Inqilab Logo

বুধবার ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার এখনো কুলকিনারা হয়নি

| প্রকাশের সময় : ৫ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সিটিটিসি কর্মকর্তারা বলছেন, এখনো সাত হামলাকারী পলাতক
প্রধান পরিকল্পনাকারী নিয়ে বিভ্রান্তি কাটেনি, অর্থ যোগানদাতারাও ধরাছোঁয়ার বাইরে
স্টাফ রিপোর্টার : রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টের জঙ্গি হামলা এখনো কোনো কুলকিনারা করতে পারেনি তদন্তকারীরা। ওই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী কে বা কার এ নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। হামলায় কতজন অংশ নিয়েছিল এবং হামলাকারীদের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি ছিল,  এর মোটিভ কিংবা রহস্য এখন পর্যন্ত উদঘাটন করতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। অর্থের যোগানদাতা নিয়ে রয়েছে বির্তক। এ নিয়ে র‌্যাব-পুলিশের বক্তব্যের মধ্যে রয়েছে নানা গড়মিল। হামলাকারী জঙ্গিদের এখন পর্যন্ত কতজন পালাতক রয়েছে এবং এ ঘটনার নেপথ্যে কারা কারা জড়িত তাও আজ পর্যন্ত স্পষ্ট নয়।  হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে ওই জঙ্গি হামলার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৫ জনের সম্পৃক্ততার বিষয়ে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে। এদের মধ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত সাতজন ‘জঙ্গি’ এখনো পলাতক রয়েছে। এরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ হামলার সঙ্গে জড়িত বলে তদন্তকারী সংস্থা দাবি করছে। তাদের খুঁজছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। হামলার ঘটনায় জড়িত, এমন আরো সাতজন পলাতক রয়েছেন। এরা হলেনÑ সোহেল মাহফুজ, রাশেদ ওরফে র‌্যাশ, চকলেট, ছোট মিজান, মামুন, মুসা ও একজন চিকিৎসক।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্র্যান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম  বলেছেন, হলি আর্টিজানের ঘটনার তদন্ত অনেক অগ্রগতি হয়েছে। সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকজনের সম্পৃক্ততার বিষয়ে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। পুলিশের অভিযানে কয়েকজন নিহত হয়েছে। অনেকে গ্রেফতার হয়েছে। বাকিরা পলাতক রয়েছে। তবে এর বাইরেও আরো কেউ কেউ থাকতে পারে। আমরা তদন্ত করছি, আরো নতুন তথ্য পাচ্ছি।
সর্বশেষ গতশুক্রবার ২ মার্চ নব্য জেএমবির ‘আধ্যাত্মিক নেতা’ মাওলানা আবুল কাশেম ওরফে বড় হুজুরকে গ্রেফতার করে সিটি ইউনিট। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছে, আবুল কাসেম ওরফে বড় হুজুরই ওই হামলার প্রধান পরিকল্পনাকারী ও প্রধান নেতা। অন্য দিকে এর আগে র‌্যাব বলেছিল, সারোয়ার জাহান প্রধান পরিকল্পনাকারী। পুলিশ বলছে, বড় হুজুর তথা আবুল কাশেমকে গত বৃহস্পতিবার গ্রেফতার করা হয়েছে। আবার আবুল কাসেম আদালতকে জানিয়েছেন, আট মাস আগে তাকে আটক করা হয়েছে। এসব কারণে প্রধান প্ররিকল্পনাকারী কে এ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আবুল কাশেমের  সঙ্গে ২০১৫ সালে নব্য জেএমবির সমন্বয়ক তামিম চৌধুরীর বৈঠক হয়। এর আগে ২০১৪ সালে কতিপয় বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা তার সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য দেয়। নব্য জেএমবির প্রধান তামিম চৌধুরী, মারজান, হাতকাটা মাহফুজ, রাজীব গান্ধী ওরফে জাহাঙ্গীরসহ জেএমবির অনেক বড় নেতা এই বড় হুজুরের অনুরক্ত ছিল। ইতোপূর্বে গ্রেফতার হওয়া অনেক সদস্যের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে দীর্ঘদিন ধরে তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছিল। মনগড়া ধর্মীয় মতবাদ দিয়ে নিষিদ্ধ সংগঠন নব্য জেএমবিকে আরো হিংস্র করে তুলেছিলেন তিনি।
তদন্তকারী কর্মকর্তারা দাবি করেছে, জেএমবির গ্রেফতার হওয়া বেশ কয়েকজন নেতা পুলিশকে জানিয়েছিলেন, সংগঠনের দু’-একজন ছাড়া কেউ বড় হুজুরকে দেখেননি। তবে তার নির্দেশেই সকল কর্মকাÐ পরিচালিত হয়। আবুল কাশেমের গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রামে। তিনি দিনাজপুরের রানীর বন্দর এলাকার একটি মাদরাসার প্রিন্সিপাল ছিলেন। নব্য জেএমবির উত্তরাঞ্চলের সামরিক কমান্ডার রাজিব গান্ধী গ্রেফতারের পর তার কাছ থেকে বড় হুজুর সম্পর্কে তথ্য পায় পুলিশ। পরে দিনাজপুরের ওই মাদরাসায় অভিযান চালানো হয়। কিন্তু দেড় বছর আগেই ওই মাদরাসা থেকে পালিয়ে যাওয়ায় সেখান থেকে তাকে গ্রেফতারে ব্যর্থ হয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত বুধবার বনানী থেকে জঙ্গি নেতা বড় মিজান গ্রেফতার হওয়ার পর কাশেমের সন্ধান পাওয়া যায়। গত বৃহস্পতিবার রাতে মিরপুরের পর্বতা এলাকার একটি দোকানের বিকাশ নম্বরে এক ভক্তের পাঠানো ১৫ হাজার টাকা নিতে এসে তিনি গ্রেফতার হন।
কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটি) ইউনিট জানা যায়, হলি আর্টিজানে হামলার সঙ্গে চিহ্নিত জড়িতরা হলেনÑ নিহত নব্য জেএমবির সমন্বয়ক তামিম চৌধুরী, অর্থদাতা সারোয়ার জাহান, তানভীর কাদেরী, নুরুল ইসলাম মারজান, জাহিদুল ইসলাম, তারেক, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সাবিহ মোবাশ্বের, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল, খায়রুল ইসলাম পায়েল, আবদুল্লাহ ও ফরিদুল ইসলাম আকাশ, গ্রেফতার রাজিব গান্ধি, রিগ্যান, বড় মিজান ও আবুল কাশেম, পলাতক সোহেল মাহফুজ, রাশেদ ওরফে র‌্যাশ, চকলেট, ছোট মিজান, মামুন, মুসা ও একজন চিকিৎসক। এ ছাড়াও ওই হামলার পরদিন ২ জুলাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানের আগে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আসা নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমকে প্রথমে আটক করা হয় এবং পরে এ মামলায় তাকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়।
এদের মধ্যে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছর ২ জুলাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো পরিচালিত ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ এ নিহত হয় রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সাবিহ মোবাশ্বের, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম পায়েল। গত বছরের ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ শহরের পাইকপাড়ায় সোয়াট ও সিটি ইউনিটের এক অভিযানে গুলশানে জঙ্গি হামলার সমন্বয়কারী ও অন্যতম ‘পরিকল্পনাকারী’ বাংলাদেশি বংশোদ্ভ‚ত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম চৌধুরী নিহত হন। একই বছর ২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর রূপনগরের একটি বাড়িতে পুলিশের অভিযানে নিহত হয় জঙ্গি নেতা ও সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জাহিদুল ইসলাম ওরফে মুরাদ। গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলায় অংশগ্রহণকারীদের তিনি গাইবান্ধার চরাঞ্চলে প্রশিক্ষণ দিতেন। নারায়ণগঞ্জে তামিম চৌধুরী নিহত হওয়ার পর নব্য জেএমবিতে তার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার কথা ছিল জাহিদুল ইসলামের। ওই বছর ১০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর আজিমপুরের একটি বাড়িতে সিটি ইউনিটের অভিযানে নব্য জেএমবির অন্যতম শীর্ষ নেতা ও আশ্রয়দাতা তানভীর কাদেরী নিজেই গলায় ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন।
এদিকে পুলিশ জানায়, জবানবন্দিতে তানভীর কাদেরীর ছেলে তাহরীম জানায়, পল্লবীর বাসায় থাকা অবস্থায় চকলেট, মুসা আর র‌্যাশ আসত। র‌্যাশ ওই বাসায় চকলেট ও কল্যাণপুরে নিহত আকিফুজ্জামানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। মুসা আঙ্কেলের বয়স ৩৮ বছরের মতো। মুখে দাড়ি, স্বাস্থ্য মাঝারি, দেখতে শ্যামলা। সে শার্ট-প্যান্ট পরে। মুসা আঙ্কেল কখনো একা আসত আবার কখনো চকলেট ও র‌্যাশ সঙ্গে থাকত। জিহাদ ইমান নিয়ে কথা বলত। সিরিয়ায় যুদ্ধের ভিডিও দিত। আমরা তা দেখতাম। দাবিক ম্যাগাজিন পড়তে দিত। এই ম্যাগাজিন কয়েকটা বাংলায় ছিল। চকলেট ও র‌্যাশের কথামতো গত রমজান মাসে তার বাবা বারিধারায় একটি বাসা নেন।
মিজানুর ওরফে ছোট মিজান ওরফে তারা গুলশান হামলাসহ নব্য জেএমবির দেশব্যাপী হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র ও গ্রেনেডের যোগানদাতা। তিনি নব্য জেএমবির মধ্যম সারির নেতা। বড় মিজান ও ছোট মিজানের নির্দেশে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্ত এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ ডেটোনেটর ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ভারতে অবস্থানকারী জঙ্গিদের মাধ্যমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও জয়পুরহাটের সীমান্ত এলাকা দিয়ে এসব বিস্ফোরক দেশে নিয়ে আসত ছোট মিজান, বড় মিজান ও সোহেল মাহফুজ। ছোট মিজান ও বড় মিজানের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এ কারণে খুব সহজেই আন্তঃদেশীয় অপরাধী ও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে তারা নিউ জেএমবির অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংগ্রহ করছে। ভারতে তাদের কাজে সহায়তা করে পালিয়ে থাকা জঙ্গিরা। এই তিন জঙ্গি নিজেরাও অবৈধভাবে ভারতে যাওয়া-আসা করে।
গুলশান হামলার তদন্তে বেরিয়ে এসেছে মামুনুর রশিদ রিপন ওরফে মামুনের নাম। দুর্ধর্ষ এই জঙ্গি ভারতে পালিয়ে গেছে বলে তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। গত বছরও রাজশাহীর বাসিন্দা ও উত্তরাঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে কাজ করা মামুন কয়েকটি ছদ্মনাম নিয়ে পালিয়েছিল। জেএমবির দন্ডিত কয়েকজন নেতা তার আত্মীয়। গুলশান হামলাসহ বেশ কয়েকটি ঘটনায় তার পরোক্ষ সম্পৃক্ততার তথ্য মিলেছে। মিরপুরের কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানের সময় পালিয়ে যাওয়া জঙ্গিদের মধ্যে মামুনের নামও পাওয়া যায়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ