ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
এ বি সিদ্দিক : একজন বাস বা ট্রাকচালক যত খুশি তত মানুষ মারবে, তার কোনো বিচার হতে পারবে না। নৌ-পরিবহন মন্ত্রীর ভাষায়, চালকরা গুরু-ছাগল চিনলেই হলো। তা হলে কি গুরু-ছাগল মারলে বিচার হবে? সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিনিয়ত মানুষ মরছে আর পঙ্গুত্ববরণ করছে। কত পরিবার পথে বসছে। যদি মালিক-শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা নেয়া হয়, তখনই ধর্মঘট। গোটা দেশ অচল করে দেয়া হয়। দেশটা কি মগের মুল্লুক? অপরদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিআরটিএ দিচ্ছে ভুয়া লাইসেন্স। এর সংখ্যা ১৯ লাখের বেশি। বা! কি চমৎকার এই বাংলাদেশ। ২০১৫ সালের ৩ আগস্ট হাইকোর্ট থেকে ভুয়া লাইসেন্স জব্দ করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। সেই সাথে যেসব চালক এসব ভুয়া লাইসেন্স ধারণ ও ব্যবহার করছেন তাদের বিরুদ্ধেও যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। এ ছাড়া সারা দেশে ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বিআরটিএ চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের ডিভিশন বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই অন্তর্র্বর্তীকালীন আদেশ দিয়েছিলেন। এ আদেশ বাস্তবায়ন সংক্রান্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন এক মাসের মধ্যে আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছিল। আদালত বলেছেন, ১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশ অনুযায়ী চলাচলের সুযোগ না থাকার পরও যেসব বাহন ‘মোটরযান’ হিসেবে চলছে, সেগুলো বন্ধের নির্দেশ দেয়া হলো। ‘রোড অ্যাকসিডেন্ট-নাইনটিন লাখ ফেইক ড্রাইভারস রুল দ্যা হাইওয়েস’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল একটি ইংরেজি দৈনিকে। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ২০১৫ সালের জুন মাসের তথ্যের বরাত দিয়ে বলা হয়, দেশে ১৮ লাখ ৭৭ হাজার চালকের কাছে বৈধ লাইসেন্স নেই, যার ফলে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে। একই ১৫ জুলাই থেকে ২১ জুলাইয়ের মধ্যেই ১৫৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৯১ জন মারা গেছে। এসব দুর্ঘটনার ৬০ শতাংশই ঘটেছিল চালকের দোষে’। প্রকাশিত এই প্রতিবেদন আমলে নিয়ে হাইকোর্ট অন্তর্র্বর্তীকালীন আদেশ ও রুল জারি করেছিলেন। রুলে প্রায় ১৯ লাখ ‘ভুয়া’ ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যবহার করে যানবাহন চলাচলের বিষয়টি অবগত হয়েও কোন পদক্ষেপ না নেয়ার ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন আদালত। যোগাযোগ সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের আইজি এবং বিআরটিএ চেয়ারম্যানকে চার সপ্তাহের মধ্যে এই রুলের জবাব দাখিল করতে বলা হয়েছিল। বিআরটিএ সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে জাতীয় মহাসড়ক রয়েছে ৩ হাজার ৫৪৪.০৬ কিলোমিটার (কিমি), আঞ্চলিক মহাসড়ক ৪ হাজার ২৭৮.০৭ কিমি এবং জেলা সড়ক ১৩ হাজার ২৪৭.৭৯ কিমি। মোট সড়কের দৈর্ঘ্য ২০ হাজার ৯৪৭.৭৩ কিমি। সারা দেশের এসব সড়কে চলাচল করে ২৪ লাখ ৯১ হাজার ২৯৯টি বিভিন্ন আকারের মোটরযান (৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত)। এসব গাড়ির জন্য লাইসেন্সধারী ড্রাইভারের সংখ্যা ১৫ লাখ ৪৮ হাজার ৪৬৫ জন। অর্থাৎ দেশে ৯ লাখ ৪২ হাজার ৮৩৪টি মোটরযান চালায় ভুয়া ড্রাইভার, যাদের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। সংস্থাটির হিসেবে, খোদ ঢাকাতেই লাইসেন্সবিহীন চালকের সংখ্যা তিন লাখের বেশি। এ ছাড়া সারা দেশে লাইসেন্সধারী ১৫ লাখ গাড়িচালকের লাইসেন্সও পুরোপুরি বৈধ নয়। জানা গেছে, দেশে আধুনিক বা মানসম্মত কোনো ড্রাইভিং স্কুল না থাকায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা নিম্নমানের ড্রাইভিং স্কুল বা সিনিয়র ড্রাইভারদের কাছে কোনো প্রকার চালনা শেখে। স্বল্প সময়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেই তারা গাড়ি চালনা পেশায় যোগ দেয়। এ ছাড়া দীর্ঘদিন গাড়ির হেলপার থেকে পরে গাড়ির ড্রাইভার হয়েছেন অসংখ্য বাস ও ট্রাক ড্রাইভার। এসব হিসাব আমলে নিলে দেশে দক্ষ এবং বৈধ চালকের সংখ্যা ৫ লাখের বেশি হবে না বলে মন্তব্য করছেন বিশেষজ্ঞরা। সে হিসাবে দেশে ২০ লাখের বেশি মোটরযান চলে অদক্ষ চালকের হাতে।
সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ আহত বা নিহত হলে চালক কিংবা দায়ী ব্যক্তির কী ধরনের শাস্তি হবে, সে সম্পর্কিত কোনো বিধান না রেখেই সড়ক পরিবহন আইনের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। আইনে সড়ক দুর্ঘটনা কী ধরনের অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, তা-ও বলা হয়নি। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় বলেছে, ফৌজদারি দন্ডবিধিতে বিষয়টি থাকায় আইনে আর আলাদা করে যুক্ত করা হয়নি। নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকারীরা খসড়া আইনটিকে ‘দুর্বল’ মনে করছেন। তবে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এমন আইন করা যাবে, যাতে দোষী মালিক ও চালক উভয়েরই শাস্তি হবে। বতর্মানে যে খসড়াটি রয়েছে, তা চূড়ান্ত করার সময় প্রয়োজনীয় সব বিষয় যুক্ত করা হবে। খসড়া আইনে বলা হয়েছে, ১৮ বছরের নিচে কেউ গাড়ি চালাতে পারবে না। জেব্রা ক্রসিং বা ফুটওভারব্রিজ ছাড়া পারাপার করলে দুই হাজার টাকা অর্থদন্ড হবে। নীরব এলাকা অতিক্রমের সময় হর্ন বাজালে বা উচ্চমাত্রার কোনো শব্দ করলে এক মাসের কারাদন্ড বা এক হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ড হবে। নিয়োগপত্র ছাড়া মোটরযানের চালক হলে বা রাখলে এক বছরের কারাদন্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড হবে। আইনে চালকদের জন্য কর্মঘণ্টা ও বিশ্রামের কথাও বলা হয়েছে। খসড়া সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৬ গত ২৪ জানুয়ারি ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে। ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই আইন নিয়ে মতামত দেওয়া যাবে। ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৫-এর খসড়ায় মোটরযান চালিয়ে অপর ব্যক্তির মৃত্যু ঘটালে তিন থেকে সাত বছর পর্যন্ত শাস্তির বিধান ছিল। এ ছাড়া নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীকে পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ এবং চালকের দোষসূচক পয়েন্ট কাটার প্রস্তাবও করা হয়েছিল। আর কাউকে আহত করলে পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল এবং আহত ব্যক্তিকে এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের বিধান ছিল। তবে নতুন আইনে এগুলো নেই। অভিযোগ উঠেছে, গাড়ির মালিক ও চালকদের চাপে এগুলো বাদ পড়েছে। এর আগে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গাড়িচালকদের বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ৩০২ ধারায় মামলা না করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ৩০২ ধারায় সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ড। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ নিহত হলে মামলা হবে ৩০৪(খ) ধারায়। এই ধারায় সর্বোচ্চ সাজা তিন বছরের কারাদন্ড। ২০১১ সালে ‘সড়ক পরিবহন ও ট্রাফিক আইন’ নামে খসড়ায় ২২টি অধ্যায় ও ৩৭২টি ধারা ছিল। ২০১৩ সালে গঠিত কমিটি তা কমিয়ে ১৫ অধ্যায় ও ২৪২টি ধারায় চ‚ড়ান্ত করে। ২০১৫ সালের খসড়ায় ২২টি অধ্যায় ও ৩৭২টি ধারা ছিল। তবে সর্বশেষ খসড়ায় আইনটিকে ১৩টি অধ্যায় ও ৬৩ ধারায় নামিয়ে আনা হয়েছে।
আইনের তফসিলে যে ৩১টি অপরাধ উল্লেখ করা হয়েছে, তাতে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে ড্রাইভিং লাইসেন্স জালিয়াতি নিয়ে। এতে বলা হয়েছে, নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ বাদে অন্য কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রস্তুত বা সংরক্ষণ করলে পাঁচ বছরের কারাদন্ড বা দুই লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ড হবে। আর ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া কেউ গাড়ি চালালে ছয় মাসের কারাদন্ড হবে। আগের মতো এই আইনেও আছে, লাইসেন্স ছাড়া যানবাহন চালানো নিষিদ্ধ। ১৮ বছর না হলে কেউ লাইসেন্স পাবেন না। তবে ভারী যানবাহন চালানোর ন্যূনতম বয়স ২১ বছর। আর পেশাদার চালকের ক্ষেত্রে ৬০ এবং অপেশাদার চালকের ক্ষেত্রে ৬৫ বছরের অধিক বয়সী ব্যক্তি লাইসেন্স নিতে পারবেন না। লাইসেন্স প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বয়স নির্ধারণ করা হলেও শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। গণপরিবহনে লাইসেন্স ছাড়া কন্ডাক্টর হলে বা নিয়োগ করলে তিন মাসের জেল বা তিন হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড। ট্রাফিক আইন বা সংকেত না মানলে অনধিক ছয় মাসের কারাদন্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড হবে। কোনো মোটরযান অতিরিক্ত ওজন বহন করলে অনধিক এক বছরের কারাদন্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা হবে। নির্ধারিত এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও গাড়ি পার্ক খসড়ার ৪২ ধারায় মোটরযান চলাচলের জন্য ১০টি সাধারণ নির্দেশাবলি রয়েছে। কেউ মদ্যপান বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে গাড়ি চালাতে পারবেন না। সিটবেল্ট বাঁধা ছাড়া গাড়ি চালানো যাবে না। আইনের ৪৯ ধারায় বলা হয়েছে, সব অপরাধই জামিনযোগ্য ও আপসযোগ্য।
লেখক : সাংবাদিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।