ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
এবিসিদ্দিক : গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ঘোষণার সাথে সাথেই প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয় উপদেষ্টা আর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বললেন যে, ‘বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হবে’। এতে মনে হচ্ছে সরকার যেন জনগণের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে গেছেন। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাড়ানো হচ্ছে গ্যাস আর বিদ্যুতের দাম। কিন্তু কেন? সরকারের দায়িত্বশীলরা বলছেন, ভর্তুুকি সমন্বয় করতেই দাম বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু ভর্তুকি কোথায়? আর কিসের জন্যই বা ভর্তুকি? গ্যাস খাত সব সময়ই চলছে মুনাফায়। আর সরকার পাচ্ছে মোটা অংকের রাজস্ব। যেমনÑ গেল ২০১৫-১৬ অর্থবছরে গ্যাস কোম্পানিগুলোর পরিচলনা মুনাফা ছিল ১ হাজার ৬৭৬ কোটি ৪০ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। ঐ অর্থবছরে গ্যাস বিক্রি করা হয় ১০ হাজার ২৩০ কোটি ৫০ লাখ ৮৯ হাজার টাকার। ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ সরকারকে দেয় ৩ হাজার ৫৫৪ কোটি ৩০ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। লক্ষণীয় বিষয় হলো যে, ঐ অর্থবছরে গ্যাস উৎপাদন ব্যয় ছিল মাত্র ৫১ কোটি ৯০ লাখ ৬০ হাজার টাকা। বাকিটা বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য ব্যয়। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা পড়েছে ২ হাজার ৪৬৯ কোটি ২০ লাখ ৭০ হাজার টাকা। এমনিভাবে প্রতি বছর গ্যাস খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা আর রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা পড়ছে। পাঁচ বছরে (২০১০-১১ থেকে ২০১৪-১৫ অর্থবছর) পেট্রোবাংলা ও এর অধীনস্ত বিভিন্ন কোম্পানি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়েছে ২৫ হাজার ৮৭৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এরমধ্যে কোম্পানিগুলোর লভ্যাংশ আয় ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা। বাকিটা সম্পূরক শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর, ডিএসএল বকেয়া, আয়কর, কাস্টমস শুল্ক ও রয়্যালটি। পাশাপাশি পেট্রোবাংলার কাছে এখন অলস পড়ে আছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। এমন পরিস্থিতিতেও গ্যাস খাতে ভর্তুকি থেকে সরে আসার যুক্তি দেখিয়ে আরেক দফা গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে সরকার। যদিও বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে গ্যাস খাতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ভর্তুকিই নেই। পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, ২০১০-১১ অর্থবছরে গ্যাস খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয় ছিল ৪ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা। এরমধ্যে কোম্পানিগুলোর লভ্যাংশের পরিমাণ ছিল ৪১৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে রাজস্ব আসে ৪ হাজার ৫৩৮ কোটি ৩৩ লাখ টাকা, যার মধ্যে লভ্যাংশ ছিল ৩৮৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫ হাজার ৫৮৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকা রাজস্ব আসে, যার মধ্যে লভ্যাংশ ছিল ৮৩৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রাজস্ব আসে ৫ হাজার ৩৭৭ কোটি ৯৪ লাখ টাকা এবং লভ্যাংশ হয় ৪৪৬ কোটি ৮ লাখ টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে গ্যাস খাত থেকে ৬ হাজার ২০৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা রাজস্ব হয় সরকারের, এর মধ্যে লভ্যাংশ দাঁড়ায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা। পেট্রোবাংলার বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গ্যাস বিক্রি থেকে প্রাপ্ত লাভের অংশ ছাড়াও গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে (জিডিএফ) জমা আছে ৩ হাজার ৭২ কোটি টাকা। নতুন গ্যাসক‚প অনুসন্ধান, খনন এবং গ্যাস খাতের উন্নয়ন কর্মকাÐের ব্যয় বহনের লক্ষ্যে ২০০৯ সালে এ তহবিল গঠন করা হয়, যেখানে প্রতি ঘনমিটার গ্যাস বিক্রির বিপরীতে ১ থেকে দেড় টাকা জমা হয়। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির কাছে আয়ের সঞ্চিতি রয়েছে ৬ হাজার ২১১ কোটি টাকা। মূলধন সঞ্চিতিও রয়েছে ১ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ সব মিলে বর্তমানে পেট্রোবাংলার ১০ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকার তহবিল রয়েছে, যার পুরোটাই অলস পড়ে আছে। গ্যাস বিতরণকারী ছয়টি কোম্পানিও লাভে আছে। মুনাফায় শ্রমিকের অংশ (ডবিøউপিপিএফ) এবং কর-পরবর্তী মুনাফা পরিশোধ করার পর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকারও বেশি লাভ করে কোম্পানিগুলো। এরমধ্যে তিতাস ৮৮৮ কোটি ৬১ লাখ, জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানি ৯৮ কোটি ২৮ লাখ, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি ৪২ কোটি ৯০ লাখ, সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানির ৫ কোটি ২৪ লাখ, বাখরাবাদ গ্যাস কোম্পানি ১৩৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা এবং কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানি ৩২৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা মুনাফা করে। সব বিতরণ কোম্পানি লাভজনক থাকার পরও নতুন করে দাম বাড়িয়েছে সরকার।
সরকার বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন করছে, তবে এর খেসারতটা জনগণকেই দিতে হচ্ছে বা হবে। বর্তমান সরকার গত ৫ বছরে ৬ বার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। দফায় দফায় দাম বাড়ালেও লোকসান কমছে না, বরং বাড়ছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন মূল্য ৬ টাকা ২৪ পয়সা। বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করা হচ্ছিল প্রতি ইউনিট ৪ টাকা ৬৭ পয়সা করে। গত বৃহস্পতিবার দাম বাড়ানোর পর এই বিক্রয় মূল্য হয়েছে প্রায় ৪ টাকা ৯০ পয়সা। এই হিসাবে সরকার উৎপাদন মূল্যের চেয়ে কম দামে বিক্রি করছে ঠিকই। কিন্তু জনগণ কত দামে বিদ্যুৎ কিনছে? এর আগে যখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়, তখন ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় দাম ছিল ৬ টাকা ১৫ পয়সা। প্রতি ইউনিট ১৮ পয়সা হারে দাম বাড়িয়েছে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। ফলে চলতি ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় দাম পড়ে ৬ টাকা ৩৩ পয়সা, যা বর্তমান উৎপাদন খরচের (৬ টাকা ২৪ পয়সা) তুলনায় বেশি। এই যে ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম, তারা যে সরকারের উৎপাদন খরচের চেয়ে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনেন। সরকার উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করছে বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে। কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে জনগণ কিনছে সরকারের উৎপাদন খরচের চেয়ে বেশি দামে। অর্থাৎ জনগণ বিদ্যুতের উচ্চ দামই দিচ্ছে। কিন্তু সরকার পাচ্ছে না। এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের উপায় কি শুধুই দাম বাড়িয়ে যাওয়া। সরকার ২০০৯-১০ সাল থেকে বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নের যে পরিকল্পনা করে এগোচ্ছে, তাতে গত ২০১৩-১৪ সাল থেকেই বিদ্যুতের উৎপাদন মূল্য ও ভোক্তা পর্যায়ে দাম কমে আসার কথা ছিল। তা হয়নি। কারণ, সরকার পরিকল্পনা অনুযায়ী কম দামের বিদ্যুৎ (বিশেষ করে কয়লাভিত্তিক) উৎপাদনে সফল হতে পারেনি। এই ব্যর্থতার যেমন একাধিক কারণ আছে, তেমনি সরকারের সামনে নতুন সুযোগও আছে। সবচেয়ে বড় সুযোগ আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের অব্যাহত মূল্যহ্রাস। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার শুধু ফার্নেস তেলের দাম বাজারদর অনুযায়ী নির্ধারণ করলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় সাড়ে ৫ টাকার কাছাকাছি চলে আসবে। সরকার তেলের দাম বেশি রেখে মুনাফা করবে। আবার বিদ্যুতের দামও বাড়াবে, এটা ন্যায্য কোনো ব্যবস্থা হতে পারে না। সরকার যখন দেশের সংকটজনক বিদ্যুৎ পরিস্থিতি মোকাবেলায় তেলচালিত ভাড়াভিত্তিক ও দ্রæত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করেছে, তখন জনগণ বিদ্যুতের বাড়তি দামও দিয়েছে। এখনো দিচ্ছে। গত কয়েক বছরে বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতিতে সরকারের কার্যক্রমে জনগণ খুশি। এত দিনে তাদের মধ্যে এই বিশ্বাসও জন্মেছে যে, বর্তমান সরকার আরও অনেক বিষয়ের মতোই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকেও এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। দেশে-বিদেশে যারা জ্বালানি তেলের দরদাম, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে কাজ করেন, তাদের সবারই পূর্বাভাস হচ্ছেন, ২০২০ সাল পর্যন্ত তেলের দাম সাময়িক ওঠানামার মধ্যে নিম্নমুখীই থাকবে। কাজেই হঠাৎ করে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও অমূলক। কথা হচ্ছে যে, লোকসান নেই, ভর্তুকিও নেই, তারপরও দফায় দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। মনে হচ্ছে যে, সরকার জনগণের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েই যেন দাম বাড়াচ্ছে। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিতে নি¤œ-মধ্যবিত্তদের এখন রক্ত ঝরতে শুরু করেছে। পরিবহন ভাড়া, বাসা ভাড়া থেকে শুরু করে জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়েই চলছে।
লেখক : সাংবাদিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।