Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আরও একজন গ্রেফতার : হত্যার সমন্বয়কারী চন্দন ভারতে

| প্রকাশের সময় : ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র কাদের খানের বাড়ি থেকে উদ্ধার
সুন্দরগঞ্জ উপজেলা সংবাদদাতা : গাইবান্ধা-১ সুন্দরগঞ্জ আসনের সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যা ঘটনায় গ্রেফতারকৃত হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ও অর্থ যোগানদাতা জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি কর্ণেল (অব.) ডা. আবদুল কাদের খানের ছাপড়হাটী ইউনিয়নের পশ্চিম ছাপড়হাটী (খানপাড়া) গ্রামের বাড়ির মাটির নিচ থেকে একটি পিস্তল, ৬ রাউ- গুলি ও একটি ম্যাগজিন উদ্ধার করেছে পুলিশ। এছাড়া হত্যার সাথে সম্পৃক্ত আরও ১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
গত বুধবার বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাদের খানের কয়েকটি পুকুর সেচ দিয়ে ও ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দলের সাহায্যে তল্লাশি  চালিয়ে অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। অবশেষে দিবাগত রাত ১টার দিকে কাদের খানকে কড়া পুলিশ প্রহরায় তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলে তার তথ্য মতে বাড়ির ভিতর উঠানের উত্তর পার্শ্বে প্রাচীরের নিকট মাটির নিচে পুঁতে রাখা ৬ রাউন্ড গুলি ভর্তি ১টি ম্যাগজিনসহ একটি পিস্তল ও একটি ফাঁকা ম্যাগজিন উদ্ধার করে পুলিশ। অস্ত্র উদ্ধারের পর থেকে লিটন হত্যার পরিকল্পনাকারী ও কিলারদের অর্থ যোগানদাতা আব্দুল কাদের খানের ছাপড়হাটীস্থ গ্রামের বাড়িটি জনশূন্য অবস্থায় পুলিশ পাহারায় রয়েছে। সেখানে আরও অস্ত্র উদ্ধারের সম্ভাবনা থাকায় সংবাদকর্মীসহ কোন মানুষকে বাড়ির ভিতর এমনকি বাইরের উঠানেও প্রবেশ করতে দিচ্ছে না কর্তব্যরত পুলিশ। বাড়িতে প্রহরারত পুলিশের এসআই রফিকুল ইসলাম ও এএসআই গোলাম মোস্তফা জানান, পরবর্তী তল্লাশিসহ উদ্ধার অভিযান পরিচালনা না হওয়া পর্যন্ত বাড়ির ভিতর বা বাইর উঠানে কাউকে প্রবেশ করতে না দেয়ার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ রয়েছে। এর আগে, গত বুধবার দুপুর থেকে রংপুর রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি বশির আহম্মেদের নেতৃত্বে পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম, সুন্দরগঞ্জ থানা অফিসার ইনচার্জ আতিয়ার রহমানসহ পুলিশের একটি দল ও ফায়ার সার্ভিসের ২টি ইউনিট পুরো বাড়ি ঘিরে রেখে তল্লাশি চালায়। থানার অফিসার ইনচার্জ আতিয়ার রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘কর্ণেল আবদুল কাদের খানের দেয়া তথ্য অনুযায়ী তার বাড়ির ভিতর উঠানের উত্তর দিকের প্রাচীর সংলগ্ন স্থানে মাটির নিচে পুঁতে রাখা ৬ রাউন্ড গুলি ভর্তি একটি পিস্তল ও একটি খালি ম্যাগজিন উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার হওয়া পিস্তলটি কিলাররা এমপি লিটন হত্যাকা-ে ব্যবহার করেছিল বলেও জানান তিনি। এমপি লিটন হত্যায় ব্যবহৃত তিন ধরনের অস্ত্রের মধ্যে কর্ণেল কাদের খান একটি পিস্তল ও ১০ রাউন্ড গুলি আগেই থানায় জমা দেয়া হয়। এ নিয়ে লিটন হত্যায় ব্যবহৃত ৩টি অস্ত্রের মধ্যে দুটি অস্ত্র উদ্ধার হল। অন্য অস্ত্রটিও উদ্ধার করতে পুলিশ তৎপর রয়েছে। এদিকে গত বুধবার রাতে এমপি লিটন হত্যার সাথে সম্পৃক্ত থাকায় উপজেলার  শ্রীপুর ইউনিয়নের ভেলারায় গ্রামের তমছের আলীর পুত্র আনারুল ইসলাম রানাকে তার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করেন সুন্দরগঞ্জ থানা পুলিশ। গ্রেফতারের বিষয়টিও সুন্দরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ আতিয়ার রহমান নিশ্চিত করেন। গতকাল (বৃহস্পতিবার) কাদের খানের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়- বাড়িটি পুলিশের পাহারায় রয়েছে। এসময় গাইবান্ধা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম জানান, তথ্য পাওয়া গেলে আবারও অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চালানো হবে। এদিকে এমপি লিটনের কিলার গ্রেফতারকৃত শ্রীপুর ইউনিয়নের ভেলারায় গ্রামের তমছের আলীর পুত্র আনারুল ইসলাম রানা, উত্তর সমস গ্রামের আব্দুল করিম ওরফে আকরামের পুত্র রাশেদুল ইসলাম মেহেদী, ওসমান গণির পুত্র শাহিন মিয়ার এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে জানা যায় তারা সকলেই উচ্ছৃংখল স্বভাবের। এরা সকলেই গত ৬ মাস থেকে বাড়িতে তেমন একটা ছিল না।
এলাকায় স্বস্তি
এমপি লিটন হত্যার খুনিরা ধরা না পড়ায় সুন্দরগঞ্জের বিভিন্ন দলীয় নেতা-কর্মী, সমর্থক ও শান্তি প্রিয় লোকজন অস্বস্তিতে ছিল। তারা এই খুনিদের সুন্দরগঞ্জের জন্য হুমকি মনে করলেও খুনিরা ধরা পড়ায় তাদের মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছে। খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, এলাকার শান্তিপ্রিয় সাধারণ জনগণ আর বাড়ির বাইরে ঘুমায় না। তবে জামায়াত-শিবিরের মামলাভুক্ত আসামীরা এখনো পালিয়েই রয়েছেন। এমপি হত্যায় সন্দেহজনক গ্রেফতারকৃত আসামীদের পরিবারের মাঝেও কিছুটা হলেও শান্তি ফিরে এসেছে। গ্রেফতারকৃত সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আহসান হাবিব মাসুদ ও মিসকিন মুকুলের পরিবারের লোকজন জানান, লিটন হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ও খুনি ধরা পড়ায় তারা স্বস্তিতে রয়েছেন।   
হত্যার সমন্বয়কারী চন্দন ভারতে
এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যার প্রধান সমন্বয়কারী ছিলেন চন্দন কুমার সরকার। দীর্ঘদিনের অপমানের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে মনে-মনে এমপি লিটনকে হত্যার স্বপ্ন দেখছিল উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের পূর্ব মনমথ গ্রামের সুশিল কুমার সরকারের ছেলে চন্দন কুমার সরকার। এরই একপর্যায়ে স্বপ্ন বাস্তবায়নের আশা প্রকাশ করে জাপার সাবেক এমপি অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল ডাঃ আব্দুল কাদের খান। দুইজন মিলে পরিকল্পনা করতে থাকেন এমপি লিটন হত্যার। অবশেষে তা বাস্তবায়ন করেন গেল বছরের ৩১ ডিসেম্বর।
কে এই চন্দন সরকার
বামনডাঙ্গা ইউনিয়ন আ’লীগের দপ্তর সম্পাদক চন্দন কুমার সরকার। রাজনীতিতে আসার আগে ঢাকার একটি অনলাইন পত্রিকায় সাংবাদিকতা করত। দুই বছর সাংবাদিকতা করে বাড়িতে ফিরে এসে রাজনীতিতে যোগ দেন। অল্প সময়ে এমপি লিটনের আস্থাভাজন হয়ে উঠেন। চলাফেরার একপর্যায় চন্দনকে চরমভাবে লাঞ্ছিত করে এমপি লিটন। শুরু হয় ক্ষোভ। এরপর থেকে এমপি লিটনের যাবতীয় কর্মকা-ের চিত্র তুলে ধরে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করতে থাকেন চন্দন। বেশ কয়েকটি অভিযোগ ইতোমধ্যে তদন্ত হয়েছে। সর্বশেষ গত অর্থ বছরে এমপির বিরুদ্ধে ১ কোটি টাকার দুর্নীতি অভিযোগ করেন দুদকে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত বছরের নভেম্বর মাসে উপজেলা বঙ্গবন্ধু চত্বরে দুর্বৃত্তদের হাতে গুরুতর আহত হন চন্দন। এনিয়ে এমপি লিটনকে আসামি করে থানায় মামলা করতে যান চন্দন। কিন্তু পুলিশ মামলা নেয়নি। চন্দন কুমার সরকারের গতি থামানোর জন্য জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে একটি মামলার আসামি দেখিয়ে তাকে গ্রেফতার করে জেল-হাজতে পাঠিয়ে দেন এমপি লিটন। পরবর্তীতে মামলাটি ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়। এসব পুঞ্জিভূত অপমানের প্রতিশোধ নিতে লিটন হত্যার পরিকল্পনায় আব্দুল কাদের খানের সাথে এক হয়ে যায় চন্দন। লিটন হত্যার পর চন্দন কুমার ভারতে চলে যায়। নাম প্রকাশ না করা শর্তে মনমথ গ্রামের একজন জানান-লিটন হত্যার পরদিন চন্দন ভারতে চলে যায়। বাড়ির লোকজন এবং প্রতিবেশীদের নিকট থেকে বিষয়টি জেনেছেন তিনি। তিনি আরও বলেন-চন্দন রাতে একজন লোককে মোবাইল- ফোনে বলছিল আমাকে অপমান করার শোধ মিটে গেছে। বৃহস্পতিবার চন্দনের বাড়ি গিয়ে দেখা গেছে পরিবারের কোন সদস্য নেই। বাড়ি-ঘরে তালা ঝুলছে।
ক্ষোভও ছিল কাদেরের
শুধু ক্ষমতার লোভে নয়, এমপি লিটনের প্রতি ক্ষোভও ছিল আব্দুল কাদের খানের। মহাজোটের শরিক দল হিসেবে ২০০৮ সালে লিটনকে ডিঙ্গিয়ে আব্দুল কাদের খান মনোনয়ন নিয়ে এমপি নির্বাচিত হন। এমপি হওয়ার পর থেকে আব্দুল কাদের খানের যাবতীয় প্রকল্পের বিরুদ্ধে দুর্র্নীতির অভিযোগ এনে বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেন এমপি লিটন। এ কারণে আব্দুল কাদের খানকে দুর্নীতি দমন কমিশনে তলব করা হয়েছিল। এসব ঘটনাও রয়েছে এমপি লিটন হত্যার কারণ। সব মিলে চন্দনের অপমানের প্রতিশোধ এবং আব্দুল কাদের খানের ক্ষমতার লোভে খুন হয়েছেন এমপি লিটন। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে-খুনের পরিকল্পনার মূল সমন্বয়কারী ছিলেন চন্দন কুমার। দীর্ঘদিন থেকে চন্দন কুমার আব্দুল কাদের খানের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে পরিকল্পনা মাফিক খুন করে এমপি লিটনকে।
রিমান্ডের প্রথম দিন
এমপি লিটন হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী জাপার সাবেক এমপি আব্দুল কাদের খানের ১০ দিনের রিমান্ডের প্রথম দিন জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে পুলিশ। মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শন আশরাফুজ্জামান জানান, আব্দুল কাদের খানের তথ্য মতে পিস্তল ও গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। পাশাপাশি হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত পলাতক রানা মিয়াকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ