Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

মধ্যপ্রাচ্য সঙ্ঘাতকে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাকিয়ে দেখা

| প্রকাশের সময় : ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আমেরিকান মিলিটারি নিউজ : মধ্যপ্রাচ্য একটি গোলমেলে অঞ্চল। তবে ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া ও অন্যান্য জায়গায় যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি সম্পৃক্ত হলেও বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সে দায়ী নয়। ট্রাম্প প্রশাসন উত্তরাধিকার সূত্রে যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন সেগুলোর সমাধান অধরা। এগুলোর পুনর্মূল্যায়ণ প্রয়োজন।
তেল সমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে তিনটি দেশ রাজনৈতিক ও সাস্কৃতিকভাবে আলাদা। এ দেশগুলো হচ্ছেÑ ইরাক, সিরিয়া ও মিসর। সিরিয়ার রয়েছে দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ইতিহাসসহ ঐতিহ্যবাহী সমাজ। দামেস্ক হচ্ছে বিশে^র অন্যতম প্রাচীন শহর যেখানে অব্যাহতভাবে মানুষের বসবাস ছিল। এটি দীর্ঘদিন থেকে আরববিশে^র অন্যতম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং শিল্পকলার নতুন নতুন উদ্ভাবন ঘটেছে এখানে, বিশেষ করে ক্ল্যাসিক্যাল আরব সঙ্গীতের ক্ষেত্রে।
৯ ও ১০ শতকে ইসলামের সোনালি যুগে ইরাক ছিল আরব খিলাফতের কেন্দ্র। ১০ শতকের শুরুতে বাগদাদ ছিল বিশে^র বৃহত্তম শহর। ২০ শতকের গোড়ায় ইরাক ও সিরিয়া উভয়ই ছিল অটোম্যান সাম্রাজ্যের অংশ।
মিসর আরববিশে^র সবচেয়ে জনসংখ্যাবহুল ও বহুজাতিক দেশ। পাশ্চাত্যের সাথে মিসরের মিথষ্ক্রিয়ার সময়কাল প্রাচীন গ্রিসের মতই পুরনো যখন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ৩০৫ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে তার এক সেনাপতি টলেমিকে মিসরের ফারাও করেন। ক্লিওপেট্রা ( ৫১-৩০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ) ছিলেন টলেমির সরাসরি বংশধর। সিরিয়া ও ইরাকের মতো মিসরও অটোম্যান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় তা ব্রিটিশ আশ্রিত দেশে পরিণত হয়।
১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত মিসর ও সিরিয়া মিলে ছিল সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র। ১৯৬৩ সালে মিসর, সিরিয়া ও ইরাক মিলে ঐক্যবদ্ধ দেশ গঠনের আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু সিরিয়ায় বাথ ও নাসেরপন্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের পর সে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। তবে ১৯৬১ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত মিসর সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র নাম ব্যবহার অব্যাহত রাখে। ১৯৭২ সালে ইরাক মিসর ও সিরিয়ার সাথে প্রজাতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেয়, কিন্তু তাও ব্যর্থ হয়। এ তিনটি দেশই পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র দেশে পরিণত হয়। তারা আমেরিকার পোষ্য দেশ ইসরাইলের বিরুদ্ধে তাদের শক্তি ব্যবহার করার উদ্যোগ নেয়।
মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমান সঙ্ঘাতে জড়িতদের বুঝতে হলে ঐতিহাসিক কাল হিসেবে আমাদের ১৯১৯ সালে ওসমানীয় সাম্রাজ্য ভাঙনের দিকে তাকাতে হবে। এ সময় ব্রিটেন ফিলিস্তিন, ট্রান্স জর্ডান ও ইরাকে প্রবেশ করে, অন্যদিকে ফ্রান্স নেয় লেবানন ও সিরিয়া (লেভান্ট)। সংখ্যালঘু শিয়া আলাবি উপগোষ্ঠীকে (সিরিয়ার দায়িত্বে থাকা গোপনতাপূর্ণ উপগোষ্ঠী) রাজনৈতিক আমলাতন্ত্রের দায়িত্ব দেয়া হয়। আলাবিদেরকে সামরিক বাহিনী, বিশেষ করে অত্যন্ত শক্তিশালী শাখা বিমান বাহিনীর দায়িত্ব দেয়া হয়। আসাদ পরিবার আলাবি উপগোষ্ঠীভুক্ত, তাদের অবিশ^াস করা হয় এবং ইসলাম বিরোধী হিসেবে দেখা হয়।
সিরিয়ার বর্তমান যে যুদ্ধ চলছে তা নতুন নয়। ফরাসিরা ১৯১৯-১৯৩৯ সাল পর্যন্ত আন্তযুদ্ধকালীন গোটা সময়টাই সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। আসাদের পিতা ১৯৭০ ও ১৯৮০-র দশকে গণজাগরণ দমন করেন। ১৯৮২ সালে ঘটে হামাস গণহত্যা যেখানে সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী ২০০-২০,০০০ (কোনো কোনো হিসেবে ৪০ হাজার) বেসামরিক লোককে হত্যা করে। আধুনিক মধ্যপ্রাচ্যে কোনো আরব সরকার কর্তৃক ভয়াবহ একক হত্যার ঘটনা বলে একে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। কৌত‚হলজনক বিষয় হচ্ছে হামাসের বিদ্রোহীরা ছিল সিরিয়ার মুসলিম ব্রাদার হুড।
এ প্রেক্ষাপট থেকে দেখলে আসাদের জন্য শুধু তার পরিবারই নয়, আলাবিদের সকলের অস্তিত্বই ঝুঁকির সম্মুখীন। বিদ্রোহীরা যদি টিকে থাকে , যাদের আল কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটের মতো মৌলবাদী শক্তিগুলো ব্যাপকভাবে দলভুক্ত করছে, তাহলে একটি রক্তপাত সংঘটিত হবে, নির্মূল হবে আলাবিরা।
এখন প্রতীয়মান যে সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাতের জন্য ২০০৩ সালের ইরাক আগ্রাসন ছিল আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ কৌশলগত ভুল। অটোম্যান-উত্তর সিরিয়ার মতো ইরাকও একই রকম বিভক্ত সমাজের দেশ। সাদ্দাম হোসেন মার্কিনিদের হাতে আটক হওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে তার জিজ্ঞাসাবাদকারীকে এ বিষয়টি বলেছিলেনÑ তোমরা ব্যর্থ হবে। তোমরা বুঝতে পারবে যে, ইরাককে শাসন করা মোটেই সহজ নয়।
সাদ্দাম হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদকারী সিআইএ বিশ্লেষক জন নিক্সন বলেনÑ সাদ্দাম হোসেনকে ইরাকের ক্ষমতায় রাখা উচিত ছিল।
আদর্শের বুলি কপচে ২০০৩ সালে ইরাকে প্রবেশের পর যুক্তরাষ্ট্র শিখেছে যে, এটা ১৯৪০-এর দশকে ফ্রান্স ও ইতালিকে মুক্ত করা নয়, এ হচ্ছে গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলার প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দেয়া। আবারো সাদ্দামের কথা আসে। তিনি জন নিক্সনকে বলেছিলেন, তোমরা ইরাকে ব্যর্থ হতে যাচ্ছ, কারণ তোমরা ইরাকিদের ভাষা ও ইরাকের ইতিহাস জান না, তোমরা আরবদের মন বোঝ না।
ছিদ্রান্বেষী বিশে^র মত হচ্ছে, আসাদ রক্তপিপাসামূলক নিপীড়ন চালাচ্ছেন, কিন্তু তার বিরোধীরাও আসলে ভালো লোক নয়। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে আসাদের বিদ্রোহীরা ইসলামিক স্টেট ও আল কায়েদার সাথে যোগ দিচ্ছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে এ ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ নেয়ার অর্থ সিরিয়ার কোনো পক্ষকে সমর্থন করা এবং এ কথা স্বীকার করা যে সিরিয়া রুশ প্রভাব বলয়ে রয়েছে। এই গোলমালে পুতিনের জড়িত হওয়া মানে ইরাকের উপর যুক্তরাষ্ট্রের আরো গুরুত্বারোপ এ নীতিতে যে আমরা এটা ভেঙেছি, সুতরাং আমাদেরই তা জোড়া লাগাতে হবে।
এদিকে মিসরের পশ্চিমে আরেকটা বিশৃঙ্খলা চলছে যাতে পাশ্চাত্যের হাত ছিল, তা হচ্ছে লিবিয়ার পরাবাস্তব গৃহযুদ্ধ। পরিহাস যে সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর সৃষ্ট গোলযোগের অভিজ্ঞতার দশ বছরের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র আরেকজন আরব স্বৈরশাসককে ক্ষমতাচ্যুত করতে আগ্রহী হয়। গাদ্দাফির পতনের পিছনে কোনো মক্ত করা বা দেশ গড়ার কল্যাণকর চিন্তা ছিল না। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র স্রেফ ভেঙেছে এবং ছেড়ে এসেছে।
কর্মই যদি মূল হয় তাহলে নিঃসন্দেহে মধ্যপ্রাচ্যে আমরা আন্তর্জাতিক মাত্রায় সে অভিজ্ঞতা অর্জন করছি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ