পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
মোবায়েদুর রহমান : ইতিপূর্বে প্রকাশিত দুইটি কিস্তিতে আমরা একাধিকবার উল্লেখ করেছি যে, আওয়ামী ওলামা লীগ আওয়ামী লীগেরই একটি অঙ্গ সংগঠন। বিগত কয়েক বছর ধরে এই সংগঠনটি বর্তমান সরকারের বিভিন্ন নীতি সম্পর্কে অনবরত বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে চলেছে। তাদের এসব বক্তৃতা বিবৃতি থেকেই দেখা যায় যে, জাতীয় শিক্ষা নীতিতে বিশেষ করে শিক্ষা পাঠ্যক্রমে ইসলামী ভাবাদর্শ সম্পন্ন কবিতা ও রচনাবলি ব্যাপকভাবে বাদ দেয়া হয়েছে এবং বিজাতীয় বিশেষ করে হিন্দু ভাবাদর্শ সম্পন্ন অনেক রচনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া নাম পরিবর্তনের যে হিড়িক চলেছে, সেখানে বিভিন্ন সড়ক ও স্থাপনায় কিছুসংখ্যক আলেম-ওলামা বিশেষ করে বুজুর্গানে দ্বীনের নাম বাদ দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ, গ্রিক পুরানের এক দেবি, যার নাম থেমিস, বাস্তবে কোন দিন যার অস্তিত্ব ছিল না তার মূর্তি সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে বসানো হয়েছে। এইসব কিছু ঘটনায় দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অনুভ‚তিতে আঘাত লেগেছে।
কয়েকটি উদাহরণ
সংখ্যাগুরু মুসলমানের মনে আঘাত লাগা এই ধরনের কয়েকটি ঘটনা আমরা নিচে উল্লেখ করছি। তার আগে একটি কথা বলতে চাই যে, আওয়ামী লীগ তার সুদীর্ঘ জীবনে তার দলিলপত্র, মেনিফেস্টো, স্বাধীনতার ঘোষণা, বিভিন্ন নির্বাচনী ওয়াদা ইত্যাদি কোথাও কোরআন সুন্নাহ বিরোধী অবস্থান নেয়নি। বরং বারবার তারা স্পষ্টভাবে বলেছে যে, কোরআন সুন্নাহ বিরোধী কোন পদক্ষেপ তারা গ্রহণ করবে না।
এখন আমরা আওয়ামী ওলামা লীগ এবং কয়েকটি ইসলামী দলের বক্তৃতা বিবৃতিতে বর্ণিত পাঠ্যক্রমে মুসলিম ভাবধারা বিসর্জন এবং হিন্দু ভাবধারা অন্তর্ভুক্তির কার্যাবলী উল্লেখ করছি।
আওয়ামী ওলামা লীগ এবং হেফাজতে ইসলামের বিবৃতিসমূহে অভিযোগ করা হয়েছে যে, স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে অনেকগুলো ইসলামী বিষয় বাদ দেয়া হয়েছে এবং তার স্থানে হিন্দু দেব-দেবীদের কথা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাদের বিবৃতিতে একটি তালিকা দেয়া হয়েছে, যেখানে কোন কোন জায়গায় ইসলাম ও মুসলমানদের বাদ দেয়া হয়েছে এবং কোন কোন জায়গায় হিন্দুত্ব ঢোকানো হয়েছে।
পাঠ্যপুস্তকে বাংলা বই থেকে যে বিষয়গুলো বাদ দেয়া হয়েছিল সেগুলো হচ্ছে- ১) দ্বিতীয় শ্রেণীতে ‘সবাই মিলে করি কাজ’ শিরোনামে মুসলমানদের শেষ নবীর সংক্ষিপ্ত জীবন চরিত। ২) তৃতীয় শ্রেণীতে ‘খলিফা হযরত আবু বকর’ শিরোনামে একটি সংক্ষিপ্ত জীবন চরিত। ৩) চতুর্থ শ্রেণীতে খলিফা হযরত ওমরের সংক্ষিপ্ত জীবন চরিত । ৪) পঞ্চম শ্রেণীতে ‘বিদায় হজ’ নামক শেষ নবীর সংক্ষিপ্ত জীবন চরিত। ৫) পঞ্চম শ্রেণীতে কাজী কাদের নেওয়াজের লিখিত ‘শিক্ষা গুরুর মর্যাদা’ নামক একটি কবিতা যাতে বাদশাহ আলমগীরের মহত্ব উঠে এসেছে এবং শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে আদব কেমন হওয়া উচিত, তা বর্ণনা করা হয়েছে। ৬) পঞ্চম শ্রেণীতে শহীদ তিতুমীর নামক একটি জীবন চরিত। এ প্রবন্ধটিতে মুসলিম নেতা শহীদ তিতুমীরের ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের বিবরণ উল্লেখ রয়েছে। ৭) ষষ্ঠ শ্রেণীতে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখিত ‘সততার পুরস্কার’ নামক একটি ধর্মীয় শিক্ষণীয় ঘটনা। ৮) ষষ্ঠ শ্রেণীতে মুসলিম দেশ ভ্রমণ কাহিনী ‘নীলনদ আর পিরামিডের দেশ’ নামক মিসর ভ্রমণের ওপর লেখাটি। ৯) ষষ্ঠ শ্রেণীতে মুসলিম সাহিত্যিক কায়কোবাদের লেখা ‘প্রার্থনা’ নামক কবিতাটি । ১০) সপ্তম শ্রেণীতে ‘মরু ভাস্কর’ নামক শেষ নবীর সংক্ষিপ্ত জীবন চরিত। ১১) অষ্টম শ্রেণীতে ‘বাবরের মহত্ব’ নামক কবিতাটি। ১২) অষ্টম শ্রেণীতে বেগম সুফিয়া কামালের লেখা ‘প্রার্থনা’ কবিতা। ১৩) নবম-দশম শ্রেণীতে মধ্যযুগের বাংলা কবি শাহ মুহম্মদ সগীরের লেখা ‘বন্দনা’ নামক ইসলাম ধর্মভিত্তিক কবিতাটি। ১৪) নবম-দশম শ্রেণীতে আরও রয়েছে মধ্যযুগের মুসলিম কবি ‘আলাওল’-এর ধর্মভিত্তিক ‘হামদ’ নামক কবিতাটি। ১৫) নবম-দশম শ্রেণীতে আরো ছিল মধ্যযুগের মুসলিম কবি আব্দুল হাকিমের লেখা ‘বঙ্গবাণী’ কবিতাটি। ১৬) নবম-দশম শ্রেণীতে শিক্ষণীয় লেখা ‘জীবন বিনিময়’ কবিতাটি। কবিতাটি মুঘল বাদশাহ বাবর ও তার পুত্র হুমায়ুনকে নিয়ে লেখা। ১৭) নবম-দশম শ্রেণীতে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা বিখ্যাত ‘উমর ফারুক’ কবিতাটি।
ওপরের বিষয়গুলো বাদ দিয়ে স্কুলের নতুন পাঠ্যবইয়ে নিচের বিষয়গুলো যুক্ত করা হয়েছিল ১) পঞ্চম শ্রেণীতে স্বঘোষিত নাস্তিক হুমায়ুন আজাদ লিখিত ‘বই’ নামক একটি কবিতা, যা মূলত মুসলমানদের ধর্মীয়গ্রন্থ পবিত্র কোরআন বিরোধী কবিতা। ২) ষষ্ঠ শ্রেণীতে ‘বাংলাদেশের হৃদয়’ নামক একটি কবিতা। যেখানে রয়েছে হিন্দুদের ‘দেবী দুর্গা’র প্রশংসা। ৩) ষষ্ঠ শ্রেণীতে ‘লাল গরুটা’ নামক একটি ছোট গল্প যা দিয়ে কোটি কোটি মুসলিম শিক্ষার্থীদের শেখানো হচ্ছিল গরু মায়ের মতো। ৪) ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভারতের হিন্দুদের তীর্থস্থান রাঁচির ভ্রমণ কাহিনী। ৫) সপ্তম শ্রেণী- ‘লালু’ নামক গল্পে পাঁঠাবলির নিয়ম-কানুন। ৬) অষ্টম শ্রেণীতে হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ ‘রামায়ণ’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। ৭) নবম-দশম শ্রেণীতে ‘আমার সন্তান’ নামক একটি কবিতা। কবিতাটি হিন্দুদের ধর্ম সম্পর্কিত ‘মঙ্গল কাব্য’-এর অন্তর্ভুক্ত, যা দেবী অন্নপূর্ণার প্রশংসার ও তার কাছে প্রার্থনাসূচক কবিতা। ৮) নবম-দশম শ্রেণীতে ভারতের পর্যটন স্পট ‘পালমৌ’-এর ভ্রমণ কাহিনী। ৯) নবম-দশম শ্রেণীতে ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ শিরোনামে বাউলদের বিকৃত যৌনাচারের কাহিনী। ১০) নবম-দশম শ্রেণীতে ‘সাকোটা দুলছে’ শিরোনামের কবিতা যেখানে ’৪৭-এর দেশভাগকে হেয় করা হয়েছে, যা দিয়ে কৌশলে ‘দুই বাংলা এক করে দেয়া’। ১১) নবম-দশম শ্রেণীতে ‘সুখের লাগিয়া’ নামক একটি কবিতা, যা হিন্দুদের রাধা-কৃষ্ণের লীলাকীর্তন। ১২) প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে দেয়া হয়েছে ‘নিজেকে জানুন’ নামক যৌন শিক্ষার বই।
পাঠ্যক্রমের সংশোধনী
গত বছরে আওয়ামী ওলামা লীগ এক বিবৃতিতে অভিযোগ করে যে, প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত গল্প ও কবিতার সংখ্যা ১৯৩টি। এর মধ্যে হিন্দু ও নাস্তিকদের লেখার সংখ্যা হলো ১৩৭টি, যা সর্বনিম্ন শতকরা ৫৭ ভাগ থেকে সর্বোচ্চ ৮২ ভাগ প্রাধান্য পেয়েছে। অবশিষ্ট ১৮ থেকে ৪৩ ভাগের মধ্যেও উদ্দেশ্যমূলকভাবে মহানবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম এবং আওলিয়ায়ে ক্বিরামগণের জীবনী অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এই ধরনের আরও অসংখ্য নজির রয়েছে। অবশ্য হেফাজতে ইসলাম, আওয়ামী ওলামা লীগ এবং কয়েকটি ইসলামী দল এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করলে সরকার পাঠ্যক্রম সংশোধন করে। সংশোধনের ফলে মুসলিম ভাবধারার যেসব রচনা বাদ দেয়া হয়েছিল তার কয়েকটিকে পুনর্বহাল করা হয় এবং হিন্দু ভাবধারার কয়েকটি রচনা বাদ দেয়া হয়। এই সংশোধনিতেও বামপন্থীদের গাত্রদাহ হয় এবং তারা এই সংশোধনিকে হেফাজতি কার্যক্রম বলে মনে করে। এই সংশোধনীর জন্য আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
নাম বদলের পালা
বিভিন্ন রাস্তাঘাট এবং স্থাপনার নাম বদল সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় অতি সম্প্রতি অনেক লেখা-লেখি হয়েছে। তাই এগুলোর পুনরাবৃত্তি করতে যাচ্ছি না। ইকবাল হলের নাম পরিবর্তন করে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল রাখা হয়েছে। তখনকার একটি উত্তপ্ত পরিবেশে সেটি করা হয়েছিল বলে সে সম্পর্কে কোন মন্তব্য করছি না। যদি পাকিস্তান বিদ্বেষ থেকে এই নাম পরিবর্তন হয়ে থাকে তাহলে সেখানে সঙ্গতভাবেই একটি প্রশ্ন ওঠে। মহাকবি ইকবাল তো মৃত্যুবরণ করেছেন ১৯৩৮ সালে। আর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৭ সালে। সুতরাং ইকবালের ওপর বাংলাদেশের আক্রোশ থাকার কোন কারণ নেই।
১৯০ বছর ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের পর দেশ স্বাধীন হলে নানা সময় ঢাকায় ইংরেজ লর্ডদের নামে রাখা রাস্তার নাম কেউ বদলে ফেলেনি। এখনো মিন্টো রোড, হেয়ার রোড, জনসন রোড, টয়েনবি সার্কুলার রোড, কার্জন হল, জুবিলি রোড, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এদেশে রয়ে গেছে। পাকিস্তানে এত তিক্ততার পরও সোহরাওয়ার্দী আর শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এভিনিউ রয়ে গেছে। উগ্র সাম্প্রদায়িক দল বিজেপি ভারতের ক্ষমতায় আসার পর কিছু পরিবর্তন ছাড়া অতীতে ভারতেও এ ধরনের সহনশীলতার পরিবেশ বজায় ছিল।
রুপচান লেন, হরিচরণ রায় রোড, সতীশ সরকার রোড, ভজহরি সাহা স্ট্রিট, ভগবতী ব্যনার্জি রোড, হৃষিকেশ দাস রোড, কে এম দাস লেন ইত্যাদি সে যুগের রাখা নাম। কিন্তু ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক চিন্তায় গত ১০০ বছরেও তো কোন মুসলমান এসব পরিবর্তনের কথা চিন্তা করেনি। কিন্তু হাফেজ্জি হুজুরের নামের সড়কটির নাম পরিবর্তন করা হল কেন?
রজার কোহেনের সতর্ক বাণী
“নিউইয়র্ক টাইমসে” কয়েকদিন আগে একটি রাজনৈতিক ভাষ্য প্রকাশিত হয়েছে। লেখাটির শিরোনাম “Unmaking of Europe has begun”, লেখক রজার কোহেন। তিনি বলেন, যেখানে সেখানে শত্রু আবিষ্কার, যেমন জনগণের শত্রু, আমেরিকার শত্রু, ইত্যাদি আবিষ্কার সেই দেশের সরকার এবং জনগণের জন্য মঙ্গলজনক নয়। একটি মতাদর্শকে বা একটি ধর্মীয় অনুভ‚তিকে যদি ক্রমাগত দাবিয়ে রাখা হয়, তাহলে জনগণের অসন্তোষ এবং ক্রোধ পুঞ্জীভূত হতে থাকে। চিরদিন এটি পুঞ্জীভূত থাকে না। এক সময় তার সশব্দ বিস্ফোরণ ঘটে। কামাল আতাতুর্ক জুম্মার খুতবা নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন। পারলেন কি? আতাতুর্কের তুরস্ক আর এরদোগানের তুরস্ক এক নয়। বাংলাদেশেও কেউ কেউ খুতবা নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশের মহল বিশেষকে এই সতর্ক, এসব ঘটনা মাথায় রাখার অনুরোধ করছি। (সমাপ্ত)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।