ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
এবি সিদ্দিক : বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশনের (বিটিএমসির) ৮৬টি বৃহৎ শিল্পের মধ্যে বর্তমানে চালু আছে মাত্র ৩টি। আর ৮৩টি শিল্পই বিক্রি, বন্ধ এমনি কয়েকটির অস্থিত্বই বিলীন হয়ে গেছে। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ ইন্ডাট্রিয়াল এন্টারপ্রাইজেস (রাষ্ট্রীয়করণ) অর্ডারের মাধ্যমে গঠিত হয়েছিল বিটিএমসি। তখন ৭৪টি শিল্প নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল। এরপর ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে আরো ১২ শিল্প প্রতিষ্ঠার মাধ্যমের মোট শিল্পের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৬টিতে। আবার ১৯৭৭ থেকেই শুরু হয় বিরাষ্ট্রীয়করণ। ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিরাষ্ট্রীয়করণের মাধ্যমে ৬৫টি শিল্প হস্তান্তর, বিক্রি ও অবসায়ণ করা হয়। তারপর শিল্পের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮টিতে। এগুলোর মধ্যে ৬টি চালানো হয় সার্ভিস চার্জে, ১টি আংশিক ভাড়ায়। আর ১১টি বন্ধ করে দেয়া হয়। ৩টি শিল্প বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সার্ভিসচার্জ ও ভাড়ায় দেয়া হয় বেঙ্গল, সুন্দরবন, রাজশাহী, দারোয়ানী, আমিন, রাঙ্গামাটি, আহমেদ বাওয়ানী, দিনাজপুর, আরআর কাদেরিয়া ও মাগুরা টেক্সটাইল। টেক্সটাইল পল্লী বাস্তবায়নাধীন শিল্পের মধ্যে খুলনা ও চিত্তরঞ্জন বন্ধ আছে। প্রাইভেটাইজেশনের তালিকায় ভালিকা উলেন, সিলেট টেক্সটাইল ও কুড়িগ্রাম টেক্সটাইল। উৎপাদন বন্ধ টাঙ্গাইল ও দোস্ত টেক্সটাইল। সূত্রঃ বিটিএমসি। ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ পাট কল করপোরেশনের অধিন বৃহৎ মিলের সংখ্যা ছিল ৮২টি। বর্তমানে চালু আছে ২৬টি। বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প করপোরেশনের প্রতিষ্ঠান কতটি ছিল তার সঠিক কোন তথ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দিতে পারেননি। তবে একজন কর্তাব্যক্তির ভাষায় ২৮টির মতো ছিল। এখন আছে ১৩টি। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের প্রতিষ্ঠান কতটি ছিল তার কোন সঠিক তথ্য কর্তৃপক্ষ দিতে পারেনি। একজন বলেন ৩০টির বেশি ছিল। বর্তমানে ১৫টি চিনি কল। সহযোগী কোন খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নেই। রাষ্ট্রায়ত্ত বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান বর্তমানে আছে যেগুলো আছে সেগুলোও আর বেশি দিন চলবে না। কারণ- মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে প্রায়। বাংলাদেশে এশিয়া মহাদেশ তথা বিশে^র অন্যতম বৃহত্ত পাটকল ছিল আদমজী। বিশে^র সেরা তেল মিল ছিল কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে। অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান ছিল, যেগুলোর কোন চিহ্নিই নেই। বিশ^ব্যাংক আর আইএমএফের তাগিদে বাংলাদেশ বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু করে। অজুহাত হচ্ছে সেগুলো লোকসানী। এখনও অবশ্য লোকসান দিয়েই যাচ্ছে। আর লোকসানের কারণ মূলত লুটপাট, যেটি স্বাধীনতার পর পরই শুরু হয়েছিল। ১৯৭২-৭৫ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করা হলেও আসলে জাতীয়করণকে ব্যবহার করা হয় দেশীয় লুটরো ও ব্যবসায়ী পুঁজির আদিম সঞ্চয়নে। সে অনেক বড় ইতিহাস। সেই ইতিহাসে আর যাচ্ছি না। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু হয় ১৯৭৭ থেকেই। আর ১৯৮১ পর্যন্ত মোট ২৫৫টি রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান বেসরকারিকরণ করা হয় যার মধ্যে ১১০টি ছিল বৃহৎ আকারের পাবলিক সেক্টর কর্পোরেশনের এর অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও শিল্প ঋণ সংস্থাসহ সরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এসব বেসরকারিকৃত শিল্পের নব্য মালিকদের স্বল্প সুদে ঋণ সরবরাহ করা হয়, সস্তায় কাঁচামাল আমদানী ও বাজার মূল্যের চেয়ে কমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ, সাত বছরের ট্যাক্স হলিডের সুবিধা দেয়া হয়। কিন্তু এভাবে প্রাপ্ত সুবিধাদি শিল্পে বিনিয়োগের এর বদলে বিনিয়োগ করা হয় ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানী-রপ্তানির কাজে। ফলে ১৯৭৫ থেকে ৮১ সাল পর্যায়ে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও শিল্প ঋণ সংস্থা কর্তৃক বিতরণকৃত ঋণের ৯৫%-বেসরকারি খাতে গেলেও বেসরকারি শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ তেমন বাড়েনি। কারণ ঋণ পুরোটাই অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার হয়। এভাবে ঋণের টাকা অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যাবহার করে ঋণগ্রহীতা শিল্পপতিরা কিছুদিনের মধ্যেই ঋণ খেলাপি হিসেবে আবির্ভূত হয় ও নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে সব দায় দেনা থেকে রেহাই পেয়ে যায়! (সূত্র: পলিটিকস অব প্রাইভেটাইজেশান ইন বাংলাদেশ, মোবাশ্বের মোনেম, ২০০৬) এরশাদের আমলে (১৯৮২-১৯৯০) এই ধারা অব্যাহত থাকে এবং ত্বরান্বিত হয়। ১৯৮২ সালের নতুন শিল্পনীতিতে বেসরকারিকরণের উপর আরো জোর দেয়া হয়, মাত্র ৬টি সেক্টর ছাড়া আর সমস্ত সেক্টরে বেসরকারি বিনিয়োগ অবাধ করে দেয়া হয়। দেশীয় পুঁজিপতি ও বিদেশী সংস্থা বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের আস্থায় আসার জন্য অবিশ্বাস্য দ্রæত গতিতে বেসরকারিকরণ শুরু হয়। এক বছরের মাথায় ২৭টি টেক্সটাইল মিল ও ৩৩টি পাট কল পানির দরে বেচে দেয়া হয়। এছাড়া ১৬ মাসের মাথায় ক্রেতার পছন্দ অনুযায়ী ২১টি মাঝারি শিল্প বেচে দেয়া হয় যার ৭৮%- ছিল লাভজনক এবং বিক্রি করার কিছু দিনের মধ্যেই যার ৮০% উৎপাদন হ্রাস ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বিশ্বব্যাংকের দলিল অনুসারে, ১৯৮২ সালের শিল্প নীতি অনুসারে পাট ও টেক্সটাইল মিল ছাড়াও আরো ৪৭৪টি শিল্প ও ২টি সরকারি ব্যাংক বেসরকারিকরণ করা হয় (সূত্র: জুট ইন্ডাস্ট্রি রিহ্যাবিলিটিয়েশান ক্রেডিট- প্রজেক্ট কমিশান রিপোর্ট, ১৯৯০)। বেসরকরিকৃত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর ১৯৮৬ সালে চালানো এক গবেষণায় দেখা যায়, বেসরকারিকরণের পর পাটকলগুলোর উৎপাদনশীলতা রাষ্ট্রীয় খাতে থাকার সময়ের তুলনায় কমেছে, টেক্সটাইল মিলগুলোর গড় উৎপাদন কমেছে ও আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে এবং সর্বোপরি মিলগুলোর সম্পদ হ্রাস পয়েছে, ঋণ বেড়েছে। এ সময়ে কোটিপতি হওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় ছিল বেসরকারি শিল্পের নামে ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধ না করা। ১৯৯০ সালের জুন মাস নাগাদ বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও শিল্প ঋণ সংস্থার কাছে শিল্পপতিদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১০৫০ কোটি টাকা। ১৯৯৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত মোট ৭৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। বাংলাদেশ প্রাইভেটাইজেশান কমিশন ২০১০ সালে বেসরকারিকৃত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে একটি সমীক্ষা করে। “বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সমীক্ষা ২০১০” নামের এই প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ৭৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩১টি শিল্প প্রতিষ্ঠানকেই বন্ধ পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে রাষ্ট্রায়ত্ত বৃহৎ প্রতিষ্ঠান বিরাষ্ট্রীয়করণের নামে যে লুটপাট হয়েছে তা পৃথিবীতে নজিরবিহীন। বিশে^ বিরাষ্ট্রীয়করণের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয়করণকেও শক্তিশালী করা হচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের মত গরিব দেশে ঢালাওভাবে বিরাষ্ট্রীয়করণ কখনও সুফল বয়ে আনে না। রাষ্ট্রীয়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার ফলে আমদানিনির্ভরতা বাড়ছে, হাজার হাজার মানুষ বেকার হয়েছে, শিল্পের উৎপাদন কমছে, জাতীয় অর্থনীতিতে চাপ বাড়ছে। যেমন- এক সময় ইউরিয়া সার রফতানি করা হতো, এখন আমদানি করতে হচ্ছে। ইউরিয়ার বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২৩ লাখ টন আর উৎপাদন হয় সাড়ে ৮ থেকে ৯ লাখ টন। এখানে উল্লেখ্য-গ্যাস সংকটের কারণে কারখানাগুলো ঠিক মত চালানো যাচ্ছে না। আর নতুন কারখানা না হওয়ায় চালু কারখানাগুলোও বন্ধ হওয়ার পথে এগুচ্ছে। চিনি কলগুলোর একই অবস্থা। বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২০ লাখ টন, উৎপাদন হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ হাজার টন, বাকিটা আমদানি করতে হচ্ছে তাও আবার মানব দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর চিনি। বিশে^র ৬৫টি দেশে পাটজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। উৎপাদন কম হওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী রফতানি করা যাচ্ছে না। মূলত শিল্পজাত পণ্যের উৎপাদন কম হওয়ায় আমদানিনির্ভরতা বেড়েই চলেছে। মোট আমদানি ব্যয় এরই মধ্যে ৪২ হাজার মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে যেসব পণ্যের চাহিদা মেটানো হতো, সেগুলো এখন আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে। গোটা সরকারি-বেসরকারিভাবে শিল্পায়নে প্রতিযোগিতা চলছে। আর বাংলাদেশে সরকারিভাবে শিল্পায়নের নামে হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে।
লেখক: সাংবাদিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।