Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আমরা কোথায় আছি!

| প্রকাশের সময় : ১ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবু নোমান : আগে শুনতাম ও জানতাম ঘুষের টাকা আড়ালে হাতবদল হয়। এখন শুনে, আন্দাজ অনুমান করে বুঝতে ও বিশ্বাস করতে হবে না। ডিজিটাল যুগের পুলিশ অনেক স্মার্ট। তাই ঘুষ নিয়ে অপরাধ করতে পারেন কিন্তু টাকা গুনে না নিয়ে বোকামি করতে পারেন না। পুলিশ ঘুষের টাকা প্রকাশ্যে গুনে গুনে নিয়েছে বলে সংবাদ মাধ্যমগুলোর ভাষায় যেন মহা কেলেঙ্কারি হয়ে গেল! হাত তলায় রেখে ঘুষের টাকা নিলে বুঝি তা জায়েজ হয়ে যেত? ওই পুলিশ না গুনে নিলে কিভাবে বুঝবেন তার কত ইনকাম হচ্ছে?
শিশু অপহরণ মামলার আসামি মো. মাসুমের কাছ থেকে অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তা ওবায়দুর রহমান ‘গুনে গুনে টাকা পকেটে নিয়েছেন’। এক বছর আগে সাভারের আশুলিয়ার শেখ শাওন নামে সাড়ে ৪ বছরের এক শিশু নিখোঁজের মামলার তদন্তে এসেছিলেন ওই পুলিশ। এই লেনদেনের ৯ মিনিট ৬ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ হওয়ায় সারা দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়। আসামি মাসুমের অভিযোগ, ‘কলমের খোঁচায় জীবন শেষ করে দেওয়ার’ হুমকি দিয়ে ওবায়দুর রহমান তার কাছ থেকে এ পর্যন্ত ২ লাখ ২২ হাজার টাকা নিয়েছেন। স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেছেন, নিখোঁজ শিশুটিকে খোঁজার কার্যকর কোনো উদ্যোগ তারা সিআইডিকে নিতে দেখেননি। শুধু মাঝেমধ্যে আসামিকে ডেকে টাকা নেন। নিখোঁজ শিশুটি যেন হয়ে উঠেছে সিআইডি কর্মকর্তার ‘টাকার গাছ’ যা থেকে তিনি ফল পাচ্ছেন!
নিখোঁজ শিশু শাওনের বাবা শেখ সুমন বলেছেন, ২০১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর বিকেলে শাওন আশুলিয়ার পূর্ব ধনিয়ার স্টারলিং গার্মেন্টসের পেছনের একটি বালুর মাঠে খেলছিল। পরে তাকে আর পাওয়া যায়নি। মাসুমের পরিবারের দাবি, শাওনের নিখোঁজ সম্পর্কে তারা কিছুই জানেন না। অকারণে মাসুমকে ফাঁসানো হয়েছে। আর এই মামলা সামাল দিতে গিয়ে মাসুম ও তার পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। কিছুদিন পরপর সিআইডি কর্মকর্তা তাকে তাদের কার্যালয়ে ডাকেন আর জীবন শেষ করে দেয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা নেন। তদন্তে এসে আসামির কাছ থেকে টাকা নেওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে গণমাধ্যমের কাছে সিআইডি ঢাকা বিভাগের সহকারী পুলিশ সুপার খোরশেদ আলম বলেছেন, ‘টাকা নেয়া ঠিক হয় নাই। টাকা নিলে ভুল করেছে।’ এটা যদি ভুল হয় তাহলে অপরাধ কোনটা? ভুল আর অন্যায়ের পার্থক্য কি? সিআইডি ঢাকা বিভাগের বিশেষ সুপার আবু সুফিয়ান বলেছেন, ‘কেউ এ ধরনের অভিযোগ করলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে’। তাহলে এই চাক্ষুস ভিডিও ফুটেজের প্রমাণের পরও অভিযোগ না জানালে কোন ব্যবস্থা নেয়া হবে না? আর তদন্তটা করবে কে? ওই সিআইডি কর্মকর্তাতো তদন্ত করতেই গিয়েছিলেন।
মানুষ বিপদে পুলিশের কাছে যাবে কিন্তু এখন ঘটছে উল্টো ঘটনা! পরিস্থিতি এমন যে, মানুষ পুলিশকেই ‘বিপদ’ মনে করে। আজ হয়তো কেউ এই ভিডিও তুলে খুব সাহসের পরিচয় দেখিয়েছেন। কিন্তু কেউ এই ধরনের ভিডিও তুলে জমা দিতে গিয়ে ধরা পড়লে অভিযোগকারীর পরিবারযুদ্ধ নিরাপত্তা দেয়ার কোনো ব্যবস্থা আছে কি? বিভিন্ন থানায় এখন কোন ব্যাপারে পুলিশের ক্লিয়ারেন্স আনতে গেলে আগেই মোবাইল চেক করা হয়। কারণ, সেখানকার কথা বা কোন ভিডিও রেকর্ড করা হচ্ছে কিনা।
পুলিশ এবং ঘুষ যেন একে অন্যের পরিপূরক। পুলিশ যখন বলে, আমরা দেশের রাজা, তখনতো এটা সামান্য একটা ঘটনা। শিশু অপহরণ প্রসঙ্গে এক শুভাকাক্সক্ষী রহস্য করে বলেছেন, ‘পুলিশের বেতন বৃদ্ধি করে তাহলে কী লাভ হলো? দুর্নীতির বিরুদ্ধে লিখবেন না। এতে নাকি পুলিশের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে।’ আসামিদের হয়রানি ও ভয় দেখিয়ে প্রতি পদে পদে টাকা উসুল করা তো ‘ওপেন সিক্রেট’। এই রকম হাজার হাজার মামলা আসলে কিছু লোকের টাকা কামানোর বিশেষ উপায়।
আমরা মনে করি, দু-চারজন পুলিশ সদস্যের অপকর্মের দায় গোটা বাহিনীর ওপর চাপিয়ে দেয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর ওপর অবিচারের নামান্তর। এখনও বিভিন্ন প্রতিক‚ল পরিবেশ ও নানান প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে দৃঢ়ভাবে নিজের দায়িত্ব আর কর্তব্যের প্রতি অবিচল থেকে সততা আর আদর্শের ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপনকৃত চৌকস ও প্রতিশ্রæতিশীল পুলিশ অনেকই রয়েছে। জানা যায়, বয়সে তরুণ সিআইডি ওই কর্মকর্তা শিশু অপহরণ তদন্তে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারতেন যা তার ক্যারিয়ারের জন্য গর্বের কারণ হতো ও অধস্তন অন্য তরুণদের কথা মাথায় রেখে রোল মডেলসহ উজ্জ্বল ভবিষতের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকতেন। কিন্তু না, তিনি যেটা করেছেন সেটা মারাত্মক অপরাধ করছেন। আমরা মনে করি, তাকে লোক দেখানো ‘সাময়িক প্রত্যাহার’ না করে যথাযথ আইনের আওতায় আনা উচিত। মামলাকে পুনরায় জীবন্ত করা হোক।
২.
কেউ কি আমার যৌবন ফিরিয়ে দিতে পারবে? বিনা বিচারে ২৫ বছর কারাভোগের পর বেকসুর খালাস পেয়ে একথা বলেছেন কুমিল্লার বাঞ্ছারামপুরের বাহারনগর গ্রামের মো. বাবুল। একটা মানুষকে তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়টা থেকে দীর্ঘ ২৫ বছর বিনাবিচারে অবহেলায় জেলে আটকে রেখে তারপর শুধু বেকসুর খালাস? এটাই যথেষ্ট? খালাস আদেশের পর বাবুল বলেছেন, ২৫ বছর আগে ১৯৯২ সালে ডেমরা থেকে সিআইডি পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। তখন তার বয়স ছিল ১৫ বছর। এরপর থেকে বারবারই পুলিশ, আইনজীবী ও আদালতকে বলেছিলেন, তিনি নির্দোষ। তার কথা কেউ শোনেননি। আজ প্রমাণিত হলো, তার কথাই ঠিক ছিল। আদালত তার রায়ে উল্লেখ করেছেন, বাবুলের বিরুদ্ধে ৯ হাজার টাকার ডাকাতির অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে পারেনি। বাবুল বলেছেন, ‘আমার জীবন শেষ হয়ে গেছে। কেউ কি আমার যৌবন ফিরিয়ে দিতে পারবে?’ বাবুল যখন তার জীবনের কাহিনী শোনাচ্ছিলেন, তখন তার চোখ ভরা ছিল পানি। এত বছর ধরে একজন আসামি জেলে আছেন, এটা কি কারও নজরে পড়ল না? হয় নজরে পড়েছে কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। এইসব হতভাগার ফাইল নজরানা ছাড়া নজরে কি পড়ে না?
আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেছেন, বাবুলের প্রতি নষ্ট বছরের জন্য অন্তত ২ লাখ টাকা করে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হকও বাবুলের এই ঘটনাকে চরম অন্যায় বলে আখ্যায়িত করেছেন। আইন ও বিচার বিভাগের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নিজেদের বাবুলের জায়গায় রেখে অনুভব করুন। বাবুলকে অন্তত ২৫ বছর = ৯১২৫ দিন ও রাত কাটাতে হয়েছে কারাগারের খাঁচায়। ৫০ কোটি টাকায় বিনিময়ে কেউ কি তার যৌবনের মূল্যবান সময়গুলো ফিরিয়ে দিতে পারবেন? শুধু বাবুল নন, খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এভাবে অনেক লোক জেলখানায় বছরের পর বছর বন্দি আছেন। নিছক কারণ দেখিয়ে কিংবা পুলিশের ভুল গ্রেফতারের স্বীকার হয়ে জেলের প্রকোষ্টে জীবন কাটাচ্ছেন। এমনকি অনেক আছেন, হয়ত যাদের পরিবারের লোকেরাও জানেন না, তাদের ছেলে জেলে বন্দি।
৩.
বাতাস তো কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না, বা বিদেশ থেকে আমদানী করা যাবে না। অথচ ভয়ঙ্কর খবর হলো, রাজধানী ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দূষিত বায়ুর শহর। ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বে বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভারত ও বাংলাদেশে। আর এই দূষণে সবচেয়ে ক্ষতির ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে একযোগে প্রকাশিত ‘বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি-২০১৭’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। বায়ুদূষণে প্রথম স্থানটি আমাদের হাত ছাড়া হয়ে গেল! তারপরও সান্ত¡না যে, বিশ্বের বসবাসের অনুপোযোগী শহরগুলোর মধ্যে ২য় আমরা! এরপরে কি প্রথম হওয়ার পালা? বর্তমানে শীর্ষে রয়েছে ব্যাটে-বলে বিশ্বের ১ নম্বর পরাশক্তি ও টেস্ট খেলাড়ু দেশ ভারতের দিল্লি। এর পরেই রয়েছে পাকিস্তান ও চীন।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভালুয়েশনের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদন বলছে, বায়ুতে যেসব ক্ষতিকর উপাদান আছে, তার মধ্যে মানবদেহের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক উপাদান হচ্ছে পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম ২.৫। এতো দিন এই উপাদান সবচেয়ে বেশি নির্গত করত চীন। গত দুই বছরে চীনকে টপকে ওই দূষণকারী স্থানটি দখল করে নিয়েছে ভারত। চীন ও ভারতের পরেই রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান।
প্রতিবেদনে বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ২২ হাজার ৪শ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে বলে বলা হয়েছে। আর বায়ুদূষণের কারণে শিশুমৃত্যুর হারের দিক থেকে পাকিস্তানের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। গবেষকরা বলেছেন, ‘বাংলাদেশে বায়ুদূষণের মোট পরিমাণ চীন ও ভারতের সঙ্গে তুলনীয় নয়। তবে বিশ্বের যেসব দেশে সবচেয়ে দ্রæত বায়ুদূষণ বাড়ছে, তার মধ্যে অবশ্যই বাংলাদেশ প্রথম সারিতে থাকবে’।
আজ ডায়াবেটিস ও ক্যান্সার থেকেও ভয়ঙ্কর হয়ে ধেয়ে আসছে ফুসফুসের মহামারী রোগ। এর মধ্যে রয়েছে য²া, হাপানী ও কাশীর ভাইরাস। এই বায়ুদূষণ ঠেকাতে অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে যা সময় সাপেক্ষ, কিন্তু এর আগে শব্দদূষণের প্রধান কারণ যানবাহনের হর্নের নিয়ন্ত্রণ অনেক জরুরি ও সহজ। বিচিত্র ধরনের হর্ন বাবহার ও অত্যন্ত উচ্চ শব্দের কারণে আমাদের শ্রবণশক্তি ও মানসিক স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। একজন সেদিন বললেন, বিদেশ ফেরত ঢাকায় যারা বাস করে অভ্যস্ত, তারা ধরতে পারবেন না। কিন্তু বহু বছর বিদেশে থেকে দেশে ফিরে শ্বাস নিতে কষ্ট হয় দূষিত বায়ুর কারণে। ঢাকায় কখনও নীল আকাশ দেখা যায় না, নিউইয়র্কে যেটা দেখে হুমায়ুন আহমেদ মুগ্ধ হয়েছিলেন। আমরা পরিবেশের কথা বলে বিদেশ থেকে অনুদান আনবো, কিন্তু পরিবেশের মত অবহেলিত বিষয় বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি নেই।
ঢাকা শহরে চলাচলকারী কয়টা বাস, মিনিবাস, ট্রাক, লেগুনার ফিটনেস আছে বা তাদের চালকদের লাইসেন্স আছে? পুলিশ, প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ করেই ফিটনেসবিহীন গাড়ী নির্ভয়ে রাজপথে দাবড়ে বেড়াচ্ছে। আমাদের মন্ত্রী, এমপি আর বিত্তবানরা বাড়ি, গাড়ি, অফিস সব জায়গায় শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বায়ুমন্ডল বানিয়ে নিয়েছেন। সাধারণ জনগণ নিয়ে ভাবার সময় কোথায়। শহরের মানুষেরা বরঞ্চ তাদের এসির কাম-ঘাম মেশানো গরম বাতাস গিলেই থাকছেন।
যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ি, নিচুভূমি ভরাট, নির্মাণকাজে প্রচলিত আইন না মানায় শুষ্ক মৌসুমে ধুলোবালি, গরমে তীব্র তাপদাহ, বর্ষায় বন্যা ও বৃক্ষবিহীন ঢাকা শহর। এসব বিষয়ে আশু তদারকি জরুরি।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন