Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নতুন মিত্রের সন্ধানে ব্রিটেন

| প্রকাশের সময় : ৫ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মাহ্মুদ ইলাহী মন্ডল : পার্লামেন্টে ব্রেক্সিট বিল পাস হওয়ায় ব্রিটেন এখন ধীরে ধীরে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। এই ব্রেক্সিট নিয়েই ক্যামেরন সরকারের পতন ঘটে। তেরেসা মে ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু তেরেসা মের ক্ষমতায় আসাটা সহজ হলেও তার সামনে আগামীর পরিস্থিতি অতটা সহজ নয়। তেরেসা নিজেও সম্ভবত বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছেন। ব্রিটেনের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসাটা ইইউ নেতারা ভালোভাবে নেননি। ইইউ চেয়েছিল ব্রিটেন তাদের সঙ্গেই থাকুক। কারণ ইইউ নানা ঝক্কি-ঝামেলার মধ্য দিয়ে টিকে আছে। সংস্থাটি সুন্দরভাবে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখলেও আজ পর্যন্ত কার্যকর কোনো ব্যবস্থা তারা গ্রহণ করতে পারেনি। পারস্পরিক অবিশ্বাস, বাণিজ্যে অসমতা, সদস্য দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি আর এর সাথে ফ্রান্স ও জার্মানির মোড়লীপনার দরুন ক্রমাগত হতাশা ও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। ফ্রান্স ও জার্মানি নিজেদের স্বার্থ ছাড়া সদস্য রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থকে আজ পর্যন্ত পাত্তা দেয়নি। তারা নিজেরা যা ভেবেছে বাকি ২৪টি দেশের ওপর তা চাপিয়ে দিয়েছে। ফলে দুর্বল রাষ্ট্রগুলো তা মেনে নিলেও ব্রিটেন তা মানতে পারেনি। এর ফলে অভিবাসনের দোহাই তুলে ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিষয়টি ব্রিটেনের জন্য ভালো হলেও ইইউ-এর জন্য মোটেই ভালো হয়নি। ভবিষ্যতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন টিকবে কিনা সেই বিষয়টিকে আরো সন্দেহের মধ্যে ফেলে দিয়েছে ব্রেক্সিট। তবে এ কথা সত্য, এসবের জন্য মূলত দায়ী ফ্রান্স ও জার্মানি। তাদের মোড়লীপনাই মূলত ইউরোপীয় ইউনিয়নের আজকের এই দুর্দশার মূল কারণ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কথা বাদ দিলাম। কিন্তু বর্তমানে সমস্যা দাঁড়িয়েছে খোদ ব্রিটেনকে নিয়েই। কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার ফলে ব্রিটেন এই সংস্থাটির সাথে তার সম্পর্ক হারালো। ইইউ আর যাই হোক ব্রিটেনের সাথে যে আর সম্পর্ক রাখবে না এটা একেবারেই পরিষ্কার। ফ্রান্স ও জার্মানি সেটা হতে দেবে না। ফলে ব্রিটেনকে এখন একলা চলো নীতি গ্রহণ করতে হবে। আর তেরেসা মে এখন মূলত তাই করে বেড়াচ্ছেন। ব্রিটেনকে এখন সামনের দিনগুলোতে নতুন নতুন বন্ধুর খোঁজে বের হতে হবে। আর সে বন্ধু যে দেশই হোক না কেন তার সাথেই সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। অতি সম্প্রতি তেরেসা মে তুরস্ক সফর করেছেন। তুরস্কের সাথে সম্পর্ক ভালো না হলেও বাধ্য হয়েই ব্রিটেনকে তার নীতি পাল্টাতে হয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের যা অবস্থা তা ব্রিটেনের জন্য মোটেই সুখকর নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সেখানে একের পর এক যে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে যা ব্রিটেনের জন্য মোটেই সুখকর নয়। বরং একেবারে প্রেস্টিজের ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্র যেখানে ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় ভরসা ছিল, সেখানে তার নিজেরই এমন বেহাল অবস্থা দেখে ব্রিটেনের বৈদেশিক নীতিতে এবার বুঝি বড় ধরনের পরিবর্তন আসন্ন। সামনের দিনগুলোতে সেই বুশ-বেøয়ারের মতো জোট না পাকিয়ে বরং ছোট বন্ধুদের সাথে জোট করাই ব্রিটেনের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এতদিন ব্রিটেন যাদের অবজ্ঞা করেছিল বা পাত্তা দেয়নি আজ তাদেরই সাথে জোট গঠনে মরিয়া হতে দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে যা অবস্থা ডোনাল্ড ট্রাম্পের খপ্পরে পড়ে তাতে তার নেতিবাচক দিকটিও পরোক্ষভাবে ব্রিটেনের ঘাড়ে পড়বে। পুরনো বন্ধু দোষ করলেও তা অপর বন্ধুর ঘাড়ে পড়বে এটাই তো স্বাভাবিক। সে হিসেবে বর্তমানে ব্রিটেন বলা যায়, দুই কুলই হারালো। এক ইউরোপীয় ইউনিয়ন আর দুই যুক্তরাষ্ট্র। সুতরাং ব্রিটেনকে যে বর্তমানে নতুন বন্ধুর খোঁজে থাকতেই হবে সে কথা বলাই বাহুল্য। আর এই কঠিন দায়িত্বটি এসেছে একেবারে নতুন নেতা তেরেসা মের ওপর। তাকে একদিকে ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সামলাতে হবে অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ব্যাপারটিও দেখতে হবে। ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও যে খুব একটা ভালো অবস্থায় তা বলা যাবে না। বিরোধী দল লেবার পার্টির অবস্থা একেবারে করুণ। লেবার পার্টি বর্তমানে সেই নীল কিনকের সময়ের মতো অবস্থা। নীল কিনক পর পর তিনবার নির্বাচন করেও প্রধানমন্ত্রী হতে পারেনি। পরে টনি বেøয়ার লেবার পার্টির হাল ধরার পর লেবাররা ক্ষমতায় আসে। বর্তমানে জেমস করবিনের অবস্থা সেই নীল কিনকের মতো। জেমস করবিন কোনো রকমে লেবার পার্টির হাল ধরলেও খুব একটা সুবিধা করতে পারছেন না। তার নিজেরই অবস্থা এতটাই করুণ যে, তার পক্ষে শক্ত হাতে লেবার পার্টির হাল ধরা একেবারেই অসম্ভব। হয়তোবা এমনও হতে পারে তিনি দলের হাল ছেড়ে দিতে পারেন। সে হিসেবে বলা যায়, তেরেসা মের অবস্থা বোধ হয় একটু ভালো। অতি সম্প্রতি তার কার্যক্রমে তা কিছুটা বোঝা যাচ্ছে। বর্তমানে ব্রিটেনের অর্থনীতির যা অবস্থা তাতে আগামীতে ব্রিটেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আর নেতৃত্ব দিতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। এমনিতে দুর্বল অর্থনীতি তার ওপর বন্ধুহীন অবস্থা। আর তার ওপর সামরিক বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে চীন ও রাশিয়া সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিতে যেভাবে দ্রæত এগোচ্ছে সেখানে ব্রিটেনের অবস্থা বলা যায় একেবারে করুণ। সেই বৃদ্ধ বাঘের মতো। নড়াচড়ার জো নেই। কেউ খাবার দিলেই কেবল খায়। সুতরাং চীন-রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও সামরিক অগ্রগতিতে ব্রিটেন একা কী করতে পারবে। যদিও ব্রিটেনের সাথে এই মুহূর্তে চীন বা রাশিয়ার কোনো দ্ব›দ্ব নেই। বিরোধটা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে। তারপরও পরাশক্তি হিসেবে ব্রিটেনের জন্য তা অস্বস্তিকর। তবে মূল বিষয়টি এই মুহূর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে ব্রেক্সিট নিয়ে। ইইউ থেকে বেরিয়ে আসার পর ব্রিটেন এখন কী করবে? তার অর্থনৈতিক অবস্থা চাঙ্গা করার জন্য কী করা উচিত? নতুন নতুন বন্ধুর খোঁজ অবশ্যই করতে হবে। তেরেসা মে সে পথেই এগোচ্ছেন। এই মুহূর্তে ব্রিটেনের জন্য একটা নতুন বলয় তৈরি করা অত্যন্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। সেক্ষেত্রে আগামীতে আসিয়ান এমনকি উপমহাদেশের দেশগুলোর সাথেও ব্রিটেনের নিবিড় সম্পর্ক আরো নিবিড় হতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রনীতিতে সম্ভবত বড় ধরনের পরিবর্তন আসন্ন। আর তেরেসা মে’কে সেই চ্যালেঞ্জটাই গ্রহণ করতে হবে। অতি সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী মুক্ত বাণিজ্য জোরদারে চীন ও ব্রিটেন সম্মত হয়েছে। তার মানে চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করে ব্রিটেন তার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার সুযোগ নিতে পারে। ভবিষ্যতে চীনের সাথেই হয়তো ব্রিটেনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখা যেতে পারে। যেটা আগে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সাথে। যাই হোক, আগামীতে ব্রিটেনকে যে নতুন করে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে সে কথা বলাইবাহুল্য।
লেখক : কবি ও সাবেক কর্মী, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, আইসিডিডিআরবি, ঢাকা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন