানুষের চেয়েও মহৎ এই প্রবৃত্তি। শিশুকে তারা তো মহানন্দে ছিঁড়ে খেতে পারত। কেন পারল না? এর উত্তর বিজ্ঞানের কি জানা আছে? হয়তো জানা নেই।  সন্তানের প্রতি মায়ের অপার স্নেহ। সন্তানের জন্য মায়ের ব্যাকুলতা-আকুলতা কারো অজানা নেই। অথচ কোনো কোনো মা কোলের ফুটফুটে শিশুকে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে নিশ্চিন্ত মনে চলে যায়। আর কুকুর তাকে রক্ষা করে। মায়ের বুক এতটুকুও বিচলিত নয় তারই গর্ভজাত জীবন্ত শিশুকে ছুড়ে ফেলে দিতে। ডাস্টবিন থেকে তুলে একটা মানবজ্ঞানহীন কুকুর তিন দিনের অবুঝ শিশুকে যখন বাঁচায় তখন মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেক, মনুষ্যত্ববোধ নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। মানুষের মানবিক মূল্যবোধ এখন যেন তলানিতে ঠেকেছে। কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে বিবেকসম্পন্ন মানুষ। মূল্যবোধ পুনরুদ্ধার তো মানুষকেই করতে হবে। কীভাবে? মহাপুরুষদের প্রদর্শিত পথই এক্ষেত্রে পথ দেখাতে পারে। ভালো হতে নাকি পয়সা লাগে না। সুতরাং সবাই ভালো হোন, ঠিক কাজটি করুন। আশরাফুল মাখলুকাতের সম্মান-মর্যাদা রক্ষা করুন।
লেখক : কবি, সাংবাদিক, কণ্ঠশিল্পী



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন