Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে

| প্রকাশের সময় : ১৩ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মো. ওসমান গনি : ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলছে আমাদের দেশে শিক্ষিত বেকার লোকের সংখ্যা। ছেলেমেয়েরা শিক্ষাজীবন শেষ করে স্বপ্ন দেখে চাকরির। চাকরি করে তারা তাদের সংসার নিয়ে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করবে- এটাই তাদের আকাক্সক্ষা স্বপ্ন। কিন্তু শিক্ষাজীবন শেষে মিলছে না চাকরি নামক সোনার হরিণের দেখা। ফলে ঘরে ঘরে শিক্ষিত বেকার লোকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। স¤প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের যুব-বেকারত্ব বিষয়ক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশের যুবসমাজের ৯ দশমিক ১ শতাংশ বেকার। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এই হারে বেকার রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশে প্রায় ২৬ লাখ বেকার রয়েছে। তাদের মধ্যে ৭৮ শতাংশ যুবক-যুবতী। ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের যুব শ্রমশক্তি ধরে প্রতিষ্ঠানটি। বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, এ বয়সী ১৯ লাখ ৩৯ হাজার তরুণ-তরুণী কোনো কাজ করে না। এই বয়সসীমার বাইরেও রয়েছে অসংখ্য বেকার। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। আর বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতক পাস লোকই বেকার। এ অবস্থায় বেকারত্ব থেকে হতাশা ভর করছে যুবকদের মাঝে। যার কারণে তারা জড়িয়ে পড়ছে মাদকসহ  নানা অপরাধমূলক কাজে। তাদের সাথে সাথে নষ্ট হচ্ছে সমাজের অগণিত যুবক। মদ, গাঁজা, হেরোইন, ইয়াবা ও নারী কেলেংকারিসহ আরও নানা ধরনের ঘৃণ্য কাজে এরা জড়িয়ে পড়ছে। চাকরি না থাকার কারণে তারা হতাশ হয়ে এ নিষিদ্ধ জগতে পা বাড়ায়। তাদের ধ্যাণ-ধারণা শুধু টাকা রোজগার করা। অনেক শিক্ষিত ছেলেমেয়ে সংসারে মা-বাবার বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে মা-বাবা অজস্র টাকা-পয়সা খরচ করছে। শিক্ষাজীবন শেষ করে যেখানে মা-বাবার সংসারে হালধরার কথা সেখানে উল্টো মা-বাবারই ছেলেমেয়েদের টাকা দিতে হয়। যা দেশের অনেক মা-বাবার জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। আবার অনেক সময় দেখা যায়, মা-বাবা ছেলেমেয়েদের টাকা দিতে অস্বীকার করলে নানা রকম অঘটন ঘটে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, শিক্ষা, যোগ্যতা, দক্ষতা থাকার পরও যখন কর্মসংস্থান হয় না, তখন এমন অবস্থা অস্বাভাবিক নয়। রাষ্ট্র এদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যর্থ হচ্ছে। আমাদের দেশে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা শেষ করে বেকারত্বের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রায় অর্ধকোটি শিক্ষিত বেকার। শিক্ষিত বেকার ছেলেমেয়েদের মিছিল চোখে পড়বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে গেলে। তিন তলাবিশিষ্ট বিশাল আয়তনের এ গ্রন্থাগারটিতে তিল ধারণের ঠাঁই মেলে না। লাইব্রেরি খোলে সকাল ৮টায়। কিন্তু বসার জায়গা পেতে রাত পোহাবার আগ থেকেই লাইব্রেরির গেটে ব্যাগের লাইন পড়ে যায়। লাইনে দাঁড়ানো এক শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম জানায়, মাস্টার্স শেষ করেছি তিন বছর আগে। বিসিএসের সাথে অন্যান্য চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছি। কিন্তু মিলছে না। লাইব্রেরিতে চাকরিপ্রার্থীদের ভিড়ে জায়গা পাওয়া যায় না। তাই লাইনে দাঁড়িয়ে জায়গা ধরতে হয়। চাকরি পরিস্থিতি প্রসঙ্গে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদেকের মতে, গত কয়েক বছরের স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। কিন্তু সে পরিমাণ কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি।  আর জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির কো-চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমানের মতে, বাংলাদেশে দিন দিন শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ার অন্যতম কারণ ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে উচ্চশিক্ষার কোনো সমন্বয় নেই। কোন সেক্টরে কত লোক প্রয়োজন তার পরিসংখ্যান তো দূরে থাক, কোনো ধারণা পর্যন্ত নেই। অর্থনৈতিক গতির সঙ্গে শিক্ষার কোনো সমন্বয় না থাকায় শিক্ষিত বেকারত্ব বাড়ার অন্যতম কারণ।  সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, কাজের সুযোগ না পেয়ে অসংখ্য বেকার যুবক হতাশা থেকে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। হতাশা থেকে আত্মহননের পথও অনেকে বেছে নিচ্ছে। একই কারণে নিকটাত্মীয়কে হত্যা করার মতো ঘটনাও এই সমাজে ঘটছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপিকা ড. মাসুদা এম রশিদ চৌধুরীর মতে, দেশে বেকারের সংখ্যা বাড়লে সামাজিক অস্থিরতাও বাড়বে। নতুন নতুন অপরাধ প্রবণতাও বাড়বে। শিক্ষিত যুবকদের অনেকেই হতাশা থেকে মাদকের সংস্পর্শে আসছে। এই সুযোগে মাদক বাণিজ্যসহ অনেক বেআইনি কর্মকান্ডে জড়িয়ে আয়-রোজগারের পথ খুঁজছে অনেকে। দেশের সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থানের জোগানদাতা বেসরকারি খাত। অথচ এই খাতের অবস্থা গেল কয়েক বছর ধরেই ভাল যাচ্ছে না। বিনিয়োগ পরিবেশ ভাল না থাকার কারণে নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে না বরং অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। এর ফলে বাড়ছে বেকারের সংখ্যা। বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানের মতে, প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে গত ৩ বছরে সারাদেশের ৬১৮ তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর বাইরে আরও ৩১৯ কারখানা বন্ধের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। তিনি বলেন, এসব কারখানা বন্ধ না হলে আরও কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হতো। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারপ্রেস নেটওয়ার্ক, আইপিএনের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রতি বছর প্রায় ২৭ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে আসে। কিন্তু সরকারি বা বেসরকারিভাবে কাজ পায় মাত্র ২ লাখ মানুষ। ফলে প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক মানুষ বেকার থাকছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপ-২০১৫ অনুযায়ী, গেল দুই বছরে মাত্র ৬ লাখ নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। অর্থাৎ বছরে গড়ে মাত্র ৩ লাখ মানুষ চাকরি বা কাজ পেয়েছে। ফলে প্রতি বছর বেকার হচ্ছে প্রায় ২৪ লাখ মানুষ। সেই হিসাবে দুই বছরে দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে ৪৮ লাখ।  আর বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক বিশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতক পাস লোকই  বেকার। আর আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের (আইএলও) ‘বিশ্ব কর্মসংস্থান ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি-২০১৫’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে বেকারত্ব বৃদ্ধির হার ৪.৩৩ শতাংশ। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০১৬ সাল শেষে মোট বেকার দ্বিগুণ হবে। সংস্থাটির মতে, বেকারত্ব বাড়ছে এমন ২০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান ১২তম।  জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) তথ্যমতে, দেশে বেকার যুবকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯০ থেকে ’৯৫ সালে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী বেকার যুবকের সংখ্যা ছিল ২৯ লাখ। ২০০৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে তা প্রায় পাঁচ গুণ বেড়ে দাঁড়ায় এক কোটি ৩২ লাখে, যা বর্তমানে দেড় কোটি ছাড়িয়েছে। এদের বাদ দিয়ে দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নেয়া আমাদের জন্য কষ্টদায়ক হবে। তাই সরকারের সাথে সাথে দেশের উচ্চপর্যায়ের লোকদের বেকারের কর্মসংস্থানের ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে। বেকার লোকদের কারিগরি শিক্ষার জন্য কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। সমাজের বিত্তবান লোকেরা বেকারত্ব দূরীকরণে এগিয়ে এলে বেকারত্বের হার আস্তে আস্তে হ্রাস পাবে। বেকার লোকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারলে দেশে অসামাজিক কার্যাবলী কমে আসবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন