Inqilab Logo

বুধবার ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্বজনদের চোখের পানি থামেনি এখনো

| প্রকাশের সময় : ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

উমর ফারুক আলহাদী : আবার ফিরে এলো শোকাবহ ও ভয়াবহ সেই ২৫ ফেব্রুয়ারি। যা বাংলাদেশের ইতিহাসের এক কলঙ্কময় দিন। দেশের ইতিহাসে জঘন্যতম এ কালো দিনটিকে পিলখানা ট্রাজেডি হিসাবেও দেখে থাকেন অনেকেই। ২০০৯ সালের এই দিন ঢাকার পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের নাটক মঞ্চস্থ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করে বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার চক্রান্ত শুরু হয়েছিল। কিন্তু সরকার তা রুখে দিয়ে দেশকে রক্ষা করতে পারলেও প্রাণ দিতে হয়েছে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে। ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্রে বাংলাদেশের দীর্ঘ প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহাসিক বিডিআরের চেতনাকে ধ্বংস করেছে। ১৯৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৩ মার্চ যে বাহিনী প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিল সেই বাহিনীকে করেছে কলংকিত। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে এতজন সেনাকর্মকর্তাকে হত্যা করার ঘটনা বিরল। এ নারকীয় হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে ২৫ ফেব্রুয়ারী পিলখানায়। তবে সরকার বিডিআর বিদ্রোহের ওই ঘটনাটিকে ‘পিলখানা হত্যা দিবস’ হিসেবে প্রতি বছর পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং তা পালন করছে। দিবসটি পালন উপলক্ষে সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচি। স্বজন হারানোর বেদনা এবং সেই দুর্বিষহ যন্ত্রণার স্মৃতি বুকে ধারণ করে আজো নিহত সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারগুলো কেঁদে বেড়াছেন। নিহতদের স্ত্রী সন্তানেরা বয়ে বেড়াচ্ছেন চিরতরে হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মানুষটির স্মৃতি। তাঁদের হৃদয়ের রক্ত ক্ষরণ আজো বন্ধ হয়নি। পিতা হারা সন্তান আজো ঘুমের ভেতর কান্নায় ভেঙে পড়েন। নিহত সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের কয়েকজন সদস্যের সাথে কথা বলেন এমনটি জানা গেছে। ২০০৯ সালের এই দিনে রাজধানীর পিলখানায় বিজিবি সদর দফতরের ভেতরে এক লোমহর্ষক মর্মান্তিক ঘটনায় ৫৭ জন মেধাবী সেনা কর্মকর্তার প্রাণ হারান। পিলখানায় পরিণত হয় এক রক্তাক্ত ভয়ানক হত্যাকান্ডে। ওই নারকীয় হত্যাকান্ডের ঘটনার পর পিলখানা থেকে আবিষ্কৃত হয় গণকবর। গণকবর থেকে উদ্ধার করা হয় সেনা কর্মকর্তাদের লাশ।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯ টা ২৭ মিনিট। দরবার হলে চলমান বার্ষিক দরবারে একদল বিদ্রোহী বিডিআর সৈনিক ঢুকে মহাপরিচালকের বুকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করেন। বিডিআরের বিদ্রোহী সৈনিকরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করে। এখানেই ঘটনার শেষ নয়, তাদের পরিবারকে জিম্মি করে ফেলেন। চারটি প্রবেশ গেটেই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আশেপাশের এলাকায় গুলি ছুঁড়তে থাকে। জন্ম নেয় এক বীভৎস ও আতঙ্কে সেদিন গুলির শব্দ আর রক্তের বন্যা বয়ে যায় ওই ঘটনায়। বিদ্রোহের এ ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলায় বিশেষ আদালত ১৫২ জনকে ফাঁসি, ১৬১ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও ২৬৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করেন। ২৭১ জনকে খালাস দেয়া হয়েছে। কিন্তু ভয়ঙ্কর দিনটির কথা আজো ভুলতে পারেননি নিহতদের স্বজনসহ দেশবাসী। ওই ঘটনায় ৫৭ জন মেধাবী সেনা কর্মকর্তা ছাড়াও একজন সৈনিক, দুইজন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী, ৯ জন বিডিআর সদস্য ও ৫ জন বেসামরিক ব্যক্তি প্রাণ হারাণ। পিলখানায় এ বিদ্রোহের ঘটনায় বিডিআরের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে যায়। শুরু হয় বিডিআরকে পুনর্গঠনের কাজ। বিডিআরের নাম, পোশাক, লোগো, সাংগঠনিক কাঠামো, পদোন্নতি ইত্যাদি ব্যাপার পুনর্গঠন করে নতুন নামে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) জন্ম হয়।
এদিকে গতকালও প্রতিবছরের মতো এবারো মেজর মো. মিজানুর রহমানের কবরের সামনে বসে অঝোর ধারায় কাঁদলেন সত্তর ছুঁই ছুঁই কোহিনূর বেগম ও বাবা আবদুল খালেক। নাতি ফারদিন রহমান সামীর কাঁধে হাত রেখে বিলাপ করে বলে যাচ্ছিলেন, তোমার ছেলেদের আমি আঁকড়ে ধরে আছি বাবা। যতদিন বাঁচি আমি দেখব। তোমাকে দেখতে বড় বেশি ইচ্ছে করে। তিনি জানান, মিজানুরের স্ত্রী রোজী পিলখানা হত্যাকান্ডের ৮ মাস আগে মারা গেছেন। ২ ছেলে-তাহসীন রহমান রামী ও ফারদিন রহমান সামী ছিল মিজানুরের বাঁচার একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু তিনিও অকালে চলে গেলেন। পিতার কথা স্মরণ হলেই সামী ও রামী আজো বনানী কবরস্থানে ছুটে যান। তাদের চোখের পানি দেখে প্রতিবেশীরা চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন না।
নিহত মেজর মোহাম্মদ মমিনুল ইসলাম সরদারের বৃদ্ধ বাবা মফিজুল ইসলাম সরকার। তিনি বলেন, রাতে আমি ঘুমাতে পারি না। ছেলের মেধা ও বুদ্ধিমত্তা নিয়ে মফিজুল ইসলাম সরকার চোখ মুছতে মুছতে বলেন, আমার ছেলে ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছিল। সেনাবাহিনীতে সবাই তাকে ডিকশনারি মমিন বলে ডাকত। এই নামেই একবারে সবাই চিনত। অক্সফোর্ড ডিকশনারি তার মুখস্থ ছিল। কেউ কোনো কিছু জানতে চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়ে দিত। আমার ছেলে অনেক ভালো মানুষ ছিল।
নিহত মেজর মমিনুলের বড় বোন নুরজাহার চৌধুরী জানান, মমিনুল ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন ব্যাচমেট সানজানা সরকার সোনিয়াকে। তাদের এক কন্যা সন্তান রয়েছে। মমিনুলের মৃত্যুর পর সরকারের সব ধরনের আর্থিক সহায়তা পায় সোনিয়া ও তার মেয়ে সাদাকাত। বাবা-মা কোনো সহযোগিতা পায়নি। ছোট ভাইয়ের স্মৃতি আউড়ে নুরজাহান জানান, খাগড়াছড়িতে মমিনুলের পোস্টিং ছিল। সে ছিল একজন কমান্ডো। ফেব্রুয়ারি মাসের ৬ তারিখ তাকে পিলখানায় বদলি করা হয়। বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের সঙ্গেই থাকতে হতো। ঘটনার দিনেও দরবারে তার সঙ্গে ছিল। আমরা পরে জানতে পেরেছি, শাকিল আহমেদের সঙ্গেই তাকে হত্যা করা হয়।
এদিকে এ দিনটি উপলক্ষে গতকাল জুম্মাবার পিলখানায় নিহত বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদস্যদের স্মরণে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. মোহসিন রেজা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছেন। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ২৫ ফেব্রুয়ারি শহীদ ব্যক্তিবর্গের রুহের মাগফিরাতের উদ্দেশ্যে বিজিবির সব রিজিয়ন, সেক্টর, প্রতিষ্ঠান ও ইউনিটের ব্যবস্থাপনায় বাদ ফজর খতমে কোরআন এবং বিওপি পর্যায়ে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হবে।
শনিবার সকাল ৯ টায় বনানী সামরিক কবরস্থানে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, স্বরাষ্ট্র সচিব এবং বিজিবি মহাপরিচালক শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এছাড়া শহীদদের স্মরণে আজ বাদ আসর পিলখানার বীর উত্তম ফজলুর রহমান খন্দকার মিলনায়তনে মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ