Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি : অন্ধকে হাইকোর্ট দেখানো

| প্রকাশের সময় : ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

এবি সিদ্দিক : জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস পেতে আর এলপিজির ব্যবহার বাড়াতেই গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে।’ আর গ্যাসের দাম বাড়াতে গিয়ে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন বলেছেন, ‘আইওসির (আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানির) কাছে থেকে পেট্রোবাংলা বেশি দামে গ্যাস কিনছে আর বিক্রি করা হচ্ছে কম দামে। তাই দাম সমন্বয় করতেই গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে’। যুক্তিটা হলো ‘কানাকে (অন্ধকে) হাইকোর্ট দেখানোর মতো’। যদি গ্যাসে সরকার লোকসান দিত বা ভর্তুকি দিত তা হলে না হয় একটা কথা ছিল। কিন্তু গ্যাসে তো লোকসান বা ভর্তুিক নেই। মোটা অংকের মুনাফা আর প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা নেয়া হচ্ছে। তারপরও কেন দাম বাড়ানো হচ্ছে? বছর ঘুরতে না ঘুরতেই গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। আইওসি বলতে বর্তমানে শেভরন ও তাল্লো গ্যাস উৎপাদন করছে। তারা মোট উৎপাদনের ৬০ শতাংশ, বাকিটা করছে দেশিও অন্যান্য কোম্পানি। চুক্তি অনুযায়ী তাদের কাছ থেকে বেশি দামেই গ্যাস কিনতে হচ্ছে। তবে সার্বিক গ্যাস খাতে প্রতিবছরই সরকার মোটা অংকের অর্থ মুনাফা করছে। গেল ২০১৫-১৬ অর্থবছরে গ্যাস কোম্পানিগুলোর পরিচলনা মুনাফা ছিল ১ হাজার ৬৭৬ কোটি ৪০ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। ঐ অর্থবছরে গ্যাস বিক্রি করা হয় ১০ হাজার ২৩০ কোটি ৫০ লাখ ৮৯ হাজার টাকার। ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ সরকারকে দেয় ৩ হাজার ৫৫৪ কোটি ৩০ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। লক্ষণীয় বিষয় হলো যে, ঐ অর্থবছরে গ্যাস উৎপাদন ব্যয় ছিল মাত্র ৫১ কোটি ৯০ লাখ ৬০ হাজার টাকা। বাকিটা বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য ব্যয়। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা পড়েছে ২ হাজার ৪৬৯ কোটি ২০ লাখ ৭০ হাজার টাকা। একই সময়ে কোম্পানিগুলো কর অন্তে নিট মুনাফা করেছে ৯০৪ কোটি ৭৪ হাজার টাকা (সূত্র-পেট্রোবাংলা)। গ্যাসের দাম বাড়াতে গিয়ে এর আগে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন থেকে বলা হতো, ‘গ্যাস উন্নয়নের জন্যই দাম বাড়ানো হচ্ছে’। গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়িয়ে যে অতিরিক্ত অর্থ পাওয়া যাবে তা জমা হবে ‘গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে’। এখানে উল্লেখ্য- ‘২০০৯ সালের ৩০ জুলাই জারিকৃত কমিশন আদেশের মাধ্যমে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে রাষ্ট্রয়াত্ত কোম্পানিসমূহের আর্থিক ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে “গ্যাস উন্নয়ন তহবিল” গঠন করা হয়। গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের মূল্যহার ভারিত গড়ে ১১.২২% বৃদ্ধি করে এ তহবিল গঠন করা হয়। উক্ত ফান্ডে জুন, ২০১৫ পর্যন্ত সংগৃহীত অর্থের পরিমাণ ৪,৬৫২.৭০ কোটি টাকা। এ তহবিল থেকে ২০১০-১১ হতে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত মোট ৩,৯৭৭.৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২১টি প্রকল্প অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অনুমোদিত হয়। ইতোমধ্যে প্রায় ১,৩৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে এবং এতে করে প্রায় ৭৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হয়েছে। এছাড়া প্রায় ২,৪৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে অবশিষ্ট প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। আশা করা যায়, এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে। এই হলো কমিশনের বক্তব্য’। অপরদিকে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল সংশোধন করে ‘গ্যাস, পেট্রোলিয়াম ও খনিজ উন্নয়ন তহবিল নীতিমালা-২০১৫’ করা হচ্ছে। সংশোধিত নীতিমালায় এসব নিয়ম রাখা হচ্ছে বলে সংশিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। ইতোমধ্যে সংশোধনীর নতুন নীতির খসড়া করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) আদেশে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল গঠন করা হয়। সে সময় গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে বাড়তি অর্থকে গ্যাস খাতের উন্নয়নে কাজে লাগাতে এ তহবিল গঠন করা হয়। ২০১২ সালে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল নীতিমালা চ‚ড়ান্ত হয়। এখন আবার সংশোধন করা হচ্ছে। সংশোধিত নীতিমালায় বলা হয়েছে, তেল বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখন থেকে লাভের এক শতাংশ উন্নয়ন তহবিলে জমা দিতে হবে। আগামী ১৫ বছর এই তহবিল গঠন করা হবে। তবে এই তহবিলের অর্থ তেল খাতের জন্য ব্যয় করা হবে না। উল্লেখ্য, বিপিসির তিনটি জ্বালানি তেল বিপণন কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা বছরে গড়ে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা লাভ করে। লাভের এক শতাংশ হিসেবে তহবিলে প্রতিবছর গড়ে সাত কোটি টাকা জমা হবে। সংশোধিত নীতিমালায় বলা হয়েছে, তহবিল থেকে গ্যাস খাত উন্নয়নের জন্য ঋণ দেয়া যাবে। ঋণের যে সুদ পাওয়া যাবে তা আবার তহবিলে যোগ হবে। মোট পাঁচটি উৎস থেকে অর্থ নিয়ে এই তহবিল গঠন করা হবে।
এরমধ্যে রয়েছে ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর একটি অংশ, গ্যাসের দাম বাড়ানোর পর যে অর্থ পেট্রোবাংলা পায় তার একটি অংশ, বিপিসির আওতাধীন কোম্পানিগুলোর লাভের অংশ, উন্নয়ন সহযোগীদের অনুদান এবং সরকার বা অন্য কোন উৎস থেকে এই তহবিলের জন্য দেয়া অর্থ দিয়ে এই তহবিল হবে। তহবিলের অর্থে কোন প্রকল্প উন্নয়ন করা হবে তা নির্ধারণ করতে একটি বাছাই কমিটি করা হবে। এই কমিটির প্রধান থাকবেন অতিরিক্ত সচিব। তহবিলের অর্থে দেশের গ্যাস, কয়লা ও কঠিন শিলার মজুদ বাড়ানোর জন্য জরিপ ও অনুসন্ধান ক‚প খনন করা যাবে। গ্যাস সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় পাইপলাইন করা যাবে। এছাড়া গ্যাস কয়লা উন্নয়নে সকল কাজে অর্থ খরচ করা যাবে, সংশিষ্টদের প্রশিক্ষণও দেয়া হবে। তবে গাড়ি কেনা যাবে না, প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় গাড়ি ভাড়া করা যাবে, ইত্যাদি। অর্থাৎ গ্যাসের দাম বাড়িয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কত কিছুই না করা হবে। বলা যায়, জনসাধারণের কাছ থেকে টাকা নিয়ে লুটপাট। অপরদিকে আইওসিকে দেয়া হচ্ছে নানা সুবিধা। আইওসিগুলো বিভিন্ন সময় জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলাকে বিভিন্ন ধরনের চাপে ফেলেছে। দেখা গেছে, জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলাও সব সময় বিদেশি কোম্পানিগুলোর স্বার্থে কাজ করেছে। এর ফলে দেখা গেছে, তারা বিভিন্ন সময় অতিরিক্ত সুবিধা ভোগ করেছে। যেমন- কাফকোর কাছে গ্যাস বিক্রি করা হয়েছে কম দামে। কিন্তু সেই গ্যাস দিয়ে তৈরি সার কেনা হয়েছে আন্তর্জাতিক চড়া দামে। আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র জালালাবাদ লিজ দিয়ে দেয়া হলো অক্সিডেন্টালকে এবং কোনো দরপত্র ছাড়াই। এখন যেটা পরিচালনা করছে শেভরন। শেভরনের থেকে গ্যাস কিনছে পেট্রোবাংলা। আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র লিজ দেয়ার নজির পৃথিবীতে বিরল। কিন্তু বাংলাদেশে সেটা ঘটেছে। শেভরনের কাছ থেকে পেট্রোবাংলা প্রতি এমসিএফ গ্যাস কিনেছে ৩.২৩ ডলার দামে। আর এই গ্যাস লাফার্জ সিমেন্টের কাছে বিক্রি করেছে ২.৮ ডলার দামে। বেশি দামে কিনে কম দামে বিক্রি। তাও আবার বিদেশি কোম্পানির কাছে। লাফার্জ বাংলাদেশে ফ্যাক্টরি করেছে। তারা কম দামে গ্যাস পেয়েছে। আন্তর্জাতিক দামে সিমেন্ট-সার বিক্রি করে ডলার নিয়ে গেছে। বাংলাদেশের কিছু শ্রমিক কাজ করা ছাড়া আর কোনো উপকার হয়নি। গ্যাসের দাম আর শ্রমিকের মজুরির হিসাব মেলালে দেখা যাবে দেশের লাখ লাখ ডলার ক্ষতি হয়েছে। বাংলাদেশে চার ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন এবং বিক্রি করে শেভরন এবং তাল্লো গত অর্থবছরে সাড়ে ১৪শ কোটি টাকা লাভ করেছে। পিএসসি অনুযায়ী এ লাভের ওপর শেভরন বা তাল্লো কোন কর্পোরেট ট্যাক্স দেয়নি। তাদের পক্ষে ৩৭ শতাংশ হারে ৫৫৯ কোটি টাকার ট্যাক্স দিচ্ছে পেট্রোবাংলা। আইওসির চার ক্ষেত্রের বেশিরভাগ লাভের গ্যাস পেয়েও পেট্রোবাংলা লাভ করেছে দেড়শ’ থেকে ২০০ কোটি টাকার মতো।
লেখক : সাংবাদিক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন