Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভারে মানুষের সীমাহীন ভোগান্তি

নির্মাণ কাজ কবে শেষ হবে কেউ জানে না

| প্রকাশের সময় : ১৫ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বিশেষ সংবাদদাতা : মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ শুরুর পর থেকেই সীমাহীন ভোগান্তি পোহাচ্ছে মানুষ। কবে নির্মাণ কাজ শেষ হবে তা কেউ বলতে পারে না। ভোগান্তি আরো বেড়েছে গত রোববার দিবাগত রাতে গার্ডার ভেঙে হতাহতের ঘটনার পর। এখন মালিবাগ এলাকাসহ নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের নীচ দিয়ে মানুষ চলাচল করতে ভয় পাচ্ছে। বাস, প্রাইভেটকারসহ বিভিন্ন যানবাহনও ফ্লাইওভারকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে। গার্ডার ভেঙে একজন নিহত ও দুইজন আহত হওয়ার পর সাধারণ মানুষ ক্ষীপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশনের উপর। তারা তমার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের শাস্তি দাবি করেছেন। এদিকে, ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি কাজ শুরু করেছে। কমিটির সদস্যরা গতকাল মঙ্গলবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ শুরুর পর থেকে মানুষের ভোগান্তির যেন সীমা নেই। এরই মধ্যে ফ্লাইওভারের নকশা পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তন হয়েছে কাজ শেষ হওয়ার নির্ধারিত সময়। এ কারণে কেউ বলতে পারছেন না কাজ কবে শেষ হবে। এই সময় ক্ষেপণে মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে কয়েকগুণ। ভোগান্তির কারণে মগবাজার-মালিবাগ এলাকা ছেড়ে দিয়েছেন অনেকেই। রোববারের ঘটনার পর অনেকে নতুন করে বাসা ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছেন।
ভুক্তভোগিরা জানান, নির্মাণাধীন এই ফ্লাইওভারের কারণে সারা বছরই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। আর বর্ষা এলে তো কথাই নেই। তখন দুর্ভোগের সীমা থাকে না। তারা জানান, নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের নীচে রাস্তার ফুটপাথ দিয়ে পথচারীদের চলতে হয় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। খানাখন্দে ভরা সড়কে যান চলাচলের সময় ভেতরে থাকা যাত্রীরা প্রাণভয়ে কাঁপতে থাকেন। দুদিন আগের ঘটনার পর সেই ভয় আরো বেড়েছে। গতকাল মালিবাগ এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের নীচ দিয়ে মানুষ চলতে ভয় পাচ্ছে। গাড়িও চলছে খুব কম। যারা নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের নীচ দিয়ে চলছেন তাদের চোখ থাকছে ফ্লাইওভারের দিকে। জানতে চাইলে একজন পথচারী বলেন, না জানি কখন আবার ভেঙে পড়ে। সেই ভয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে রাস্তা পার হচ্ছি। এদিকে, কাকরাইল থেকে মালিবাগ হয়ে যেসব বাস চলাচল করতো সেগুলো শাজাহানপুর হয়ে ঘুরে যাচ্ছে। যাত্রীদের আপত্তির কারণে বাসগুলো মালিবাগের দিকে যাচ্ছে না বলে জানান ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির এক নেতা। তিনি বলেন, যেভাবে রাতের বেলা গার্ডার ভেঙে পড়েছে তাতে যাত্রীরা ভয় পাবে এটাই স্বাভাবিক। সে কারণে অনেক গাড়ি মালিবাগ হয়ে আর যাচ্ছে না। অন্যদিকে, ফ্লাইওভার প্রকল্প এলাকার আশপাশের ব্যবসা গত কয়েক বছর ধরে লাটে উঠেছে। শুষ্ক দিনে ধূলাবালি আর বর্ষায় কাদার যন্ত্রণায় মানুষ প্রকল্প এলাকা দিয়ে হাঁটতেই চায় না। এ কারণে সব ধরনের ব্যবসাই মন্দা যাচ্ছে।
গতকাল সরেজমিন প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রামপুরা-মৌচাক, মালিবাগ-শান্তিনগর ও মালিবাগ-রাজারবাগ পুলিশ লাইন পর্যন্ত এখন অনেক কাজ বাকি। স্থানীয়রা জানান, এসব এলাকায় কাজ খুবই ধীর গতিতে চলছে। নিচের রাস্তায় বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এর ওপর দিয়েই যান চলাচল করছে। চলতে গিয়ে রিকশা, অটোরিকশা সহসাই উল্টে দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সেদিকে কর্তৃপক্ষের কোনো নজর নেই।
ফ্লাইওভার সংশ্লিষ্ট রাস্তার দু’পাশে সারি সারি দোকান রয়েছে। রয়েছে বেশ ক’টি বড় মার্কেট। রয়েছে হাসপাতাল, ক্লিনিক, বাসা-বাড়ি। একাধিক বাসিন্দা জানান, মাসের পর মাস বাসা-বাড়িতে নিজের ব্যবহৃত গাড়ি রাখতে পারছেন না তারা। অন্যত্র ভাড়া রাখতে হচ্ছে। এদিকে ফ্লাইওভারের কাজ, অন্যদিকে রাস্তার করুণ অবস্থা। মালিবাগ মোড়ের এক ব্যবসায়ী বলেন, এ এলাকায় বেশ কয়েকটি হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে। রোগীদের আসতে কী যে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে, তা চোখে না দেখলে বোঝানো যাবে না। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কয়েকজন জানান, তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে উঠেছে। পুঁজি হারিয়ে কেউ কেউ দোকান ছেড়েছেন। কেউ আবার নিঃস্ব হয়ে নিরুপায় বসে আছেন।
রোববার দিবাগত রাতে গার্ডার পড়ে একজন নিহত ও দুই জন আহত হওয়ার পর ফ্লাইওভারের আশপাশের এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। স্থানীয় বাসিন্দারা ঢিমেতালে চলা কাজের জন্য আগে থেকেই ফ্লাইওভার নির্মাণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশনের উপর বিরক্ত। তার উপর একটি মৃত্যু ও দুই জন পঙ্গুত্ব বরণ করায় তারা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন। মালিবাগ এলাকার বাসিন্দা আমীর হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, এই ঘটনার পর মালিবাগ এলাকার মানুষ তমার মালিকের শাস্তির দাবিতে মিছিল করেছে। তিনি বলেন, রোববারের ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলা যাবে না। এটা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অবহেলায় হয়েছে। তমার মতো অযোগ্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কোনো এতো বড় কাজ দেয়া হলো তা মানুষ জানতে চায়। আবার তমার মালিক কি করে এতটা ক্ষমতাধর হলো তাও মানুষ জানতে চায়। এত বড় একটা কাজের জন্য তারা কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখেনি কেনো? এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর ড. এ এস এম আমানউল্যাহ বলেন, উন্নয়নের নামে একটা ফ্লাইওভার মানুষের কতটা ভোগান্তির কারণ হতে পারে তা একমাত্র উদাহরণ মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভার। বছরের পর বছর ধরে এর নির্মাণ কাজ চলছে। এর যেন কোনো শেষ নেই, টার্গেট নেই। এটা কোনো নিয়ম হতে পারে না। তিনি বলেন, রোববারের ঘটনাকে নিছক দুর্ঘটনা বলার কোনো সুযোগ নেই। এটার দায় তমা কোনোভাবে এড়াতে পারে না।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফ্লাইওভারের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছে সুশান্ত কুমার পাল। এর আগে এই প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন নাজমুল আলম। তিনি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। তবে উপদেষ্টা হিসেবে তাকে বহাল রাখা হয়েছে। তমার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সাথে সখ্যতার কারণেই তাকে কায়দা করে বহাল রাখা হয়েছে। অনেকে মনে করেন, সাবেক এই প্রকল্প পরিচালকের অদক্ষতার কারণেও ফ্লাইওভারের কাজে গাফিলতি হয়েছে। এর সাথে তমার ব্যবসায়ীক কৌশল ও প্রভাব তো আছেই। এ প্রসঙ্গে এলজিইডির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তমার স্বত্বাধিকারী আতাউর রহমান মানিক এক সময় ছাত্রদল করতো। বিএনপি নেতা বরকত উল্লাহ বুলুর হাত ধরে তার হাতে খড়ি। সেই মানিকই এখন আওয়ামী লীগের নেতা। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে তিনি কাজ বাগিয়ে নেন। এমনকি তার কথায় টাকাও বাড়ে সময়ও বাড়ে। একজন ঠিকাদারকে তার ইচ্ছামতো কাজ করার সুযোগ দিলে তিনি দুর্নীতি তো দূরে থাক যা খুশি তাই করবেন এটাই স্বাভাবিক। মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভারে তাই হয়েছে। যার পরিণতিতে এ পর্যন্ত ৯ জনকে প্রাণ দিতে হয়েছে। পঙ্গুত্ব বরণ করেছে বেশ কয়েকজন।
উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের ১৬ ফেব্রæয়ারি আট কিলোমিটার দীর্ঘ মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০১৪ সালের ডিসেম্বর। পরে প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এ সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। এ ফ্লাইওভার নির্মাণে প্রথম ধাপে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৪৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। দ্বিতীয় ধাপে ৭৭২ কোটি আর এখন সেই ব্যয় দাঁড়িয়েছে এক হাজার ২১৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও তা করতে পারেনি প্রকল্পটি বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান এলজিইডি। ব্যর্থতাকে আড়াল করতেই ৮ দশমিক ২৫ কিলোমিটার ফ্লাইওভারের মধ্যে প্রায় তিন কিলোমিটার অংশ খুলে দেয়া হয়। বাকি রয়েছে আরো প্রায় ছয় কিলোমিটার। যথাসময়ের মধ্যে ছয় কিলোমিটার ফ্লাইওভারের কাজ সমাপ্ত হবে কি-না, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে খোদ সংশ্লিষ্ঠদের মধ্যেই। এর মধ্যে রোববারের ঘটনায় সেই শঙ্কা নতুন মাত্রা যোগ করেছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ