Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঝুঁকিপূর্ণ ২৫ হাজার কারখানা

পুরান ঢাকার কেমিকেল গোডাউন সরালেও বিপদ কমবে না

| প্রকাশের সময় : ১৩ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নূরুল ইসলাম : পুরান ঢাকার ২৫ হাজারেরও বেশি অবৈধ কারখানা সরবে কবে?-এই প্রশ্ন স্থানীয় বাসিন্দাদের। গতকাল রোববার থেকে পুরান ঢাকার কেমিকেলের গোডাউন সরানো শুরু হয়েছে। কেমিকেল গোডাউন সরানো হলেও ঝুঁকিও থেকেই যাবে। কারণ, বেশির ভাগ কারখানায় ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন রাসায়নিকসহ দাহ্য পদার্থ এবং নানা ধরনের জ্বালানি তেল। কারখানাগুলো গড়ে উঠেছে আবাসিক ভবন ও বাসাবাড়িতে। এতে করে নিমতলীর মতো দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন পুরান ঢাকার বাসিন্দারা। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, নিমতলীর ঘটনার পর থেকে পুরান ঢাকার কেমিকেল গোডাউনসহ সব ধরনের কারখানা সরানোর জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছি আমরা। কেমিকেল গোডাউন সরালেও ঝুঁকিও থেকেই যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আবাসিক এলাকায় গোডাউন, কারখানা, ফ্যাক্টরী কোনটাই থাকা উচিত নয়। এগুলো সবার জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ।
পুরান ঢাকায় জন্মগ্রহণ করে নিজেদেরকে গর্বিত মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কিন্তু তাদের সেই গর্ব দিন দিন এভাবে বিলীন হয়ে যাবে এটা তারা কল্পনাও করেননি বলে জানান নয়াটোলার কাগজ ব্যবসায়ী বাবুল শিকদার। তিনি বলেন, এক সময় পুরান ঢাকায় ছোটখাটো কারখানা গড়ে উঠেছিল সময়ের প্রয়োজনে। যুগ যুগ ধরে সেই প্রবণতা এতোটা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করবে তা কে জানতো? আমরা এখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা করছি, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করছি। তিনি বলেন, এখানকার হাজার হাজার কারখানা গড়ে উঠেছে অবৈধভাবে। সংখ্যায় ২৫ হাজার বলা হলেও বাস্তবে তার চেয়ে অনেক বেশি হবে। বেশিরভাগই চলছে স্থানীয় প্রভাবশালী ও পুলিশকে মাসোহারা দিয়ে। সিটি কর্পোরেশনের হিসাব অনুযায়ী, পুরান ঢাকার ১০টি থানা এলাকার ২৫ হাজার অবৈধ কারখানার মধ্যে ১৫ হাজার কারখানা গড়ে উঠেছে আবাসিক এলাকার বাসাবাড়ীতে। কয়েক হাজার কারখানা আবার পুরাতন জরাজীর্ণ ভবনে। বাহির থেকে দেখলে বোঝার উপায় নেই এগুলোতে কী আছে।
জানা গেছে, ছোট কারখানা দিনে দিনে বড় আকার ধারণ করেছে। মালিকপক্ষ লাভের অংশ দিয়ে একাধারে কারখানার পরিসর বাড়ালেও বৈধতার চিন্তা করেনি। আবার বেশিরভাগ কারখানায় শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে। যা আইনত অপরাধ। চকবাজার এলাকার ব্যবসায়ী নাজিম উদ্দিন বলেন, চকবাজারসহ আশপাশের এলাকায় শত শত পলিথিন কারখানা। বাহির থেকে দেখলে বোঝা যায় না। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চলছে এসব অবৈধ কারখানা। প্লাস্টিক উৎপাদনের নামে এরা দিনে রাতে পলিথিন উৎপাদন করছে। রাতের অন্ধকারে সেগুলো ট্রাকে ভরে ঢাকার বাইরে পাঠানো হচ্ছে। অথচ প্রশাসন নাকি এসব কারখানা খুঁজে পায় না। রাজধানীর লালবাগ, হাজারীবাগ, কোতোয়ালি, চকবাজার, বংশাল, কামরাঙ্গীরচর, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, কদমতলী ও সূত্রাপুর থানা নিয়ে পুরান ঢাকা গঠিত। এই ১০ থানা এলাকায় হাজার হাজার অবৈধ কারখানায় সমানে ভেজাল, দুই নম্বর ও নকল জিনিসপত্র তৈরী হচ্ছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পুরান ঢাকায় অবৈধ কারখানার মধ্যে রয়েছে, ড্রাইসেল বা ব্যাটারি কারখানা, নকল ওষুধ তৈরির কারখানা, নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ তৈরির কারখানা, পলিথিনের দানা, প্লাস্টিক সরঞ্জাম, নকল বৈদ্যুতিক ক্যাবল, আচার, চকোলেট, বিস্কুট তৈরির কারখানা ও বেকারি, ঝালাই কারখানা, রেক্টিফায়েড স্পিরিট ব্যবহার করে নানা সুগন্ধি ও আতর তৈরির কারখানা, আতশবাজি ও পটকা, সাইকেল, খেলনা, নকল কসমেটিকস ও গহনা, জুতা-স্যান্ডেল তৈরির কারখানা, রাবার ফ্যাক্টরি, রং, সলিউশন তৈরির কারখানা, বিøচিং পাউডার, ওয়াশিং সামগ্রী, সাবান, ভিসিডি প্লেয়ারসহ শতাধিক পণ্য তৈরির কারখানা। এসব কারখানার কাজ চলছে প্রকাশ্যে। নজর আছে প্রশাসনের, কিন্তু ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো তাগিদ নেই। ব্যবসায়ীরা জানান, পুলিশকে নিয়মিত মাসোহারা দিয়েই তারা ব্যবসা করছেন। তবে ব্যবসায়ীদের এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন থানার কর্মকর্তারা। লালবাগ থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, এখানে অবৈধ কারখানাগুলো অনেক পুরাতন। বাসাবাড়িতে এগুলো গড়ে উঠেছে। পুরাতন বলে পুলিশ ইচ্ছা করলেই সেগুলো উচ্ছেদ করতে পারে না। এ ছাড়া প্রতিটি কারখানার নেপথ্যে রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা জড়িত। তাদের তদ্বিরেও এগুলো সরানো যায় না বলে দাবি করেন তিনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অবৈধ কারখানাগুলোকে কেন্দ্র করে অবাধে বিক্রি হচ্ছে মারাত্মক দুর্ঘটনার জন্ম দিতে পারে এমন সব দাহ্য ও রাসায়নিক পদার্থ। সালফার, পটাশ, ফসফরাস, সালফিউরিক এসিড, নাইট্রিক এসিড, ইথানল, মিথাইল, রেক্টিফায়েড স্পিরিট, ফরমালডিহাইড, এডহেসিভ বা সলিউশন, তারপিনসহ নানা ধরনের গানপাউডার বিক্রি হয় যত্রতত্র। এসব ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক এলাকারই বিভিন্ন বাসাবাড়িতে গোডাউন বানিয়ে অনিরাপদ ব্যবস্থাপনায় রাখা হয়। এগুলোর বিস্ফোরণেও নিমতলীর মতো ট্র্যাজেডীর জন্ম দিতে পারে বলে অনেকেরই আশঙ্কা। তাঁতীবাজারের ব্যবসায়ী শিবু সরকার বলেন, কেমিকেল গোডাউন সরালেই যে ঝুঁকি কমে যাবে সে ধারণা ভুল। এখানকার প্রতিটি কারখানায় দাহ্য কেমিকেল ব্যবহার করা হয়। সে সব দাহ্য পদার্থ যে কোনো ধরনের বড় দুর্ঘটনার জন্ম দিতে পারে। বিশেষ করে লালবাগ, চকবাজার, বংশাল এলাকার জুতার ফ্যাক্টরীগুলোতে যে সলিউশন ব্যবহার করা হয় সেগুলো খুবই বিপজ্জনক। জানা গেছে, শুধু সলিউশন নয়, জুতা ও চামড়ার ফ্যাক্টরীগুলোতে অ্যাডহেসিভ বা বেলি, মিল্ক কেমিক্যাল, সিনথেটিক রাবার অ্যাডহেসিভ বা পেস্টিং, রাবার সলিউশন বা পিইউ, রাবার সলিউশন এসপি, আনসারি আর কালো পেস্টিং-এর মতো বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়। এগুলো যে কোনো সময় দুর্ঘটনার জন্ম দিতে পারে উল্লেখ করে নাজিম উদ্দিন নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, সরকারের উচিত পুরান ঢাকাবাসীর জীবন রক্ষার জন্য এসব অবৈধ কারখানা, ফ্যাক্টরী ট্যানারীর মতো অন্যত্র সরিয়ে নেয়া। এগুলো না সরানো পর্যন্ত আমরা কেউই নিরাপদ নই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ