Inqilab Logo

বুধবার, ২৬ জুন ২০২৪, ১২ আষাঢ় ১৪৩১, ১৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

ভারতের নৌসজ্জার সমস্যা

| প্রকাশের সময় : ১৬ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

লাইভমিন্ট : মিগ-২৯কের শোচনীয় ব্যর্থতা ও তেজস পরিত্যক্ত হওয়ার পর অ্যারো ইন্ডিয়া ২০১৭-এর মনোযোগের বেশিরভাগই এখন নৌবাহিনীর জঙ্গি বিমানের প্রয়োজনীয়তার দিকে নিবদ্ধ।
ভারতের সংগ্রহ বাজেটের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে অদূরভবিষ্যৎ, সে কথা মনে রেখে ভারতের মতো মাঝারি নৌশক্তির জন্য বিমানবাহী জাহাজের সামগ্রিক যৌক্তিকতা আর্থিক বিচক্ষণতার স্বার্থে পুনঃপরীক্ষা করা প্রয়োজন। ভারতের নৌবাহিনী এমন হওয়া উচিত, যা চাকচিক্যের মারাত্মক বিভ্রমে পর্যবসিত না হয়ে আসলেই ভারতের স্বার্থ রক্ষা করবে। বিপুল ব্যয় সাপেক্ষতার কারণে নৌবাহিনী গড়ে তোলা প্রায়ই শত্রæর বদলে নৌশক্তির অধিকারীর জন্যই বিপর্যয়কর হয়ে দাঁড়ায়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, বিপুল বিনিয়োগে অ্যাডমিরাল টারপিটজের জার্মান নৌবাহিনী গড়ে তোলা প্রথম মহাযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের কারণ হয়েছিল। এতে কোনো আর্থিক সুফল আসেনি। অনুরূপভাবে অ্যাডমিরাল গোরোশকভ কর্তৃক সোভিয়েত নৌবাহিনীর সম্প্রসারণ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল।
টারপিটজ ও গোরোশকভ উভয়েই কুশলী অসামান্য প্রতিভা হলেও তারা কৌশলগত বিপর্যয় ডেকে আনেন। এর কারণ তাদের অর্থনৈতিক অজ্ঞতা, অর্থনৈতিক প্রচেষ্টার সামরিক নীতিবাক্য উপেক্ষা করা যেখানে প্রতিটা কাজ প্রতিপক্ষের নিকট থেকে অপরিমেয় ব্যয় নিংড়ে আনে। শঙ্কার বিষয় যে, আইএনএস বিক্রমাদিত্য এক সময় দুর্ভাগ্য জড়িত নাম বহনকরত: অ্যাডমিরাল গোরোশকভ।
নৌবাহিনী বিমানবাহী জাহাজের প্রতি উন্মত্ততার জন্য তিনটি কারণ প্রদর্শন করে। প্রথমত, চীনের নৌ সজ্জা ও ভারত মহাসাগরকে তাদের লক্ষ্যবস্তু করা; দ্বিতীয়ত, উপকূল অঞ্চলে প্রাধান্য বিস্তার ও শক্তি প্রদর্শন; তৃতীয়ত, সমুদ্রপথে নৌচলাচল পথের সুরক্ষা (এসএলওসি) এবং অনুসিদ্ধান্ত হিসেবে যুদ্ধের সময় চীনের জ¦ালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া। এসব কারণের কোনোটিই যাচাই করা হয়নি।
চীন ও ভারতের অর্থনীতির মধ্যকার সুবিশাল ব্যবধানের অর্থ এই যে, চীন ভারতের নৌ-বিমান সম্পদকে বহুভাবে মোকাবেলা করতে পারে। অভিযানগত দিক দিয়ে চীনের এসইউ-৩৩ ভারতের ব্যর্থ মিগ-২৯কের চেয়ে উন্নত। অন্যদিকে পাশ্চাত্যের রাফায়েল বা এফ-১৮র মতো ইলেকট্রনিক দিক দিয়ে অবিতর্কিতভাবে উন্নত, কিন্তু ব্যয় ব্যবধান হচ্ছে ১০:১। যার ফলে সুখোইর সংখ্যাগত প্রাধান্য প্রশ্নাতীত। স্ট্যালিনের একটি মন্তব্য আছে : সংখ্যার একটি নিজস্ব শ্রেষ্ঠত্ব আছে। এ কথা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সত্য প্রমাণিত হয়েছিল যখন রুশ জঙ্গিবিমানের বিপুল সংখ্যাধিক্য জার্মান বিমানবাহিনী লুফৎওয়াফের বিপুল গুণগত মানকে পরাজিত করেছিল। অন্যদিকে ফকল্যান্ড যুদ্ধে ব্রিটিশ হ্যারিয়ার জঙ্গিবিমান আর্জেন্টিনার উন্নততর ফরাসি মিরেজ জঙ্গিবিমানের চেয়ে ভালো করে। কারণ আর্জেন্টিনা পর্যাপ্ত সংখ্যক জঙ্গিবিমান মোতায়েন করতে পারেনি অথবা হ্যারিয়ারের সাথে মোকাবেলায় বিপুল ক্ষতির শিকার হয়। স্পষ্টতই গুণগত-সংখ্যাগত ম্যাট্রিক্স ভারতের গুণগত উৎকর্ষের ওপর চীনের সংখ্যাগত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
বিমানবাহী জাহাজের মাধ্যমে স্থলে প্রাধান্য বিস্তারও একটি সমস্যামূলক চিন্তা। ভারত মহাসাগরের ওপর একটি দ্রæত দৃষ্টিপাত দু’ধরনের অবস্থার কথা বলে : এক. খুবই শক্তিশালী এটি; দুই. অত্যন্ত দুর্বল এটি। সউদী আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর ও অস্ট্রেলিয়ার মতো শক্তিশালী দেশগুলোর বিরুদ্ধে ভারতের তিনটি বিমানবাহী জাহাজ প্রেরণ করলেও তা হবে আত্মঘাতী, কারণ প্রত্যেকটি দেশেরই ভারতের নৌ জঙ্গিবিমানের কার্যকরভাবে মোকাবেলার ক্ষমতা রয়েছে। অন্যদিকে শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, বাংলাদেশ, সোমালিয়া, মরিশাস, মোজাম্বিকের মতো দেশগুলোর জন্য একটি বিমানবাহী জাহাজই যথেষ্ট। তার মানে হচ্ছে যে, ভারতের বিমানবাহী জাহাজ সজ্জা একটি প্রশ্নের জবাব দেয় যে প্রশ্ন কেউ করেনি।
এসএলওসির সুরক্ষা এবং যুদ্ধকালে চীনের জ¦ালানি প্রবেশাধিকারকে ধ্বংস করা অন্য কোনো পন্থায় ভালো অর্জিত হতে পারে। শান্তির সময় সস্তা অফশোর টহল যানের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরের ওপর নজর রাখা হচ্ছে সর্বোত্তম পন্থা। যুদ্ধকালে বিমানবাহী জাহাজের অভাবের ক্ষেত্রে চমৎকার সাবমেরিন বিধ্বংসী (এএসডবিøউ) অস্ত্রসজ্জিত ফ্রিগেট এবং বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র এ কাজের জন্য অধিক উপযুক্ত। কথা হচ্ছে, ভারতীয় নৌবাহিনীতে এএডবিøউর মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে।
যুদ্ধকালে চীনা নৌবাহিনীকে ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করতে না দেয়ার অর্থ হবে দু’টি হুমকির মোকাবেলা, তাহলো তাদের পারমাণবিক সাবমেরিন ও বিমানবাহী জাহাজ। এ ধরনের পরিস্থিতিতে চীনা পারমাণবিক সাবমেরিন ভারতের যুদ্ধজাহাজগুলোকে চ্যালেঞ্জ করবে এবং সেক্ষেত্রে ভারতীয় নৌবাহিনীর শক্তিশালী সাবমেরিন বিধ্বংসী হেলিকপ্টার বাহিনীর সম্মুখীন হবে। অন্যদিকে চীনা বিমানবাহী জাহাজগুলো ভারতীয় সাবমেরিনের সম্মুখীন হবে।
সাবমেরিন ও সাবমেরিন বিধ্বংসী অস্ত্রশস্ত্র হচ্ছে এমন একটি ক্ষেত্র যে ক্ষেত্রে ভারতের সুবিধা রয়েছে। চীনা সাবমেরিনগুলোতে আওয়াজ হয় তুলনামূলকভাবে অনুন্নত। অন্যদিকে ভারতের কাছে থাকা পাশ্চাত্যের সাবমেরিন ও হেলিকপ্টারগুলো নিঃশব্দ ও ইলেকট্রনিক সক্ষমতাসম্পন্ন। যুদ্ধ মহড়ায় প্রচলিত পাশ্চাত্য সাবমেরিনগুলোকে শনাক্তকরণ এড়িয়ে রুটিনগতভাবে মার্কিন বিমানবাহী জাহাজ ডুবিয়ে দিতে দেখা যায়। ব্রিটিশ সাবমেরিনের সর্বশেষ প্রযুক্তির ফরাসি সেনার হাজার হাজার কিলোমিটার দূরের নিউইয়র্ক বন্দর থেকে একটি জাহাজ ছাড়লেও তা সঠিকভাবে শনাক্ত করতে সক্ষম।
সাবমেরিন সস্তা নয়, তবে তা বিমানবাহী জাহাজ থেকে সস্তা। সাবমেরিন ভারতের শক্তি এবং সাশ্রয়ী, বহুমুখী ক্ষমতাসম্পন্ন ও টেকসই।
চূড়ান্ত বিশ্লেষণে ভারত যদি বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে চায়, যেখানে সে তার ওজনের চেয়েও অনেক নিচে আঘাত করে, বিমাননির্ভরতাই হচ্ছে একমাত্র উত্তর। যাহোক, ভারতের নৌবাহিনীর একটি দুর্বল পরিকল্পনাকৃত, অপারেশনগত দিক দিয়ে অপর্যাপ্ত ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যয়কর বিমাননির্ভরতা ভারতের স্বার্থের অনেক বেশি ক্ষতি করবে।
অভিজিত আইয়ার-মিত্র ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ