ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
এবি সিদ্দিক : খেলাপি ঋণের দায়ে নিলামে উঠতে চলেছে নয়াপল্টনে অবস্থিত বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়। ঢাকার অর্থঋণ আদালত নিলামের উদ্যোগ প্রায় চ‚ড়ান্ত করে ফেলেছে। ব্যাংক সূত্র জানায়, ১৯৯৬ সালে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ওই আদালতে মামলাটি দায়ের করা হয়। এ সময়ের মধ্যে ঋণগ্রহীতা দুবার উচ্চ আদালতে রিট করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে মামলার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। সর্বশেষ স্থগিতাদেশ কিছু দিনের মধ্যে উঠে যাবে। তখন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিএনপি কার্যালয় নিলামে তুলে তার পাওনা আদায় করবে। খবরটি বেশ মজার। কিছু দিন আগে সরকারের কিছু দায়িত্বশীল ব্যক্তির মুখে শোনা গিয়েছিল, নিরাপত্তার স্বার্থে গুলশান এলাকায় কোনো রাজনৈতিক দলের অফিস রাখা হবে না। বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয় গুলশানে। এদিকে জিয়ার মাজার সরিয়ে ফেলার কথা হচ্ছে। সরকার হয়তো সেটাই করবে। বিএনপি এখন মাঠে নেই। গৃহবন্দি রাজনৈতিক দল। জনগণের ভোটে নির্বাচিত দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা এই দলটিকে কোনো সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং করতে দেয়া হয় না। গুলশান আর নয়াপল্টন অফিস এবং জিয়ার মাজার পর্যন্তই বিএনপির দৌড়। এখন মাজার আর অফিস না থাকলে? হায়রে বিএনপি! বিএনপির নেতারা বলেন, ‘বিএনপি গণমানুষের দল বা সাধারণ মানুষের দল’। এ প্রসঙ্গে আমার একটি কথা মনে পড়ে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের সময় আমাদের কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার কাজিরগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে স্বামী-স্ত্রী ভোট দিতে গেছে। স্ত্রী যখন ভোট দিয়ে বের হলো তখন স্বামী জিজ্ঞেস করলো, ‘কি মার্কায় ভোট দিসস (এলাকার ভাষা), স্ত্রী বললো, ধানের শীষে’। সাথে সাথে শত শত মানুষের সামনে স্ত্রীকে তালাক দিল স্বামী। কারণ স্বামী আওয়ামী লীগ করে। জিয়াউর রহমান সাধারণ মানুষের খুব কাছাকাছি গিয়েছিলেন। যার ফলে জিয়ার বিএনপির প্রতি সাধারণ মানুষের এত সমর্থন। আমি ছিলাম জিয়ার স্বনির্ভর কর্মসূচির একজন কর্মী। কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুর, শেরপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় স্বনির্ভর প্রশিক্ষক হিসেবে ক্যাম্প পরিচালনা করেছি। জিয়ার সাথেও ঘুরেছি। এখনও অনেক কথা আর স্মৃতি মনে পড়ে। নেত্রকোনার বিএনপি নেতা আবু আব্বাস জনসভার মঞ্চে স্যুট পরে উঠে পড়েছিলেন। জিয়া তখন বলেছিলেন, আব্বাস সাহেব, টাই আর স্যুট পরে সাধারণ মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করা যায় না। কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মারিয়া ইউনিয়নের উথারিয়া খাল খনন উদ্বোধনীর সময় খাল পাড় দিয়ে পূর্বদিকে কিছু দূর হেঁটে গেলেন জিয়া। দেখলেন, এক বাড়ির লেবু গাছে প্রচুর লেবু ঝুলছে। তিনি দুটি লেবু তুললেন। এরপর এই লেবু নিয়ে বাড়ির উঠানে গিয়ে ডাকতে শুরু করলেন কে আছেন বাড়িতে ? আমি ও আরেক স্বনির্ভর কর্মী আনোয়ার জিয়ার খুব কাছেই তখন। বের হলেন বাড়ির মহিলা। জিয়া বললেন, এই লেবু দিয়ে এক গøাস সরব করে দেবেন? মহিলা অবাক! জিয়ার উদ্দেশে মহিলা বললেন, ‘আনহে খাড়ন (আপনি দাঁড়ান) আমি সরবত দিতেচি। গুড় আর লেবু, একটু লবণ, হয়ে গেল সরবত। পান করলেন, জিয়া বললেন আরেক গøাস দেবেন? খাল থেকে দোন (কিশোরগঞ্জের ভাষায় কুন) দিয়ে এক বয়স্ক কৃষক বোরো বীজতলায় পানি দিচ্ছে। জিয়া খুব মনের আনন্দে পানি তুলতে গেলেন। তিনি যেই বাঁশে পা রাখলেন, সাথে সাথেই পা ফসকে পড়ে গেলেন। রাস্তার পাশে (কিশোরগঞ্জ-পাকুন্দিয়ার সড়কের মারিয়া নামক স্থানে) কত মানুষ ! আর অনেক ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। জিয়া পানিতে পড়ে যেতেই ছেলেমেয়ের হুল্লোড়, চিৎকার আর হাততালি। বিব্রত জিয়া উঠে এসে জিপে চড়ে কালিয়াচাপড়া চিনিকলের ডাকবাংলায় গোসল করলেন (পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি ছিল)। খেতে গেলেন, দেখলেন, খাবার টেবিলে বিরাট আয়োজন। দেখে ক্ষুব্ধ হলেন তিনি। নজরে পড়লো বড় কৈ মাছের ভাজি আর সিং আর ডাঁটার তরকারি। দুটি ভাজি দিয়ে এক প্লেট ভাত খেলেন। আর আবার সিং মাছের তরকারি দিয়েও অল্প ভাত খেলেন। তবে ক্ষোভ রয়েই গেল। ডাকতে শুরু করলেন, ম্যানেজার কোথায়? পাশেই ছিলেন প্রশাসনিক কর্তকর্তা ইঞ্জিল উদ্দিন আহমেদ। বয়স্ক মানুষ কিছুটা ভয়ও পেলেন। জিয়া বললেন আপনি ম্যানেজার? চিনিকল কি লাভে চলছে না লোকসানে? উত্তর-স্যার লোকসানে চলছে। জিয়া বললেন, আগামী বছর লাভ দেখতে চাই। হ্যাঁ, লাভই হয়েছিল পরের অর্থবছরে। এই তো জিয়া যিনি, সাধারণ মানুষের খুব কাছাকাছি ছিলেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ফকির আশরাফের স্ত্রী বাণী আশরাফ ছিলেন বিএনপির তখনকার একজন কর্মী। জিয়ার এক অনুষ্ঠানের শেষে খাবার টেবিলে যখন জিয়া ডাঁটার শাক আর সিং মাছের ঝোল দিয়ে খাচ্ছিলেন, তখন বাণী আশরাফের মুখ দিয়ে বের হলো, এই বুঝি প্রেসিডেন্টের খাবার। আমি তখন বলেছিলাম, বাণী আস্তে বলুন। যাক সেসব কথা। অনেক কথা, অনেক স্মৃতি আজও মনে পড়ে। আজ কোথায় জিয়ার আদর্শ আর একি হাল জিয়ার দলের ! বিএনপির আজকের অবস্থায় আওয়ামী লীগ খুবই খুশি। আওয়ামী লীগ বিএনপিকে ঘরে ঢুকিয়ে বেশ আনন্দে আর স্বস্তিতেই আছে। আওয়ামী লীগ ও তার শরিক দলগুলোর নেতারা বিএনপিকে উদ্দেশ করে কত কথাই না বলছেন। কেউ কেউ কৌতুকের মতো, কেউবা ব্যঙ্গাত্মক, কেউবা রসিকতার সুরে বিএনপির উদ্দেশে কথা বলছেন। আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা ক’দিন আগে বলেছেন, খালি মাঠে খেলতে ভালো লাগে না। মাঠ তো খালিই করেছেন। কথা উঠছে খালেদা জিয়া জেলে যাবেন। বিএনপি ভেঙে যাবে আরো কত কিছু। আগামী নির্বাচন কেমন হবে তা সচেতন নাগরিকরা বুঝতেই পারছেন। ইসি গঠনে অনুসন্ধান কমিটি, কমিটি কর্তৃক সুপারিশকৃত ইসি নিয়োগ সবই হয়েছে আওয়ামী লীগের মতো করেই। আওয়ামী লীগ জোর গলায় বলছে যে, আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে। হয়তো বা নেবে। কেউ কেউ বলছেন, বিএনপির অস্তিত্ব বজায় রাখতেই নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। হয়তো বা তাই। আমি কোনো রাজনৈতিক গবেষক বা বিশ্লেষক নই। কাজেই এত কিছু বুঝিও না। আমার মনে একটা কথাই বারবার জেগে ওঠে যে, কেন বিএনপির এ অবস্থা? কেউ কেউ বলেন, বিএনপির নেতা আছে কর্মী নেই, কেউবা বলেন, কর্মী আছে নেতা নেই। আমার ধারণাটা হয়তোবা ভুল হতে পারে তবু বলছি, বিএনপির যোগ্য নেতৃত্বের অভাব আছে। নেতারা এক একজন নিজেকে অনেক পন্ডিত মনে করেন, এক একজন এক এক মত পোষণ করেন। যেসব নেতার টাকা আছে তারা তাদের টাকা-পয়সা দলের জন্য খরচ না করে আগলে রাখার চেষ্টা করেন। সময়মতো মাঠে নামেন না। রাজনৈতিক অবস্থা খারাপ হলে গা-ঢাকা দেন বা অসুখের নামে বিদেশ পাড়ি জমান। বিএনপির নেতারা বিনা শ্রমে রসগোল্লা খেতে পছন্দ করেন বলেও অনেক রসিকজন বলে থাকেন। আমার জানা মতে, বেশির ভাগ টাকাওয়ালা, ব্যবসায়ী নেতা এখন চুপচাপ। একজন ব্যবসায়ী নেতা ক’দিন আগে বললেন, ভাই এখন সময় ভালো না, আমি আমার ব্যবসা বন্ধ করতে চাই না। কি সুন্দর কথা ! ক্ষমতায় থেকে কামাইলেন, এখন খরচ করবেন না। এক পন্ডিত নেতা বললেন, আরে অপেক্ষা করেন, অচিরেই আমরা ক্ষমতায় আসব। আরেক বিশিষ্ট পন্ডিত (উনার পেশাটার কথা বলব না, নামও বলছি না) কিছু দিন পর পর গাড়ির মডেল পাল্টান। বিএনপিপন্থি একটি সংগঠনের নেতাও বটে। তিনি বিএনপির অনেক ক্ষতি করেছেন। আমাদের পেশার একজন নেতা কয়েক দিন আগে বললেন, ম্যাডাম ডেকে নিয়ে ধমক দিয়েছে। আমি আর বিস্তারিত বলতে চাই না। উনার মতো ক্ষতিকর প্রাণী আরো অনেকই আছেন। যাক সেসব কথা। বিএনপির একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য (খুবই ভদ্রলোক বটে) আমাকে বললেন, কি সিদ্দিক সাব, আমাদের ভবিষ্যৎ কী? আমি বললাম স্যার সময়ই সব বলে দেবে। বিএনপির সময় ভালো না। আওয়ামী লীগের নেতারা প্রায়ই বলে থাকেন, আওয়ামী লীগকে আন্দোলনের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। আন্দোলন কত প্রকার ও কী কী তা আওয়ামী লীগ জানে। কথাটা তো শতভাগ সত্য। কারণ, আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হওয়ার দল বিএনপি নয়। আওয়ামী লীগ রাতকে দিন আর দিনকে রাত করতে পারে। তার খুঁটির জোর আছে, সাংগঠনিক কাঠামো মজবুত, কর্মীদের প্রতি নেতাদের সুদৃষ্টি আছে, নেতা-কর্মীরা রাজপথে থাকার যোগ্যতা রাখে। গণতন্ত্রকে শুধু নির্বাসনে নয়, ক্ষমতায় টিকে থাকা আর ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সব কিছুই করতে পারে দলটি। তবে সব কথার শেষ কথা হলো, দেশে যদি কখনও অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় তা হলে কী হবে, সেটাও আওয়ামী লীগ ভালো করেই জানে।
লেখক : সাংবাদিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।