Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অনিশ্চয়তা পিছু ছাড়ছে না : আবারও জটিলতা মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পে

| প্রকাশের সময় : ২ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সাখাওয়াত হোসেন বাদশা : অনিশ্চয়তা পিছু ছাড়ছে না মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পের। এই প্রকল্পটি নিয়ে আবারও জটিলতা দেখা দিতে পারে। দরপত্র জমাদানকারী একটি কোম্পানির বড় ধরনের আর্থিক সঙ্কটকে ঘিরে এই জটিলতার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এমনটি হলে সরকারের ভিশন-২০২১ এর মধ্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব কি না তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।
জাপানের অর্থায়নে ১২শ’ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারমূলক একটি প্রকল্প। রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার পর নিরাপত্তাজনিত কারণে এর আগে এই প্রকল্পের কয়েক দফা সময় বাড়ানো হয়। এতে করে প্রকল্পের কাজ প্রায় সাত মাস পিছিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে দু’টি কোম্পানি দরপত্র জমা দেয়। এর একটি হচ্ছে মারুবিনি এবং অপর কোম্পানিটি হচ্ছে তোসিবা ও সুমিটোসো জেভি।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ঠিকাদার নিয়োগে কোল পাওয়ার জেনারেশন অব বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল) ২০১৫ সালের ৪ জুন এ প্রকল্পের জন্য প্রি-কোয়ালিফিকেশন (পিকিউ) আহŸান করে। তাতে দু’টি কোম্পানি চূড়ান্ত হয়। প্রি-কোয়ালিফিকেশন মূল্যায়ন কমিটি পরে ওই দু’টি কোম্পানিকে মূল দরপ্রস্তাব দাখিলের আহŸান জানায়। জানা গেছে, ৩১ জানুয়ারি কোম্পানি দু’টি দরপ্রস্তাব জমা দেয়। তবে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে, পিকিউ জমা দেয়া কোম্পানি তোসিবা গত সপ্তাহে তাদের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কোম্পানিটির প্রায় ৪ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ডলার লোকসানের কথা উল্লেখ রয়েছে। আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকেই  কোম্পানিটি লোকসানে রয়েছে। কোম্পানিটি আরো পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০১৭ সালের মার্চে এসে কোম্পানিটির লোকসানের পরিমাণ ৩ হাজার ৮০০ মিলিয়নে পৌঁছবে।
এ অবস্থায় দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি এই প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেয় তার ওপর নির্ভর করছে মাতারবাড়ী প্রকল্পের ভবিষ্যৎ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, মাতারবাড়ী প্রকল্পের প্রি-কোয়ালিফিকেশন শর্তে ছিল দরদাতাদের দীর্ঘমেয়াদি প্রোফিটের বিষয়টি। জানা যায়, তোসিবার বর্তমান আর্থিক দুরবস্থা কাটিয়ে উঠতেই প্রতিষ্ঠানটিকে অনেক সম্পদ বিক্রি করতে হবে। আর্থিক প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যায়, শুধুমাত্র তোসিবার শেয়ারহোল্ডারদের পাওনা রয়েছে ১৪শ’ মিলিয়ন ডলার। কোম্পানিটি বন্ধ করতে হলে এই দায়দেনা পরিশোধ করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
তদুপরি তোসিবার আর্থিক কেলেঙ্কারি ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কোম্পানিটি তাদের আর্থিক প্রতিবেদনে শেয়ারহোল্ডার ও ব্যাংকের কাছে তাদের লোকসানের বিষয়টি গোপন রাখে, যা অনিয়মের পর্যায়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে  লোকসানে পড়া কোম্পানিটি মাতারবাড়ীর কাজ পেলে তা প্রকল্পটির ভবিষ্যতকে অন্ধকারের দিকেই ঠেলে দেবে। বিশেষ করে, ঋণের দায়ে কোম্পানিটি দেউলিয়া হয়ে গেলে ‘অত্যাধুনিক’ এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঝুঁকির কবলে পড়বে। এই প্রকল্পের মোট বিনিয়োগের ২৯ হাজার কোটি টাকা দেবে জাপানের উন্নয়ন সাহায্য সংস্থা জাইকা।
এদিকে জাইকার ক্রয় নীতিমালার প্রাক-যোগ্যতাসম্পন্ন দরদাতাদের দরপত্র মূল্যায়ন পদ্ধতির সেকশন ৩.২-এর ৫ নম্বর ধারায় বলা আছেÑ ‘প্রাক-যোগ্যতাকালীন সময়ে দরদাতাদের দেয়া তথ্য দরপত্র মূল্যায়নকালে যাচাই-বাছাই করতে হবে এবং কোনো দরদাতার যোগ্যতা বা সম্পদ সন্তোষজনকভাবে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য যথেষ্ট না থাকলে সেই দরদাতাকে কাজ দেয়া হবে না।’ কাজেই জাইকার ক্রয় নীতিমালা অনুযায়ী যে কোনো প্রতিষ্ঠানকে কাজ পেতে হলে আর্থিকভাবে শক্তিশালী থাকতে হবে।
অন্যদিকে আর্থিকভাবে লোকসানের কবলে পড়া কোনো কোম্পানি কাজ পেলে এবং পরবর্তীতে লোকসানের কারণে  কোম্পানিটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে অপারগতা প্রকাশ করলে তা সরকারের জন্য দুর্ভোগের কারণ হয়ে দেখা দেবে। যদিও এখন পর্যন্ত কোনো কোম্পানিরই অফিসিয়াল আর্থিক প্রতিবেদন দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির হাতে আসেনি বলে জানা  গেছে।
তবে অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, এরকম একটি জটিল প্রকল্প নিয়ে কেন তাড়াহুড়ো করা হচ্ছে তা অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ। জানা গেছে, গত মঙ্গলবার এই প্রকল্প নিয়ে কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি বৈঠক করেছে। আর গতকাল (বুধবার) এই প্রকল্পের বোর্ড মিটিং হয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির প্রধান মো: নজরুল ইসলাম গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, আমরা দরদাতাদের সার্বিক দিকগুলো তুলে ধরে জাপানের আর্থিক প্রতিষ্ঠান জাইকার মতামতের জন্য পাঠিয়েছি। জাইকা তাদের গাইডলাইন অনুযায়ী আমাদের সিদ্ধান্ত জানাবে।  
গত বছরের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে নিহত বিদেশিদের মধ্যে ৭ জন জাপানের নাগরিক থাকায় নিরাপত্তার কারণে দরপত্র প্রক্রিয়া স্থগিত করেছিল বাংলাদেশ সরকার। ২০১৫ সালের আগস্টে প্রকল্পটি অনুমোদন করে সরকার। এতে কয়লা ওঠা-নামানোর জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গেই একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
প্রকল্পের সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রে ‘আলট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি’ ব্যবহার করা হবে, যাতে কেন্দ্রের কর্মদক্ষতা হবে ৪১ দশমিক ৯ শতাংশ। বর্তমানে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর গড় কর্মদক্ষতা ৩৪ শতাংশের বেশি নয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিপিজিসিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম বলেন, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণকাজ যথাসময়ে শেষ করা হবে। এ নিয়ে সরকার  কোনো ধরনের আপস করবে না। সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী মাতাবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র  থেকেও জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ দেয়া হবে।
সিপিজিসিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরো বলেন, যে  কোনো কোম্পানিরই বছর শেষে লাভ-লোকসান থাকতে পারে। কিন্তু ওই কোম্পানির যদি নিট সম্পদ আর বাৎসরিক টার্নওভার ঠিক থাকে, কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়।
তবে পিডিবি থেকে অবসরে যাওয়া এক কর্মকর্তা স্পেনের কোম্পানি আইসোলেক্স-এর উদাহরণ টেনে বলেন, আর্থিক দুরবস্থার কারণে এই কোম্পানিটি বিবিয়ানা সাউথ প্রজেক্ট ৩৬০ মেগাওয়াট ও সিদ্ধিরগঞ্জে ৩৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দু’টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে পারছে না। বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে এই প্রকল্প দু’টির নির্মাণকাজ মাঝ পথে থেমে যাওয়ায় সরকার আইসোলেক্সকে নির্মাণকাজ কাজ সম্পন্ন করার তাগিদ দেয়।
এ অবস্থায় আইসোলেক্স সরকারের কাছে বিদ্যুৎকেন্দ্র দু’টি নির্মাণে অতিরিক্ত ৩৬০ কোটি টাকা দাবি করেছে। এ নিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়কে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
পিডিবির সাবেক এই কর্মকর্তার মতে, মাতারবাড়ী প্রকল্প নিয়ে যেন এমন দুরবস্থা সৃষ্টি না হয়- সরকারকে সেসব দিক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ