Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আইনের ফাঁদে রোগী

‘অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন-১৯৯৯’ সংশোধনের দাবি

| প্রকাশের সময় : ১৬ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

‘আইনের জন্য মানুষ না মানুষের জন্য আইন’ প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রে ‘কিডনি দাতা নির্ধারণ করে দেয়ায়’ দেশের কিডনি রোগীদের চিকিৎসা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বর্তমানে দেশে দুই কোটি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। এই রোগেই প্রতি ঘণ্টায় ৫ জন এবং প্রতিদিন মারা যাচ্ছে ১২০ জন মানুষ। প্রতি বছর প্রাণ হারাচ্ছে ৪৩ হাজার ২শ’ মানুষ। যাদের অর্থ আছে তারা বিদেশে গিয়ে লাখ লাখ এবং কোটি টাকা খরচ করে কিডনি প্রতিস্থাপন করেন। আর যাদের অর্থ সীমিত তারা দেশে ডায়ালাইসিস করে বেঁচে থাকার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। কিডনি রোগ নিয়ে বিপন্ন জীবন-যাপন করছেন দেশের লাখ লাখ মানুষ। অথচ আইনের কিছু সংশোধন করা হলেই দেশের এসব কিডনি রোগী সহজেই চিকিৎসা সেবা পেতে পারেন।


হাসান সোহেল : কিডনি মানুষের শরীরের অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় শুধু অর্থাভাবে এ চিকিৎসা নিতে পারছে না কোটি মানুষ। তাছাড়া আইনি জটিলতার কারণে দেশের গরিব তো বটেই মধ্যবিত্ত মানুষের পক্ষেও চিকিৎসা নেয়া সম্ভব হয় না। যারা চিকিৎসা নেয়া শুরু করেন মাঝপথেই তাদের অনেককেই প্রাণ হারাতে হয়। অথচ আইনের কিছু সংশোধন করা হলে দেশে কিডনি চিকিৎসা অনেক সহজতর হতে পাওে বলে মত দেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিমত ‘অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ১৯৯৯’ কিছু সংশোধন করলেই কিডনি রোগের চিকিৎসা ব্যয় মধ্যবিত্তের সক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা সম্ভব। এতে সাধারণ মানুষের দেশেই চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। গণস্বাস্থ্যের প্রধান ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ১৯৯৯’ সংশোধন সময়ের দাবি। বিএসএমএমইউ’র প্রফেসরবৃন্দ এবং দেশের প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপনকারী বিশেষজ্ঞ প্রফেসর এম এ ওয়াহাব, গোলাম কিবরিয়া, এ এ সালাম, এস এ খান, রফিকুল আলম এই আইনের সংশোধনের মাধ্যমে কিডনি রোগীদের জীবন বাঁচানোর আহŸান জানান। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. সাইদুর রহমান বলেন, সরকার অবৈধভাবে অন্যের কিডনি ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বেচাকেনা বন্ধে আইন প্রণয়ন করে। এখন সময়ের প্রেক্ষাপটে সে আইন সংশোধনের দরকার। বিশিষ্ট কিডনি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. হারুন অর রশীদ বলেন, কিডনি রোগের চিকিৎসা এতোই ব্যয়বহুল দেশের শতকরা ৫ শতাংশ মানুষ এ রোগের চিকিৎসা নিতে পারে না। আইনের অভাবে মৃত ব্যক্তির দেহ থেকে কিডনি নেয়া যায় না। এ জন্য যাদের টাকা আছে সে রোগীরা বিদেশে গিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন করে আসে। কিডনি রোগ গবেষক ডা. সালাউদ্দিন মাহমুদ বলেন, কিডনি চিকিৎসার জন্য প্রতিবেশী দেশ ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরসহ বেশ কয়েকটি দেশে প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা চলে যাচ্ছে। অথচ আইনের সংশোধন করলে এ অর্থ দেশেই থাকবে; মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও কম টাকায় চিকিৎসা সেবা পাবে।
‘অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ১৯৯৯’-এ বলা হয়েছে, রোগীদের কিডনিদাতা হিসেবে শুধুমাত্র বাবা, মা, ভাই, বোন, ছেলে, মেয়ে, চাচা, ফুপু, মামা, খালা, স্বামী ও স্ত্রীকে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এই ১২টি সম্পর্কের বাইরে রোগীরা অন্যের কাছ থেকে কিডনি নিতে পারবেন না অসুস্থ ব্যক্তি। তবে কিডনি বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এই আইন সংশোধন করে দাদা, দাদি, নানা, নানি, নাতি, নাতনি ও কাজিন ভাই-বোনদের ‘ডোনার পুল’ বা দাতা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। আবার পরিচ্ছন্ন স্বচ্ছ আইনের মাধ্যমে অন্যের কাছ থেকে কিডনি ক্রয় করে প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে। আবার মৃতদের কিডনি সংরক্ষণ করেও তা রোগীদের শরীরে প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে। অথচ শুধু আইনের কারণে প্রতি ঘণ্টায় দেশে ৫ জন করে কিডনি রোগী প্রাণ হারাচ্ছেন।
সূত্র মতে, আইনি জটিলতা এবং ছোট পরিবার প্রথা গড়ে ওঠায় বিপাকে কিডনি বিকল রোগীরা। রক্ত-সম্পর্কিত নিকটাত্মীয় ছাড়া কিডনি দান করতে না পারায় দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন (ট্রান্সপ্লান্ট) হচ্ছে না বললেই চলে। যাও হচ্ছে তা খুবই সামান্য। অথচ বিদেশে গিয়ে এ চিকিৎসা করতে নানা দুর্ভোগ এবং মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। একই সঙ্গে ডায়ালাইসিস এবং ওষুধের অতিরিক্ত দাম আর্থিকভাবে অসামর্থ্য নিম্ন ও মধ্যবিত্তের বিপুলসংখ্যক রোগী প্রতিদিনই বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে দুই কোটিরও অধিক মানুষ কোনো না কোনোভাবে কিডনি রোগে আক্রান্ত।
প্রতি ঘণ্টায় কিডনিজনিত জটিলতায় ৫ জনের মৃত্যু হচ্ছে। প্রায় ৪০ হাজার রোগীর কিডনি স্থায়ীভাবে অকার্যকর। এর মধ্যে মাত্র ১০ থেকে ১৫ ভাগ রোগী কিডনি প্রতিস্থাপনের আওতায় আসছেন। বাকি ৮৫ থেকে ৯০ ভাগই প্রতিস্থাপনের বাইরে থেকে যাচ্ছে।  
এদিকে দেশে দাতার অভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন করাতে না পেরে প্রতি বছরই বিদেশে চলে যাচ্ছে রোগী। বিদেশে ৫০ লাখ থেকে দুই কোটির মতো টাকা খরচ করে কিডনি প্রতিস্থাপন করাতে হচ্ছে। আবার কয়েক মাস পরপর চেকআপ ব্যয়ও আছে। এতে শত শত কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। অথচ দাতা পেলে বাংলাদেশেই এ চিকিৎসা করা সম্ভব বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা। কিডনি রোগ গবেষক ডা. সালাউদ্দিন মাহমুদ বলেন, কিডনি চিকিৎসার জন্য প্রতিবেশী দেশ ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরসহ বেশ কয়েকটি দেশে প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা চলে যাচ্ছে। অথচ সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করলে এ অর্থ দেশেই থাকবে। এর পাশাপাশি বিদেশ থেকেও কিডনি রোগীরা বাংলাদেশে চিকিৎসা নিতে আসবে বলে উল্লেখ করেন এই গবেষক।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী বলেন, জনগণের কল্যাণে মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন। অথচ আইনি সীমাবদ্ধতায় সে সুবিধা জনগণই ভোগ করতে পারছে না। তিনি বলেন, আইনটি অসম্পূর্ণ এবং পরিধি সীমিত বলে বৃহত্তর রোগগ্রস্ত জনগোষ্ঠী সৃষ্ট আইনের মূল উদ্দেশ্য ও সুফল থেকে বঞ্চিত এবং ব্যাপকসংখ্যক রোগী প্রয়োজনীয় ট্রান্সপ্লান্ট সুবিধা থেকে বঞ্চিত। একই সঙ্গে অধিকাংশ কিডনি রোগী চিকিৎসার মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় বহনে অক্ষম বলে উল্লেখ করেন তিনি।
জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী বলেন, অসম্পূর্ণ আইনের সুযোগ নিয়ে কিছু দালাল শ্রেণির লোক সহজে গ্রামের সহজ-সরল মানুষকে প্রতারণা করে ভিন্ন দেশে নিয়ে গিয়ে অঙ্গ বেচাকেনা করে। রোগাগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষুদ্র একটি অংশ ২৫ লাখ থেকে এক কোটি টাকা খরচ করে বিভিন্ন দেশে গিয়ে অঙ্গ প্রতিস্থাপন করছে। যুগের প্রয়োজনে ও জাতীয় স্বার্থে অবিলম্বে এই আইনের সংশোধন প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন। একই সঙ্গে এটি এখন সময়ের দাবি। সাধারণ মানুষকে প্রতারণা থেকে রক্ষা করা এবং বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে অতিরিক্ত স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত আইনটির কিছু সংশোধনী আনার কথা বলেন এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
ভুক্তভোগী রোগীরা জানান, কিডনি ডায়ালাইসিস ব্যয়বহুল এবং আইনি সীমাবদ্ধতা ট্রান্সপ্লান্ট সহজলভ্য নয়। আবার মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আইন ১৯৯৯ অনুযায়ী রক্ত-সম্পর্কিত নিকটাত্মীয় ছাড়া অন্য কোনো জীবিত ব্যক্তি দান করতে পারে না। তাই প্রতিস্থাপনের অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুকে আলীঙ্গন করছেন অসহায় রোগীরা। দেশে প্রতিস্থাপনের হার তাই খুবই সীমিত। অপরদিকে বিদেশে প্রতিস্থাপন করাতে গিয়ে রোগীর দুর্ভোগ ও মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের মুখে পড়ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কিডনি বিভাগের চেয়ারম্যান ও ডিন প্রফেসর ডা. মো. শহীদুল ইসলাম সেলিম বলেন, বিকল কিডনি রোগীদের চিকিৎসায় দেশের ৮/১০টি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়। বিএসএমএমইউতে সপ্তাহে ১টি কিডনি প্রতিস্থাপন হচ্ছে। এমনকি দেশে প্রতি মাসে মাত্র ১০ থেকে ১২টির বেশি কিডনি প্রতিস্থাপনের মূল কারণ মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন ১৯৯৯ আইনের সংকীর্ণ পরিধি। সময়ের চাহিদা মেনে ২০১২ সালে এ আইন সংশোধনের কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু অজানা কারণে তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। তিনি মনে করেনÑ এই আইন সংশোধন হলে প্রতি মাসে দেশের মেডিক্যাল কলেজ ও বিশেষায়িত হাসপাতালে কয়েকশ’ রোগীকে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। খরচও দুই লাখ টাকার বেশি হবে না।
বিশিষ্ট কিডনি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. হারুন অর রশীদ বলেন, কিডনি রোগের চিকিৎসা এতোই ব্যয়বহুল যে, দেশের শতকরা ৫ শতাংশ মানুষ এ রোগের চিকিৎসা নিতে পারে না। কিডনি সচল ও সুস্থ রাখতে অধিক পানি পান ও ব্যায়াম করার উপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। তিনি বলেন, বাংলাদেশে আইনের অভাবে মৃত ব্যক্তির দেহ থেকে কিডনি নেয়া যায় না। এ কারণে কিডনি নিয়ে ব্যবসা হয়ে থাকে এবং পাশের দেশে গিয়ে অনেকেই কিডনি প্রতিস্থাপন করে আসে। এতে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বাইরে চলে যাচ্ছে। কিডনি সুস্থ রাখতে বেশি করে পানি পান করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। একই সঙ্গে ফাস্ট ফুড এবং কোমল পানীয় পরিহারের আহŸানও জানান। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে কিডনি চিকিৎসায় ৪৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়। এটি আমাদের দেশের বাজেটের প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি। কিডনি রোগে কেবল আক্রান্ত মানুষটি নয় চিকিৎসা করতে গিয়ে পুরো পরিবারটিই ধ্বংস হয়ে যায়। এ রোগ প্রতিরোধে কায়িক পরিশ্রম ও নিয়মিত ব্যায়াম করা, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়েবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা, সুপ্ত উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করা, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ ও ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, ধূমপান থেকে বিরত থাকা, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ সেবন না করা এবং নিয়মিত কিডনির কার্যকারিতা পরীক্ষার পরামর্শ দেন তিনি।
কিডনি রোগ নিয়ে কাজ করা সেভ লাইফ ফাউন্ডেশন এন্ড গিফ্ট লাইফ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. সহেলী আহমেদ সুইটি বলেন, দেশে দুই কোটিরও বেশি লোক কোনো না কোনোভাবে কিডনি রোগে ভুগছে। আমাদের শিশু-কিশোরদের মধ্যে এই রোগ আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। তিনি এ ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ানোর পাশপাশি আইনের সংশোধনে গুরুত্বারোপ করেন।
কেস স্টাডি- ১
মাত্র ১১ বছর বয়সেই ১৯৯৩ সালে দুটি কিডনি বিকল হয়ে যায় মেহেরীন মান্নানের (৩৫)। এরপর থেকে দীর্ঘ ২৪ বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ডায়ালাইসিস করাচ্ছেন। দীর্ঘদিনেও দাতা না পাওয়ায় ডায়ালাইসিস করেই চলছেন তিনি। এমনকি বিদেশ গিয়ে ট্রান্সপ্ল্যান্ট করাবেন সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয় মিটানোও পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়। এমনিতেই প্রতি সপ্তাহে ৩/৪ দিন ডায়ালাইসিস করাতে হয়। যার চিকিৎসা ব্যয় মিটাতে গিয়ে পরিবারে স্থবিরতা নেমে এসেছে। বাবা আব্দুল মান্নান একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। বর্তমানে তিনিও অবসরে। মেহেরীন জানান, ট্রান্সপ্ল্যান্ট করাতে না পারায় আস্তে আস্তে তার শরীরে বিভিন্ন রোগ তৈরি হচ্ছে। তার চিকিৎসা ব্যয় মিটাতে গিয়ে পরিবারের অন্যরাও রোগী হয়ে যাচ্ছেন। অসুস্থতার মধ্যেই মেহেরীন সাফল্যের সাথে এসএসসি, এইচএসসি এবং ওপেন ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ শেষ করেছেন। মেহেরীন বলেন, আইনের কারণে দীর্ঘদিন থেকে তিনি দাতা পাচ্ছেন না। তাই তিনি মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন ১৯৯৯ আইনের সংশোধনের দাবি জানান। যাতে করে সহজেই দাতা মিলে এবং তারমত অন্য কিডনি বিকল রোগীদের কষ্ট পেতে না হয়।
কেস স্টাডি-২
মেহেরুন্নেসা মুবাশ্বির। রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ শিক্ষার্থী। বয়স ২৫-এর কোঠা অতিক্রম করতে এখনো ঢের বাকি। পিতৃহারা মেহেরুন্নেসা ৫ বোনের মধ্যে তৃতীয়। যে বয়সে তারুণ্যের উচ্ছলতায় বর্ণিল প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ানোর কথা, সেই বয়সেই কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় শয্যাগত মেহেরুন্নেসা। চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার দুটি কিডনি বিকল হয়ে পড়েছে। বেঁচে থাকার জন্য সপ্তাহে ৪ বার ডায়ালাইসিস করতে হচ্ছে। কিন্তু তার পরিবারের পক্ষে এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালানো এক প্রকার অসম্ভব। চিকিৎসকরা তাই কিডনি প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু সেখানেই যত প্রতিবন্ধকতা আর অসহায়ত্ব। ইনকিলাবের কাছে অশ্রæসজল চোখে এসব কথা জানান তিনি।
মেহেরুন্নেসা জানান, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কিডনি বিকল হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর চিকিৎসকের কাছে যান। তারা প্রত্যেকেই কিডনি প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেন। প্রতিস্থাপনের পূর্বপর্যন্ত ডায়ালাইসিস চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। যেখানে প্রতি ডায়ালাইসিসে ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা প্রয়োজন সেখানে মাত্র দেড় থেকে দুই লাখ টাকার মধ্যে দেশেই কিডনি প্রতিস্থাপন সম্ভব। তাই ডায়ালাইসিস ব্যয়বহুল হওয়ায় তিনি প্রতিস্থাপনের চেষ্টা শুরু করেন। ৫ বোনের মধ্যে একজনের সঙ্গে রক্তের গ্রæপে মিল থাকলেও বয়সে ছোট হওয়ায় তার কিডনি নেয়া যাচ্ছে না। এই অবস্থায় আপন খালাতো বোন কিডনি দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু চিকিৎসকরা খালাতো বোনের কিডনি নিতে অস্বীকৃতি জানান। এক্ষেত্রে চিকিৎসকরা তাকে দেশে প্রতিস্থাপন না করে বিদেশে যেতে পরামর্শ দেন। পার্শ্ববর্তী দেশে খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেনÑ কিডনি প্রতিস্থাপনে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা প্রয়োজন। এই টাকা যোগাড় করা তার বা তার পরিবারের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। আর চিন্তায় একপ্রকার কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অসুস্থ থেকে অসুস্থতর হয়ে পড়ছেন মেহেরুন্নেসা। তার দু’চোখের গহŸরে এখন শুধুই শূন্যতা।  
সূত্র মতে, ঠিক এরকম একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে মানব দেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন ও প্রতিস্থাপনের দুটি ধারা (আইন) কেন বে-আইনি ও অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। শুনানিতে আইনজীবী ইউনুস আলী আকন্দ বলেন, মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ১৯৯৯ এর ২(খ) ও (গ)তে বলা আছে রক্ত সম্পর্কীয় পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, ভাই, বোন ও আপন চাচা, ফুফু, খালা এবং স্বামী-স্ত্রীকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করতে পারবে। কিন্তু এ্যাপোলো হাসপাতালে বর্তমানে (তৎকালীন) চিকিৎসাধীন মো. বাবুলকে তার মামাত ভাই এমএ রশিদ কিডনি দান করতে চাইলে হাসপাতাল থেকে সেটি গ্রহণ করতে রাজি হয়নি। কিডনি প্রতিস্থাপন করতে চাইলে আদালতের আদেশ নিয়ে আসতে বলা হয়। তখন এমএ রশিদ হাইকোর্টে (ওই আইনটি চ্যালেঞ্জ করে) এ সংক্রান্ত একটি রিট আবেদন করেন। আইনি জটিলতায় কিডনি রোগীরা প্রতিনিয়ত এভাবে ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছেন। অন্যথায় ভিটে-বাড়ি বিক্রি করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে চিকিৎসা করাচ্ছেন।
মেহেরুন্নেছার মতো একই সমস্যায় পড়েছেন নাইম এবং তোহা নামে অপর দুই শিক্ষার্থী। দাতা থাকলেও আইনি জটিলতার কারণে কিডনি প্রতিস্থাপন করাতে পারছেন না তারা। অপরদিকে সাব্বির ও শাহেদ (ছদ্ম নাম) দুই যমজ ভাই। দুই ভাইয়েরই কিডনি বিকল। বিধবা মায়ের চোখের মণি দুই ভাই ডায়ালাইসিস চিকিৎসার মাধ্যমে কোনোমতে বেঁচে আছে। অথচ কিডনি সংযোজনের মাধ্যমে দুই ভাই নতুন জীবন ফিরে পেতে পারে। নিকটাত্মীয় কেউই এগিয়ে আসছে না। এমনকি আইনের কারণে অন্য দাতাকেও পাচ্ছে না। তাই দিনে দিনে মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ছেন তারা।
প্রফেসর ডা. মো. শহীদুল ইসলাম সেলিম বলেন, আমাদের দেশে অন্যান্য দেশের তুলনায় কিডনি সফলভাবে প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। যদিও প্রতিস্থাপনের হার খুবই কম। স্বল্পসংখ্যক কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রধান অন্তরায় হিসেবে তিনি বলেন, নিকট আত্মীয় কিডনি দাতার স্বল্পতা। তাই কিডনি দানের ক্ষেত্রে রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়র বিষয়টি আইনের মাধ্যমে শিথিল করতে হবে। কোনও ব্যক্তি স্বেচ্ছায় তার কোনও আত্মীয়কে কিডনি দিতে চাইলে প্রশাসনের মাধ্যমে সম্পর্কটা খতিয়ে দেখে তার কিডনি নেয়া যেতেই পারে। একই সঙ্গে দাতার স্বল্পতা কাটিয়ে উঠতে বর্তমান আইনে থাকা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের প্রথম ডিগ্রির মধ্যে সীমিত না থেকে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ডিগ্রির সম্পর্ককে গুরুত্ব দিতে হবে। এতে দেশে ডোনার পুল বেড়ে যাবে, বাড়বে সুস্থ মানুষের সংখ্যাও। একই সঙ্গে কিডনি প্রতিস্থাপনে রোগীদের দেশের বাইরে যাওয়ার প্রবণতাও কমে যাবে। এছাড়া তিনি আইনে মৃত ব্যক্তির কিডনি প্রতিস্থাপনের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।
শহীদুল ইসলাম সেলিম বলেন, একজন রোগীর ছয় মাসের ডায়ালাইসিসের জন্য যে খরচ, তা দিয়ে একটি কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। আর কিডনি প্রতিস্থাপন করলে রোগী শারীরিকভাবে অনেক বেশি সুস্থ-সবল থাকবেন। তাকে ডায়ালাইসিসের মতো নিত্যদিনের ভোগান্তি পোহাতে হবে না। তার কোয়ালিটি অব লাইফই বদলে যাবে।
কিডনি বিভাগের চেয়ারম্যান বলেন, কিডনি দাতার সবকিছু পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে নিরাপদ জেনেই তার একটি কিডনি নেয়া হয়। একটি কিডনি নিয়েই স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবন-যাপন করা যায়। তাই একজন জীবিত সুস্থ কিডনি দাতা তার একটি কিডনি দান করেও নিজে সুস্থ থাকেন এবং কিডনি বিকল একজন রোগী তার একটি কিডনি সাফল্যজনকভাবে সংযোজন করে নিয়ে পুনরায় সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন। পরিসংখ্যান উল্লেখ করে তিনি বলেন, কিডনি দান করার দরুন স্বাস্থ্যের উপর কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় না বা জীবনের আয়ুও কমে না। অন্যদিকে কিডনি দাতার মানবিক গুণাবলির বহিঃপ্রকাশ ঘটে, সম্পর্ক গভীর হয় ও আত্মীয়-স্বজনের নিকট মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
জানা গেছে, দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হওয়ার পর একটি দালাল চক্র তৈরি হয়। যারা মিথ্যে বলে অশিক্ষিত, দরিদ্র মানুষদের ভুলিয়ে কখনোবা জোর করে কিডনি নিয়ে বিক্রি করতো। একপর্যায়ে কিডনি বেচাকেনা বাণিজ্যে পরিণত হয়। এই পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করলে সরকার এই আইন প্রণয়ন করে। তবে আইনি বাধ্যবাধকতায় দাতা না পাওয়ায় দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন অস্বাভাবিক হারে হ্রাস পেয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা। তারা সঙ্কটাপণ্য বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবন বাঁচাতে এই আইনের কিছুটা সংশধোনের দাবি জানান। এমনকি অবস্থার উত্তরণে উন্নত দেশের মতো মৃত ব্যক্তির শরীর থেকে কিডনি সংগ্রহের আইন চালু করার কথা বলেন চিকিৎসকরা।
সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কিডনি প্রতিস্থাপনবিষয়ক এক সংবাদ সম্মেলনে দেশের প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপনকারী বিশেষজ্ঞ প্রফেসর এম এ ওয়াহাব, গোলাম কিবরিয়া, এ এ সালাম, এস এ খান, রফিকুল আলম এ আইনের সংশোধনের মাধ্যমে কিডনি রোগীদের জীবন বাঁচানোর আহŸান জানান।   
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. সাইদুর রহমান বলেন, সরকার অবৈধভাবে অন্যের কিডনি ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বেচাকেনা বন্ধে জনসাধারণের স্বার্থে আইন প্রণয়ন করেছিল। তবে সময়ের প্রেক্ষাপটে সেটা সংশোধনের দরকার হতেই পারে, সরকারও চায় স্বচ্ছতার মাধ্যমে সেটা হোক।



 

Show all comments
  • Babul hossain ১৬ মার্চ, ২০১৭, ১০:০৬ এএম says : 0
    Humble request to our govt. Pls correction for law & save our kidNY Damage patient..... Good News & Innovative Idea for Daily Inqilab.....
    Total Reply(0) Reply
  • Moni ১৬ মার্চ, ২০১৭, ১১:১৩ এএম says : 0
    Pls change law & save our kidney patient....
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোগী


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ