Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ০২ জুলাই ২০২৪, ১৮ আষাঢ় ১৪৩১, ২৫ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

ডাক্তারি পেশায় কমিশন বাণিজ্য

| প্রকাশের সময় : ৭ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মো. তোফাজ্জল বিন আমীন : সুখ এবং দুঃখ মানুষের জীবন সাথী। সুখের পরশ যেমন মানুষকে আনন্দের অনুভূতি জোগায় তেমনি দুঃখের বার্তাও কষ্টের অনুভ‚তিকে নাড়া দেয়। চাওয়া-পাওয়ার এই পৃথিবীতে সব মানুষই অনন্তকাল বেঁচে থাকার আকাক্সক্ষা করে। কিন্তু ব্যাধি, জরা, মৃত্যু এই তিন সহচরের কাছ থেকে কেউ রেহাই পায় না। পরিবার, সমাজ থেকে ভালো আচরণের যে শিক্ষা তা আমাদের মানবিক গুণাবলীকে পরিপুষ্ট করতে পারছে না। এই নিবন্ধন ডাক্তারি পেশাকে নিয়ে। তবে কোন পেশাকে ছোট কিংবা বড় করা বিবেচ্য বিষয় নয়! যা সত্য বলে প্রতিয়মান হয়েছে তা আলোচনা করাই নিবন্ধনের উদ্দেশ্য। ডাক্তারি পেশা এক মহান পেশা। ইচ্ছে করলেই কেউ ডাক্তারি পেশায় আসতে পারে না। মহান আরশের অধিপতি যাকে ডাক্তার হিসেবে কবুল করে নেন তিনি কেবল একজন ভালো মানের ডাক্তার হতে পারেন। একজন ডাক্তারের একটু ভালো ব্যবহারে অসুস্থ মানুষও ভালো হয়ে যায়। আমরা যে সময়ে বসবাস করছি সে সময়টা অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে নিষ্ঠুর ও মায়া, মমতাহীন। একজন মানুষ যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন অনেকটা বাধ্য হয়ে ডাক্তারের নিকট যায়। দেশের সন্তানতুল্য প্রতিটি নাগরিকের চিকিৎসা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্যতম হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। আমাদের সংবিধানে এ অধিকারকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তারপরেও প্রতিনিয়ত ডাক্তারদের স্বেচ্ছাচারিতার সংবাদ পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হচ্ছে।
একজন চিকিৎসকের ভালো আচরণ, সুপরামর্শ অনেক মুমূর্ষু রোগীর জীবনকে সুন্দর করে দিতে পারে। দেশের মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত থাকে। ওইসব মেধাবী চিকিৎসকেরা অন্য দশজন মানুষ থেকে আলাদা নয়, এটা সত্য। তবে তাঁদের কাছ থেকে জাতি অনেক কিছু আশা করে। এই বিষয়টি তাদের অনুধান করা প্রয়োজন। সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের বাইরে প্রাকটিস করার নিষেধাজ্ঞা একবার জারি হয়েছিল। কিন্তু পরে তা আবার প্রত্যাহার করা হয়। একজন ডাক্তার যদি সেবার মনমানসিকতা নিয়ে রোগী দেখেন তাহলে কেবল নীতিবোধ জাগ্রত হবে বিষয়টি এমন নয়, দেশের হাজারো মানুষের আস্থার জায়গাটি তারা অর্জন করতে পারবেন। আর তখন মানুষ চিকিৎসাসেবা নিতে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করবে না। একজন চিকিৎসক তৈরি করতে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ বিনিয়োগ হয়। জনগণের করের টাকায় হাসপাতালের ব্যয়ভার ও চিকিৎসকের বেতন মেটানো হয়। একজন অভিভাবকের স্বপ্ন, সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা থেকে একজন চিকিৎসকের সৃষ্টি হয় এটা চিকিৎসকদের মনে রাখা প্রয়োজন। গত চার দশকে দেশে চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি হলেও তাতে আত্মতৃপ্তি লাভের সুযোগ নেই। এখনও অনেকে তাদের পেশাকে মানবিক হিসেবে গ্রহণ করছে বলে মনে হয় না। স্বাস্থ্যসেবা প্রসারের জন্য সরকার যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, চিকিৎসকদের কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকাসহ অন্যান্য কারণে তার সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে না। এতে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দরিদ্ররা। সমাজের বিত্তবানরা অনেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাড়ি দেয়। কিন্তু দরিদ্রদের সরকারি হাসপাতালের বিকল্প নেই। সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রই তাদের একমাত্র ভরসা। এ কথা সত্য, চিকিৎসকরা ইচ্ছে করলেও সবার চাহিদা মেটাতে পারবেন না। তবে অসাধ্য সাধনের উপায়ও তাদের হাতে রয়েছে। তারা ইচ্ছে করলে দরদি হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন। কথা ও ব্যবহার দিয়ে কারও মনে আশার আলো জ্বালিয়ে দিতে পারেন। যিনি এটা করবেন তার ক্ষতি নেই। কিন্তু যার উদ্দেশ্যে করবেন তার জীবন হয়ে উঠতে পারে সুখময়। একজন মানুষকে চিকিৎসক হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে দেশের সাধারণ মানুষের অবদান অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
একটা সময় তো এমন ছিল ডাক্তার শব্দটি কেউ উচ্চারণ করলে সম্মান দেখাতে মাথা নুইয়ে যেত। এখন আর তেমনটা দেখা যায় না। ওই সম্মানটা একশ্রেণীর নীতিহীন লোভী ডাক্তার নষ্ট করেছেন। ডাক্তারের ভিজিট নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তোলেন। এমনকি কখনও কখনও কসাইয়ের সাথে ডাক্তারদের তুলনা করা হয় যা মোটেও কাম্য নয়। তবে এটাও ঠিক, অনেক ডাক্তারই রোগী দেখার ফি লাগামহীনভাবে বাড়িয়ে নিচ্ছেন। রাজধানীর প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের ফি হিসেবে একজন রোগীকে ১০০০ হাজার টাকা বা তার বেশি দিতে হচ্ছে। রাজধানী ঢাকার কথা না হয় বাদ-ই দিলাম, ঢাকার বাইরেও অনেক চিকিৎসকই এখন ৭০০ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত ফি নেন। সরকারের পক্ষ থেকে চিকিৎসকদের জন্য রোগী দেখার ফির কোনো হার নির্ধারণ করে না দেয়ায় যে যার খুশিমতো ফি নিয়ে বাণিজ্য করছেন। সব ডাক্তাররাই খারাপ এটি আমি বলছি না। তবে অনেকে সেবার নামে সাধারণ রোগীদের কাছ থেকে টাকা কেড়ে নিচ্ছেন। একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার প্রতিদিন কম করে হলেও ৪০-৫০ জন রোগী দেখেন। কেউ কেউ আরো বেশি রোগীও দেখেন। ফলে দিনে কেবল রোগীর ফি থেকেই তাঁদের আয় হয় ৪০-৫০ হাজার টাকা। এর বাইরে ল্যাবরেটরি, প্যাথলজি, ওষুধ কোম্পানি, হাসপাতালের কমিশনসহ নানা মাধ্যমে আসে আরো টাকা। এমনকি নির্দিষ্ট ক্লিনিকে টেস্ট করানোর জন্য রোগীদের জিম্মি করা হয়ে থাকে। প্রাইভেট প্র্যাকটিসের আড়ালে তাঁরা এক ধরনের টাকার মেশিনে পরিণত হয়ে ঠেছেন। চিকিৎসকদের এই প্রবণতা বন্ধ করা না গেলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় সেবাব্রত বা মানবিকতা বলে কিছুই থাকবে না।
আমার পরিচিত একজন একটি নামকরা ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেন। তার চাকরির সুবাদে ডাক্তার সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য পেলাম যা পাঠকদের সাথে শেয়ার করা প্রয়োজন। তার ভাষ্যমতে, বাংলাদেশের প্রায় সকল কোম্পানীই ডাক্তারদের গিফট দিয়ে স্বভাব নষ্ট করে দিচ্ছে। যে কারণে একশ্রেণীর ডাক্তারও বিনা প্রয়োজনে অযথা ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লিখছেন। তিনি আরো বলেছেন, ডাক্তারদের কমিশন কিংবা গিফট দেয় না এমন ওষুধ কোম্পানী খুঁজে পাওয়া মেলা ভার। ডাক্তারদের অধঃপতনের ইতিহাস লিখলে একটি বই রচনা হয়ে যাবে, তবু লেখা শেষ হবে না। এক শ্রেণীর ডাক্তারকে ওষুধ কোম্পানীগুলো টাকার বিনিময়ে গোলাম বানিয়ে নিয়েছেন। ওষুধ কোম্পানীগুলো নগদ টাকা থেকে শুরু করে এসি, ফ্রিজ, ল্যাপটপ, বিদেশ ভ্রমণের টাকা পর্যন্ত দিয়ে থাকে। অনেক ওষুধ কোম্পানী মাসিক ভিত্তিতে ডাক্তারদেরকে কিনে নিয়েছেন। যে কারণে ঐ সব ডাক্তার নিদিষ্ট কোম্পানী ব্যতীত অন্য কোম্পানীর ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লেখেন না। ওষুধ কোম্পানী যদি ভালো মানের ওষুধ তৈরি করতো তাহলে ডাক্তারদের কমিশন দিয়ে ওষুধের নাম লেখানোর প্রয়োজন হতো না। ওষুধের দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে যাওয়ার পেছনে এটিও একটি কারণ যে, কোটি কোটি টাকা ডাক্তারদের পেছনে ব্যয় করতে হচ্ছে শুধুমাত্র রোগীর প্রেসক্রিপশনের মধ্যে ওষুধ লেখার জন্যে। ওষুধ কোম্পানীগুলো ডাক্তারদের পেছনে যে টাকা ব্যয় করে তা যদি উৎপাদনে ব্যয় করত তাহলে ওষুধের দাম লাগামহীনভাবে বাড়তো না। এই বিষয়টি রাষ্ট্রের ভেবে দেখা প্রয়োজন। যে ডাক্তার বিনা প্রয়োজনে অযথা টেস্ট আর ওষুধ লেখেন আর তা যদি অন্য কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দ্বারা প্রমাণিত হয় তাহলে তাকে আইনের আওতায় এনে শাস্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলে কমিশন বাণিজ্য কমবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন