পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
বিনিয়োগে এখন বড় বাধা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নয়- দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ব্যাংক লুটেরাদের আড়াল করে নিচের সারির দেড় শতাধিক ব্যাংক কর্মকর্তাকে আটক করেছে সংস্থাটি। এতে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে আর্থিক খাতে। আতঙ্কে ঋণ বিতরণ এক প্রকার বন্ধই করে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। এতে স্তিমিত হয়ে গেছে দেশের বিনিয়োগ কার্যক্রম। অর্থ চলে যাচ্ছে বিদেশে। হয়রানির ভয়ে বড় উদ্যোক্তারা ঋণ নিচ্ছেন বিদেশি উৎস থেকে। এই পরিস্থিতি চললে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ঘরে পৌঁছানো অসম্ভব- মত বিশেষজ্ঞদের। তাহলে কার স্বার্থে কাজ করছে দুদক?। আজ প্রথম পর্ব
তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের : ঢাকার ওয়ারির ব্যবসায়ী তৌহিদুল আলমের গার্মেন্ট কারখানা ও ফ্যাশন হাউজের ব্যবসা। রাজধানীতে তার ১২টি বৃহদাকার শোরুম। অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী, তার কোম্পানির আকার ১শ’ কোটি টাকার ওপরে। তিনি ঢাকায় আরও ১৭টি শোরুম খুলবেন যাতে তার দরকার ৮২ কোটি টাকা। ৩০ কোটি টাকার সম্পত্তির মর্টগেজ দিয়ে ব্যাংক থেকে ১০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার জন্য দু’মাস ধরে বিভিন্ন ব্যাংকে ঘুরছেন। তারপরও কোনো ব্যাংক তাকে ঋণ দেয়নি।
তিনি কী ১০ কোটি টাকা ঋণ পাওয়ার যোগ্য নন- এমন প্রশ্ন করা হয় সোনালী ব্যাংকের একটি কর্পোরেট শাখার ঋণ কর্মকর্তাকে, যিনিও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ীকে। বললেন, সকল আইন অনুযায়ী তিনি এর চেয়ে বেশি ঋণ পাওয়ার যোগ্য।
: তাহলে দিচ্ছেন না কেন?
: তার ব্যবসা ভালো। তবে তার ব্যাংক লেনদেন কিছু কম আছে।
: এটা কি তার ঋণ পেতে কোনো আইনি বাধা?
: না। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যেভাবে আমাদের হয়রানি করছে তাতে আমরা ঋণ না দিতে পারলেই বাঁচি। এজন্য কোনো ব্যবসায়ীর ত্রুটি না থাকলেও ত্রুটি বের করে তাকে ফিরিয়ে দেই। ভালোই তো আছি। ঋণ না দিলেও বেতন ঠিকমতো পাচ্ছি। খামোখা ঋণ দিয়ে নিজে হয়রানির শিকার হওয়ার দরকার কি?
“সকল প্রক্রিয়া ঠিকভাবে সম্পন্ন করে ঋণ দিলেও দুদক সেখানে ‘ত্রুটি’ খুঁজে পায়। আর একটি ঋণ ফাইলে অনেক কর্মকর্তার স্বাক্ষর থাকে। কেউ ভুলক্রমেও কোনো ত্রুটি করলে ওই ফাইলে স্বাক্ষরকারী সবার ‘ইতিহাস’ নিয়ে টান দেয় দুদক। সবাইকে নোটিশ করে- এটা নিয়ে আমরা আতঙ্কে আছি।”
রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর (ছদ্মনাম)। ওই ব্যাংকটিতে এটা সবাই জানে, সে কোনো ঋণ দেয় না। এজন্য তাকে কয়েকবার বদলিও হতে হয়েছে। কারণ জানতে চাইলে ইনকিলাবকে বলেন, “ঋণ না দিলে বদলিই তো করবে, চাকরিতো খেতে পারবে না। বাংলাদেশের যেখানে বদলি করুক সেখানে যাবো। তবু ঋণ দেবো না। কারণ আমার পারিবারিক সম্মান ঋণ দিতে গিয়ে নষ্ট করবো না।”
এই বিষয়টি ওই ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সামনে উত্থাপন করা হলে ইনকিলাবকে বলেন, “এটা ঠিক, দুদকের কিছু বাড়াবাড়ির কারণে ব্যাংকারদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। ব্যাংকের বিনিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে দেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়বে। এখন সময় এসেছে, দুদক এবং ব্যাংকাররা মিলে পারস্পরিক সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টি করার। সবার কাজের পরিধি চিহ্নিত করার।”
শুধু তৌহিদুল নয়, একইভাবে এক বছর ঘুরেও ঋণ পাননি হাতিরপুলের টাইলস ব্যবসায়ী কুদরত এলাহী। গাইবান্ধার গোবীন্দগঞ্জে ১শ’ বিঘা জমির ওপর একটি কোল্ড স্টোরেজ প্রোজেক্ট করার জন্য জনতা, সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন তিনি। জনতা ব্যাংক থেকে মৌখিক সায় পাওয়ার পর প্রায় ১০ কোটি টাকা বিনিয়োগও করেন এই প্রকল্পে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যাংক ঋণ দেয়নি তাকে। এতে তার প্রায় ৭ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে- ইনকিলাবের কাছে এমন দাবি করেন কুদরত এলাহী।
“ব্যাংকে এখন সব ঋণ দেয়া বন্ধ। আমার জানা মতে কোনো ম্যানেজার এখন ঋণ দিচ্ছেন না। ঋণ গ্রাহকরাও এখন শাখায় কম আসছে। সাধারণ ব্যবসায়ীরাও ব্যাংকে আসতে চাচ্ছেন না।” ইনকিলাবের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন রূপালী ব্যাংকের একটি কর্পোরেট শাখার ব্যবস্থাপক। “রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া সত্ত্বেও দেশে বিনিয়োগ বাড়ছে না দুদকের বাড়াবাড়ির কারণে। পৃথিবীর কেউ শতভাগ শর্ত পূরণ করে ঋণ দিতেও পারবে না; নিতেও পারবে না। আমাদের দেখতে হয়, ঋণ গ্রহীতার ব্যবসা আছে কিনা; তার ঋণ ফেরত দেয়ার সামর্থ আছে কিনা; আর ঋণের জামানত ঠিক আছে কিনা। এখন শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেও ঋণ দেয়ার পর দুদক যদি হয়রানি করে তবে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে না।”
তিনি বলেন, একজন ম্যানেজারের ঋণ দেয়ার ক্ষমতা থাকে ২০ থেকে ৫০ লাখ টাকা। বড় ঋণ দেয় বোর্ড ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। এখন তারা কোনো ত্রুটি করলে ধরা হচ্ছে আমাদের।
ব্যাংকিং ভালো বোঝে এমন লোকদের সমন্বয়ে আর্থিক খাতের জন্য দুদকে আলাদা সেল করার দাবি জানান ওই ব্যবস্থাপক। “আনাড়ি লোকজন তদন্তে এসেই মূলত ঝামেলা পাকায়,” বলেন তিনি।
তবে ‘ব্যাংকিং খাত সম্পর্কে অভিজ্ঞ জনবল দুদকে আছে যাদের দিয়ে আর্থিক খাতের তদন্ত করানো হয়’ বলে ইনকিলাবকে জানিয়েছেন আবু মো. মোস্তফা কামাল।
এদিকে সৎ কর্মকর্তাদের অভয় দিয়েছেন অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ সামস-উল ইসলাম। তিনি ইনকিলাবকে বলেন, “আমি দুদক চেয়াম্যানের সঙ্গে দেখা করেছি। তিনি আমাকে বলেছেন, যারা ঠিকভাবে কাজ করবে তাদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আমিও আমার কর্মকর্তাদের এটা জানিয়ে দিয়েছি।”
“সৎ কর্মকর্তারা নির্বিঘেœ কাজ করতে পারবেন” জানিয়ে তিনি বলেন, দুদকের অভিযানের ফলে ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা ফিরে আসছে।
এদিকে দুদকের ‘আতঙ্ক সৃষ্টিকারী কর্মকা-ের’ সমালোচনা করেছেন সোনালী ব্যাংকের বঙ্গবন্ধু পরিষদের সবেক সভাপতি উপ-মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আলাউদ্দিন, যিনি পুরো ব্যাংক খাতে একজন সৎ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। হলমার্ক কেলেঙ্কারি উদ্ঘাটনে তিনিই মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। হলমার্কের ঋণ যখন দেয়া হয় তখন তাকে কয়েকটি সভায় প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করতে শোনা যায়। তিনিও ইনকিলাবের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সরব হয়েছেন দুদকের বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে। বলেছেন, দুর্নীতিবাজদের যে মেসেজ দেয়ার দরকার ছিল তা দেয়া হয়েছে। দুদকের এখন আর সব জায়গায় হস্তক্ষেপ করা ঠিক নয়। এতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে হলে ব্যাপক বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই।
“প্রতিটি ব্যাংকের নিজস্ব তদন্ত দল আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকটি বিভাগ আছে তদন্তের জন্য। এরা অনুসন্ধান করে কোনো তথ্য পেলে প্রয়োজন মনে করলে দুদককে দেবে। দুদক তারপর সেটা নিয়ে কাজ করুক। ঢালাওভাবে কাজ করে ব্যাংকারদের আতঙ্কের মধ্যে রাখা ঠিক হচ্ছে না।”
ব্যাংকাররা যে আতঙ্কের মধ্যে আছেন সেটা প্রধানমন্ত্রীকেও জানানো হয়েছে। জানিয়েছেন ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবি ও ব্যাংকারদের সংগঠন এবিবি’র নেতারা।
“এভাবে ভয়ভীতি দেখাতে থাকলে ব্যাংকিং কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে আসবে, যার প্রভাব পড়বে পুরো অর্থনীতিতে,” বলেছেন এবিবি চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি আনিস এ খান।
“আমাদের উদ্বেগের কথা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে জানিয়েছি।” তবে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আপত্তি নেই তার।
“ঋণ-সংক্রান্ত কোনো কাগজে স্বাক্ষর করলে দুদক তাকে ধরে নিয়ে যাবে কিনা, সে বিষয়টি ভাবতে হচ্ছে ব্যাংকারদের”- বলেন এবিবি’র সহ-সভাপতি ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।
“এতে ঋণ অনুমোদনে দীর্ঘসূত্রতার পাশাপাশি ভালো গ্রাহকও ঋণবঞ্চিত হতে পারেন। তাই ব্যাংকারদের গ্রেফতারের আগে দুদকের দেখা উচিত, কেউ যাতে অহেতুক হয়রানির শিকার না হন।”
শুধু ব্যাংকার নয়, দুদকের সমালোচনা করছেন অর্থনীতিবিদরাও। বড় বড় চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের আগে গ্রেপ্তার করতে বলেছেন অর্থনীতিবিদ ও সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ।
“দুদকের উচিত একটু সময় নিয়ে হলেও প্রভাবশালী ও বড় দুর্নীতিবাজদের গ্রেফতারে যাওয়া। না হলে এই অভিযান প্রশ্নবিদ্ধ হবে।”
‘এফআইআর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাউকে গ্রেফতার করা হলে প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক গতি নষ্ট হয়’ উল্লেখ করে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেছেন, “এতে ব্যাংকিং খাতের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট হতে পারে। ফলে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে দেশের আর্থিক খাতে।”
“দুদকের অভিযান চললেও ব্যাংকগুলোর বড় বড় খেলাপি ও কেলেঙ্কারির নায়কদের কিছুই হচ্ছে না”- ইনকিলাবকে বলেন সরকারি গবেষণা সংস্থা বিআইডিএস এর এই সাবেক গবেষণা পরিচালক।
“বড় বড় আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে যুক্তরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে” উল্লেখ করে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এটি দুর্নীতির মূলোৎপাটনে মোটেই সহায়ক নয়।
তবে দুদকের চলমান অভিযানে আর্থিক খাতের জন্য কোনো সমস্যা দেখছেন না বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা।
আর দুদক সচিব আবু মো. মোস্তফা কামাল ইনকিলাবকে বলেছেন, “দুদক চায় ব্যাংকে ঋণ অনুমোদন হোক। তবে সেটা হতে হবে আইনসম্মত, স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত উপায়ে। যদি কেউ দুর্নীতি না করে তাহলে ভয়ের কিছু নেই।” “ঋণ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ থাকলে কারো ভয় থাকবে না- কমিশন বারবার এটা নিশ্চিত করেছে”- বলেন তিনি।
এদিকে দুদকের অভিযানের বিরুদ্ধে একাধিকবার প্রকাশ্যে বক্তব্য দিতে দেখা গেছে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে। ‘সুবিধা না পেলে দুদক কর্মকর্তারা হয়রানি করেন’- প্রকাশ্যে এমন অভিযোগও তোলেন তিনি। ৫০ হাজার কোটি টাকার আবাসন খাতে ধ্বসের জন্যও দুদককে অভিযুক্ত করেছেন তিনি।
তাহলে এবার কি পুরো বেসরকারি খাতই ধ্বসে পড়বে?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।