ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
ফাহিম ফিরোজ : শেষ হয়ে গেল মাসব্যাপী একুশে বইমেলা। প্রতিবারের মতো এবারও বইমেলার জমজমাট রূপ নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়া মুখর ছিল। এর কারণও রয়েছে। পৃথিবীর কোথাও মাসব্যাপী বইমেলার কোনো নজির নেই। এটা শুধু আমাদের দেশেই প্রচলিত। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিধম্য এই মেলা তাই সত্যিকার অর্থেই তাৎপর্যম-িত। শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন আড্ডায় বহুদিন ধরেই শুনে আসছি, পশ্চিম বাংলার ভাষা অতিশয় ইংরেজি-হিন্দি দোষে আক্রান্ত এবং খটখটে ও প্রাণহীন। আর আমাদের বাংলা ভাষা বিশুদ্ধ এবং ঝরঝরে। কথাগুলো সত্য। পশ্চিমবাংলা আমাদের প্রতিবেশী, ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য। এ ছাড়া দুই দেশের সম্পর্কও ভালো। তাই তাদের এবং আমাদের সাহিত্য পাঠে নানামুখী সুবিধা রয়েছে। এক সময় বাংলাদেশের পাঠকরা কালকাতার লেখকদের সাহিত্য কর্মের দিকে ঝুঁকে থাকত কিন্তু এখন আর সে অবস্থা নেই বরং উল্টোটা ঘটছে। এক হুমায়ূন আহমেদই ধসিয়ে দিয়ে গেছেন এদেশে পশ্চিমবাংলা লেখকদের একচ্ছত্র আধিপত্যের দেয়াল।
এক সময় কালকাতার দেশ পত্রিকার চিঠিপত্রকে এ দেশের পাঠকরা সাহিত্যের টুকরো বলে ভাবত কিন্তু এখন আর ভাবে না। তারা দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছে, সাহিত্য এবং চিঠিপত্রের ভাষা দুটো দু’রকম। আমাদের দেশে দেশ পত্রিকার মতো জনপ্রিয় শিল্প-সাহিত্য পত্রিকা নেই সত্য কিন্তু ঋদ্ধ সাহিত্য পত্রিকা তো আছে বেশকটি। এসব পত্রিকার মান কোনো অংশেই দেশ পত্রিকার চেয়ে কম নয়। সেই সঙ্গে এসব পত্রপত্রিকায় চিঠি বিভাগ থাকে না বললেই চলে। কোনো কোনো পত্র-পত্রিকায় থাকলেও তা পড়তে গেলে অতিরিক্ত কিছু ভাবনাচিন্তা করতে হয় না। কেন করতে হয় না, এরও একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায়। একটু আগেই বলেছি আমাদের বাংলা ভাষা বিশুদ্ধ এবং ঝরঝরে। চিঠিপত্র থেকে সাহিত্য আমাদের সব কিছুই সুখপাঠ্য এবং সেই সঙ্গে অতি সাহিত্য ভারে জটিল নয়। অনেক আগে দেশের একজন বিখ্যাত সম্পাদকের সঙ্গে আমি তার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। তিনি প্রায়ই আমার মতো উঠতি লেখকদের বলতেন, আমাদের সাহিত্যের ভাষা হবে বোধগম্য এবং বাক্য হবে ছোট, প্রাঞ্জল। যার সঙ্গে কলকাতার সাহিত্যের বড় একটি পার্থক্য রয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে যেসব কবি-লেখক এদেশে মাথা তুলেছেন হুমায়ূন, মিলন তাদের অন্তর্ভুক্ত। এদের লেখা পড়তে কোনো ক্লান্তি লাগে না।
ছোট ছোট বাক্যে নির্মিত এদের সাহিত্য সহজেই পাঠকদের আকৃষ্ট করে। এই স্বচ্ছ এবং সাবলীল পথ সামনে রেখেই স্বাধীনতা-উত্তর আমাদের সাহিত্যের যাত্রা অব্যাহত রয়েছে।
যে পথটি কলকাতা তৈরি করেনি, করার কথাও নয়। ইতিহাসের পেছনে একটু দৃষ্টি দিলে এর সততা খুঁজে পাওয়া যাবে। পলাশী যুদ্ধের প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে কলকাতায় যখন বৃটিশদের অবস্থান বেশ পোক্ত হয়েছে তখনই কলকাতার বাংলা ভাষায় ইংরেজি প্রভাব পড়ে। ধীরে ধীরে মরে গেছে কলকাতার বাংলা। ১৯৪৭-এ বৃটিশরা ভারতবর্ষ ত্যাগ করলেও তাদের অনেক কিছুর সঙ্গে, তাদের ভাষার অংশবিশেষও থেকে যায় এই উপমহাদেশে। আমাদের এখানে ’৫২ ভাষা আন্দোলনের পর বাংলা ভাষা হয়ে ওঠে ইংরেজি-উর্দু মুক্ত, যেটা পশ্চিম বাংলার ক্ষেত্রে হয়নি। সম্প্রতি কলকাতার চিকিৎসা সংক্রান্ত একটি সাপ্তাহিত পত্রিকায় সম্পাদকীয় পড়লাম। প্রায় প্রতি বাক্যে ইংরেজির উপস্থিতি, সম্পাদকীয়তায় মনে হয় ভাবগম্ভীর কোনো প্রবন্ধ। দেশ পত্রিকাতে ও একই অবস্থা এদেশের পাঠকদের তা হৃদয়াঙ্গম করতে কষ্ট হবে। লেখায় ঘনঘন, কমা, সেমিকলন, ব্যবহার করার পাঠের গতি ব্যাহত হয়ম আমাদের এখানে এতটা নয়।
ক’দিন আগে পশ্চিম বাংলায় বিখ্যাত লেখক দেবী রায়ের ‘পূর্ণ দর্শনায় চ’ গ্রন্থটি পড়লাম। সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এটি লেখা ভাষায় কবিতায় রহস্যময়তা রয়েছে। ‘খেলুম’, ‘পেলুম’ এ শ্রেণীর পুরনো শব্দের অধিক ব্যবহারও লক্ষ্য করলাম। কলকাতার বহু লেখকের মধ্যেই এ ধরনের পুরনো শব্দ ব্যবহারের প্রবণতা দেখা যায়। পড়তে অস্বস্তি লাগে। এ গত বছর কলকাতার ২৮ জন কবি-সাহিত্যিক মুন্সীগঞ্জের কুসুমপুরে একটি কবিতা উৎসবে উপস্থিত হয়েছিলেন। এদের মধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়া একজনও ছিলেন। প্রত্যেক লোককে অনুষ্ঠানের নিয়মানুসারে আয়োজিত অঞ্চলে নিয়ে চার লাইনের হাতে লেখা অনুভূতি চাওয়া হলে তারা তা লিখে পূরণ করেন। এক সময় আমাকে তা দেখতে দেওয়া হয়। আমার দৃষ্টি ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করা ওই তরুণের দিকে। পড়তে গিয়ে লক্ষ্য করি তিনটি জায়গায় ভুল বানান। আমি তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললাম, এটা কী করে ঘটল? বেচারা সন্তোষজনক কোনো উত্তর দিতে পারল না। বেশি হতাশ হলাম প্রাইমারী শিক্ষক এটা শুনে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই মাপের কোনো ছাত্র কি এমন চাকরি করে ? এ প্রশ্ন আমার ভিতরে বারবার মোচড় দিতে থাকে। তার কবিতার বই পড়ে ইংরেজি শব্দের ভারে আর ভিতরে ঢুকতে পারলাম না। প্রকাশভঙ্গি দুর্ভোদ্য হলেও ছন্দটা আয়ত্তে। অন্যদের লেখাও একই দূষণে আক্রান্ত। সঙ্গীতের মতো কবিতাও ছন্দনির্ভর। এই ছন্দ কখনো থাকে অন্তমিলে, কখনো ভেতরে। ছন্দ ঠিক হলেই যে কবিতা হবে, তাও নয়, সঙ্গীতের মতো একটা শিল্পীত সুর থাকতে হবে, তা না হলে পাঠক পড়বে কেন? আমাদের সাহিত্য এ ক্ষেত্রে প্রাণময়। একজন দার্শনিক বলেছেন, কোনো কিছুই শেষ নয়, শুরু। পশ্চিমবাংলার সাহিত্য আজ যে তলানিতে এসে পৌঁছেছে। সেই তলানি থেকেই শুরু হতে পারে তাঁর উত্তরণ। এক্ষেত্রে ’৫২-র ভাষা আন্দোলনের ফসল আমাদের ঝরঝরে বিশুদ্ধ বাংলা ভাষা তাদের পথনির্দেশক হতে পারে। আমাদের সাহিত্য পাঠের মধ্যদিয়ে সত্যিকার মুক্তি ঘটতে পারে পশ্চিমবাংলার সাহিত্যের। এ জন্য প্রয়োজন তাদের সদিচ্ছা।
একুশে বইমেলা আমাদের জাতীয় গৌরব এবং সেই সঙ্গে অহংকারেরও। আমাদের সাহিত্যের নির্যাসটুকু এই এক মাস বইমেলার মধ্যেই বেশি পাওয়া যায়। মেলা বাদেও সাহিত্য পত্রিকা এবং অন্যান্য মাধ্যমে পাওয়া যায়। তবে এগুলো বেশির ভাগই বই আকারে ২১ শে বইমেলায় প্রবেশ করে। তাৎপর্যপূর্ণ এই মেলা বাংলাভাষী সকল পাঠককে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।