Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

এবি ব্যাংকের অফশোর মাধ্যমে সাড়ে ৩শ’ কোটি টাকা পাচার

শাস্তিসহ দ্রুত টাকা ফিরিয়ে আনার তাগিদ সংসদীয় কমিটির

| প্রকাশের সময় : ১৬ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : আরব-বাংলাদেশ (এবি) ব্যাংকের অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে চার বিদেশি কোম্পানির নামে প্রায় সাড়ে ৩শ’ কোটি টাকা বের করে বিদেশে পাচার করে দেয়ার প্রমাণ মিলেছে। বিপুল পরিমাণ এই অর্থ পাচার হয়েছে সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে। যে চার প্রতিষ্ঠানের বিদেশি কোম্পানির নামে টাকা নেয়া হয়েছে সেগুলো হলো- সংযুক্ত আরব আমিরাতের গেøাবাল এমই জেনারেল ট্রেডিং ও সেমাট সিটি জেনারেল ট্রেডিং, সিঙ্গাপুরের এটিজেড কমিউনিকেশনস পিটিই লিমিটেড ও ইউরোকারস হোল্ডিংস পিটিই লিমিটেড।
গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো: রিজওয়ানুল হুদা স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট ঋণগুলোর প্রস্তাবের যথাযথ বিচার বিশ্লেষণ না করা, ইক্যুইটির তুলনায় বেশি পরিমাণ ঋণ মঞ্জুর, অপর্যাপ্ত জামানত, ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বের বিষয়ে কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির অনুক‚লে স্থানান্তর হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে দলের নিকট প্রতীয়মান হয়েছে।
জানা গেছে, টাকার অঙ্কে দেশে ব্যাংক খাতে এর আগে আরো বড় ধরনের জালিয়াতি হলেও অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে এটাই বড় ঘটনা। অফশোর ব্যাংকিং হলো ব্যাংকের অভ্যন্তরে পৃথক ব্যাংকিং। বিদেশি কোম্পানিকে ঋণ প্রদান ও বিদেশি উৎস থেকে আমানত সংগ্রহের সুযোগ রয়েছে অফশোর ব্যাংকিংয়ে। স্থানীয় মুদ্রার পরিবর্তে বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব হয় অফশোর ব্যাংকিংয়ে। ব্যাংকের কোনো নিয়ম-নীতিমালা অফশোর ব্যাংকিংয়ে প্রয়োগ হয় না। কেবল মুনাফা ও লোকসানের হিসাব যোগ হয় ব্যাংকের মূল হিসাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট থেকে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহজেই ঋণ দেয়া হচ্ছে। যেসব প্রতিষ্ঠান ঋণ নিচ্ছে তাদের অস্তিত্ব আছে কি না, তা দেখার কোনো ব্যবস্থা নেই। এ কারণে বাংলাদেশিরাই কাগুজে কোম্পানি তৈরি করে ঋণ সুবিধা নিচ্ছেন। অর্থ লোপাটের নতুন পন্থা হিসেবে অফশোর ব্যাংকিংকে বেছে নেয়া হচ্ছে।
ভুয়া আদেশে ঋণ : অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিষ্ঠান সিমাট সিটি জেনারেল ট্রেডিংকে ২ কোটি ৯৫ লাখ ডলার (২৩৬ কোটি টাকা) ঋণসুবিধা দেয়া হয়। নেপালের সড়ক নির্মাণ প্রতিষ্ঠান কেটিএন এনার্জি প্রাইভেট লিমিটেডকে বিটুমিন সরবরাহ আদেশের বিপরীতেই এ ঋণ দেয়া হয়। ২০১৫ সালের ২৯ জুন থেকে ২৯ ডিসেম্বর সময়ে এসব ঋণ বিতরণ করা হয়। কিন্তু ঋণের কোনো কিস্তি পরিশোধ হয়নি। এ ছাড়া বিটুমিন সরবরাহ হয়েছে কি না, সে বিষয়েও ব্যাংকে কোনো নথি নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বিষয়ে এবি ব্যাংককে জানিয়েছে, সরবরাহ আদেশ ভুয়া বলে পরিদর্শক দলের কাছে মনে হয়েছে। ঋণটি বাংলাদেশি স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর করা হয়েছে। এ ঋণ আদায়ের সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
এদেশীয় সুবিধাভোগী মোরশেদ খান : অফশোর ইউনিট থেকে সিঙ্গাপুরের ইউরোকারস হোল্ডিংস পিটিই লিমিটেডকে ১ কোটি ৪৮ লাখ ডলার (১১৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা) ঋণসুবিধা দেয়া হয়। অথচ প্রতিষ্ঠানটির পরিশোধিত মূলধন মাত্র ৩ মিলিয়ন সিঙ্গাপুর ডলার। ঋণের মঞ্জুরিপত্রে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান মিলেনিয়াম ডিস্ট্রিবিউশন, মিলেনিয়াম মোটরস, মিলেনিয়াম চাং ইয়ং মোটরস, মেসার্স হুন্দাই মোটরস বাংলাদেশ লিমিটেড ও মেসার্স প্যাসিফিক মোটরসকে মোটরযান ও যন্ত্রাংশ সরবরাহের জন্য মূলধন হিসেবে এই ঋণ মঞ্জুর করা হয়। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খানের মালিকানাধীন প্যাসিফিক মোটরস। বাকিগুলোও তারই প্রতিষ্ঠান।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ঋণপত্র খোলা হলেও এর বিপরীতে দেশে মালামাল আসেনি। আর খোলাই হয়েছে মাত্র ২০ লাখ ডলারের ঋণপত্র। বাকি অর্থ ব্যবহারের কোনো হিসাব নেই ব্যাংকের কাছে। পুরো ঋণই এখন মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে। প্রকৃতপক্ষে পণ্য আসার আগেই অর্থ বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের নামে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। মূলত ঋণের অর্থ বাংলাদেশি স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে। ঋণটি আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ।
ভুয়া লেনদেন : বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান লেভেল থ্রি ক্যারিয়ার লিমিটেডের ক্রয় আদেশের বিপরীতে সিঙ্গাপুরের এটিজেড কমিউনিকেশনস পিটিই লিমিটেডকে ১ কোটি ডলারের (৮০ কোটি টাকা) ঋণসুবিধা দেয়া হয়। এটিজেড কমিউনিকেশনস সিঙ্গাপুরে কার্যক্রম শুরু করে ২০১৪ সালের ৭ মে। অফশোর ইউনিট থেকে প্রতিষ্ঠানটিকে একই বছরের ২৮ মে ঋণ বিতরণ করা হয়। ঋণ দেয়ার জন্যই স্বল্প সময়ে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বলে জানা গেছে। সিঙ্গাপুরের এটিজেড কমিউনিকেশনস মূলত খেলনা ও গেমস বিক্রি করে থাকে। আর বাংলাদেশি লেভেল থ্রি ক্যারিয়ার মূলত আইএসপি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। ফলে এ দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনো ধরনের কেনাকাটার প্রয়োজন নেই। প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, লেভেল থ্রি ক্যারিয়ার প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এ ছাড়া ভুয়া সরবরাহ আদেশ ও ঋণের অর্থ ব্যবহার বিষয়ে তথ্য না থাকায় ঋণের আড়ালে বাংলাদেশি স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হিসাবে অর্থ স্থানান্তর করা হয়েছে।
বৈঠক শেষে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ড. মো: আব্দুর রাজ্জাক জানান, এবি ব্যাংকের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে দেয়া ঋণের টাকা দ্রæত উদ্ধারের সুপারিশ করা হয়েছে কমিটির পক্ষ থেকে। অনিয়মের মাধ্যমে দেয়া এই ঋণের এদেশীয় সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিরও সুপারিশ করা হয়। তিনি জানান, চারটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদেশে ‘ব্যবসা’ এবং ‘শিল্পকারখানা’ করার জন্য এসব ঋণ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ঋণ দেয়ার জন্য যে ধরনের বিচার-বিশ্লেষণ ও নিয়ম আছে তা মানা হয়নি বলে প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া যে উদ্দেশ্যে ঋণ নেয়া হয়েছে সেই উদ্দেশ্যের ছিটেফোঁটাও বাস্তবায়ন করা হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট ঋণগুলোর প্রস্তাবের যথাযথ বিচার- বিশ্লেষণ না করা, ইক্যুইটির তুলনায় বেশি পরিমাণ ঋণ মঞ্জুর, অপর্যাপ্ত জামানত, ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বের বিষয়ে কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির অনুক‚লে স্থানান্তর হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে দলের নিকট প্রতীয়মান হয়েছে। এ ব্যাপারে কমিটির সভাপতি বলেন, একপর্যায়ে বলা হয়েছিল যারা এই ঋণ নিয়েছিল তারা যেন ফেরত দেয়। এ জন্য ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তাদের সময়ও দেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে রহিম আফরোজ ২০ মিলিয়নের মতো টাকা ফেরত দিয়েছে। বাকি টাকা এখনও আদায় হয়নি। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ব্যাংকের জন্য সমস্যা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশভিত্তিক। এ জন্য টাকা আদায় করা যাচ্ছে না। তবে প্রচÐ চাপের মুখে সবাই কিছু কিছু টাকা ফেরত দিয়েছে। এখানে সাড়ে তিনশ’ কোটি টাকা, যা আমাদের জন্য অনেক টাকা। সভাপতি বলেন, এসব টাকা বিদেশ থেকে এসে হাওয়ার উপরে নেয়নি প্রতিষ্ঠানগুলো। নিশ্চয়ই আমাদের দেশে এসব বেনিফিসিয়ারি রয়েছে। এর সঙ্গে স্থানীয় কেউ না কেউ জড়িত। সেই বেনিফিসিয়ারিদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছি।
কমিটির সভাপতি ড. মো: আব্দুর রাজ্জাকের সভাপতিত্বে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, কমিটির সদস্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান, ফরহাদ হোসেন, মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী এবং আখতার জাহান।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ