Inqilab Logo

মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বন, আবহাওয়া ও পরিবেশ : প্রেক্ষাপট সিলেট জেলা

| প্রকাশের সময় : ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী
(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
একটি তথ্যসূত্র মতে, রাতারগুলে ২৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ২০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৯ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৭৩ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। বর্ষাকালে এ বনের ভেতর নদীর পানি প্রবেশ করে; পানি আর সবুজিয়ার মাখামাখিতে এর নয়নাভিরাম দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। অথচ রাতারগুল বন সংরক্ষণ ও বিস্তৃতকরণে সংশ্লিষ্ট মহলের বাস্তব পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
৫.
বনভূমি সংরক্ষণ ও বন সৃজনের মাধ্যমে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য নিরাপদ জীবনধারণ, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা, স্বাস্থ্যসম্মত আবহাওয়া নিশ্চিত করতে পারি। অপরিকল্পিত নগরায়ন, স্বেচ্ছাচারিতার কারণে ব্যাপকহারে বৃক্ষনিধনের ফলে আজ মানবজীবন ও জীববৈচিত্র্য অস্তিত্ব-সংকটের সম্মুখীন। সিলেটের নগর, গ্রাম, গঞ্জ, মাঠ এমনকি প্রতিটি বাড়িতে বৃক্ষরোপণ ও বনায়নের মাধ্যমে এ সংকট উত্তরণে প্রচেষ্টা চালানো প্রয়োজন। জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য গাছপালা নির্বিচারে কেটে ফেলা হচ্ছে, দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে বনভূমি। যেভাবে বাড়িঘর, শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সেই অনুপাতে বন সৃষ্টি হচ্ছে না। আমাদের গাছপালার নিঃসীম গুরুত্বকে অনুধাবন করতে হবে। সরকারি-বেসরকারিভাবে ব্যাপক হারে বনায়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারলে বিরাজমান বায়ুদূষণ, উষ্ণায়ন, গ্রিনহাউস এফেক্টসহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব।  
বনায়নে আমরা প্রত্যেকেই কিছুটা হলেও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। গাছপালা বাতাস থেকে ক্ষতিকারক কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস শোষণ করে এবং একই সঙ্গে বাতাসে জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য অক্সিজেন গ্যাস যোগ করে। এভাবেই গাছপালা বায়বীয় ভারসাম্য বজায় রেখে পৃথিবীকে বাসোপযোগী করে তুলে। সবুজায়নের মাত্রা যত বাড়বে ততই বাতাসে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ কমবে। অনাবশ্যক জ্বালানি রোধে ও সবুজায়নের মাধ্যমে প্রতিটি মানুষ অতি সামান্য মাত্রায় অবদান রাখতে পারলেই  উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশ রক্ষায় এক বিরাট পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
৬.
সিলেট জেলার পরিবেশ দূষণ প্রসঙ্গ এ সময়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্নভাবে দূষিত হচ্ছে এখানকার স্বাস্থ্যকর পরিবেশ। টিলা পাহাড় কাটা হচ্ছে নির্বিচারে। সিলেট সদর, বিয়ানিবাজার, গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জসহ প্রায় প্রতিটি উপ-জেলায় টিলা ও পাহাড় কাটা হচ্ছে। বিগত ১০ বছরে টিলা কাটার কারণে টিলা-পাহাড়ের পরিমাণ ৫০ শতাংশ নেমে এসেছে। অবাধে বালু উত্তোলন ও পুকুর জলাশয় ভরাট করা হচ্ছে। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে মাটির নিচ থেকে পাথর উত্তোলন করা হয়। জেলায় ইটভাটার সংখ্যা প্রায় ৯৮টি। ইটভাটার জন্য কৃষিজমি থেকে মাটি সংগ্রহ করা হচ্ছে। ইটভাটার জন্য কৃষিজমি থেকে মাটি সংগ্রহ করা হচ্ছে। ইটভাটার ক্ষতিকর ধোঁয়ায় পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।
স্টোন ক্রাশার পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এগুলোর ব্যাপক ডাস্ট এবং ধোঁয়ার কারণে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। বায়ুদূষণের সঙ্গে আবর্জনা স্তূপীকৃত হয়ে খাল-বিল, নদী-নালা, জমি ভরাট হচ্ছে। এছাড়া এগুলোর বিকট শব্দের কারণে পরিবেশ দূষণ বেড়েই চলেছে। করাতকল আবাসিক এলাকার কাছে থাকায় শব্দদূষণ স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে। এর কারণে গাছ কেটে বনাঞ্চল উজাড় করা হচ্ছে এবং এগুলোর ডাস্ট পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। সিলেট জেলায় সারকারখানা থেকে উত্থিত অ্যামোনিয়া গ্যাসের গন্ধে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। এ গ্যাস কল- কারখানার ২/৩ কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া কারখানার বর্জ্যে নদী ও খাল-বিলের পানি দূষিত হচ্ছে। চারকলের কালো ধোঁয়ায় বায়ুদূষণ উদ্বেগজনক। রাইচমিলের ডাস্ট ও শব্দে পরিবেশ দূষণ চলছে।
চুনাপাথর কলকারখানা থেকে নির্গত হচ্ছে বর্জ্য। ব্যাপক হারে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের ফলে পরিবেশের দূষণ আরোও বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় ও ব্যাপক আবাসন প্রকল্পের দরুন নিচু-ভূমি, জলাশয়, খাল-বিল ভরাট হয়ে পরিবেশের ভারসাম্য হুমকির সম্মুখীন। বিভিন্ন স্থানে অনিরাপদ, অস্বাস্থ্যকর পোল্ট্রি ফার্মের দুর্গন্ধে বায়ু দূষিত হচ্ছে। ওয়ার্কশপগুলোর অবাধ ওয়েল্ডিং থেকে সৃষ্ট রেডিয়েশন বিকিরণে পরিবেশ হুমকিগ্রস্ত। রাবার কারখানার নির্গত বর্জ্যরে কারণে ছড়া, নদী ও পুকুরের পানি দূষিত হচ্ছে। ডেনরি ফার্মগুলোর গো-চেনা ও গোবর দ্বারা পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। ফুড ফ্যাক্টরি ও বেকারি বিভিন্ন স্থানে অপরিকল্পিত মৎস্য হ্যাচারি তৈরি করতে ভূমির স্বাভাবিক কাঠামো পরিবর্তন করতে হয়। এর প্রভাব পড়ছে পবিবেশের উপর। চা-বাগানে প্রয়োগ করা হয় প্রচুর কীটনাশক। ফলশ্রুতিতে এটি ছড়া, নদী, খাল, পুকুরের পানিতে মিশে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৭.
বায়ূদূষণের প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে বিঘিœত করে মানব সমাজকে সংকটের দিকে নিয়ে চলেছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারিয়ে পানিতে, স্থলে, অন্তরীক্ষে মানবসৃষ্ট ভয়াবহ বিপদ সংকট আমাদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলছে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমরা শুধু শিল্প-প্রযুক্তির উৎকর্ষ ও বাণিজ্যিক ফায়দা হাসিলকে অভীষ্ট হিসেবে গ্রহণ করেছি। অথচ একবারও ভাবছিনা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা। এদের বাসোপযোগী একটি নিরাপদ, স্বাস্থ্যপ্রদ আবাসভূমির কথা। তাই এই সময়ের অনিবার্য দাবি-মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে ব্যাপকহারে বনায়ন, ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিবেশ রক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণ, নির্মল আবহাওয়া নিশ্চিতকরণে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ। আসুন আমাদের উন্নত, সুস্থ, নিরাপদ, স্বাস্থ্যপ্রদ জীবন নিশ্চিতকরণে বন, আবহাওয়া ও পরিবেশ সুরক্ষার দৃঢ় অঙ্গীকার করি। শপথ নিই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষার।
উৎস্যঃ/তথ্যঃ
সিলেট অঞ্চলে প্রকৃতি পর্যটন তথ্য কনিকা।
একনজরে সিলেট বন বিভাগ।
বাংলাদেশ গেজেট। অতিরিক্ত সংখ্যা, অক্টোবর-২০১০।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট, বৃৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কার (১ম স্বর্ণ পদক) প্রাপ্ত।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন