ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
আজহারুল আজাদ জুয়েল : দৌলতপুরের গৃহবধূ মিনতি রানী এখন সুখি মানুষ। নিজে লেখাপড়া করতে না পারলেও পড়াতে পারছেন সন্তানদের, তাই সুখি তিনি। তার দুই ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে তপন কুমার কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ে, মেয়ে সুচিত্রা রায় রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ^বিদ্যালয়ে এবং ছোট ছেলে সুমন কুমার গ্রামের একটি স্কুলে ১০ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। তিন সন্তানের সবাইকে পড়াতে পারছেন বলে একজন সফল জননীর স্বীকৃতি পেয়েছেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত জয়িতা অন্বেষণ কর্মসূচিতে। লাভ করেছেন উপজেলা পর্যায়ে জয়িতা-২০১৬ পুরস্কার।
‘আমারো পড়ার ইচ্ছা ছিল, বাবার আগ্রহ ছিল না। বাবা বলতেন, বিয়ে তো দিতেই হবে, অত পড়ার দরকার কি? তিনি বিয়ে দিলেন। ক্লাস সিক্সে পরীক্ষা দিছি আর আমার বিয়ে হলো! পড়া হলো না।’ জানালেন মিনতি। তার পড়ার অদম্য আগ্রহ ছিল। মেধাবী ছিলেন। পুজোর প্রদীপ ও চাঁদের আলোয় লেখাপড়া করে ৫ম শ্রেণীতে বৃত্তি পেয়েছিলেন। তবুও তার পড়া হলো না। নিজের জীবনের যে বেদনা আজ তা ভুলেছেন সন্তানদের ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত নিয়ে যেতে পেরে।
আরেকজন সুখি নারী সাবিত্রি রায়। একদিন খেয়ে না খেয়ে, প্রতিনিয়ত দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিন কাটিয়েছেন। এখন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মধ্যে আছেন। গার্মেন্ট পণ্য তৈরি করে ব্যবসা করছেন। একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে অর্থনৈতিক ক্যাটাগরিতে জয়িতা পুরস্কার লাভ করেছেন ২০১৬ সালে। দ্বীপা রায়, রত্মা রায়, রঞ্জনা রানী। মিনতি, সাবিত্রিদের মত সুখি মানুষ তারাও। তাদের কেউ শিক্ষক, কেউ কৃষক। সকলের আর্থ-সামাজিক, সংস্কৃতিক ও পরিবেশগত উন্নয়ন হয়েছে এবং সবাই এখন সুখে আছেন।
মিনতি, সাবিত্রিরা হলেন দৌলতপুর গ্রামের অধিবাসী। যাকে আদর্শ গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে পল্লীশ্রী নামের একটি সংস্থা। তাই এর নাম রাখা হয়েছে দৌলতপুর আদর্শ গ্রাম। এই গ্রামের মেয়েরা আনন্দ-বিনোদনে সময় কাটায়, নিজের ও পরিবারের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে এবং মানুষের কল্যাণে কাজ করে, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সক্রিয় থাকে, স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়, সন্তানদের শিক্ষিত করার ব্রত নেয় এবং নারীর প্রতি সংিসতা বন্ধে উদ্যোগী থাকে। এ যেন অন্য রকম এক গ্রাম।
পল্লীশ্রী হলো দিনাজপুরের বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান, যারা নারী নির্যাতন বন্ধে ও নারীর প্রতি সহিংসতা মুক্ত সমাজ গঠনে কাজ করছে দীর্ঘদিন ধরে। সংগঠনটি দৌলতপুরসহ দিনাজপুরের ছয় উপজেলার ২৫টি গ্রামকে আদর্শ গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে নারীর প্রতি সহিংসতা মুক্ত সমাজ গঠণের লক্ষে।
দৌলতপুর দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলা সদর হতে দুই কিলোমিটার দূরের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। আর সব গ্রামের মত এ গ্রামেও আছে মেঠোপথ, সবুজ ক্ষেত, পুকুর, দিঘি, মাটির-খরের-ইটের ঘরবাড়ি। কিন্তু এই গ্রামের মেয়েদের মধ্যে অনাবিল আনন্দ আর সুখের যে ফোয়ারা তা হয়ত আর সব সাধারণ গ্রামে নেই। মিনতি বলেন, ‘আমরা সন্তানদের যেন উচ্চ শিক্ষা দেই, মেয়েকে অল্প বয়সে বিয়ে না দেই সেই সেই সব ধারণাগুলো পল্লীশ্রীর আপারা দিয়েছে। তারা আমাদের সুখে-শান্তিতে রাখার যে সকল পদক্ষেপ নিয়েছে তা আমাদের জীবনধারা পাল্টে দিয়েছে।’
দৌলতপুর আদর্শ গ্রামের নিজস্ব কার্যালয় আছে। এ কার্যালয়ে পরিচালিত হয় নারী ক্লাব, কিশোর-কিশোরী ক্লাব, যুব ক্লাবের কার্যক্রম। এখানে আদর্শ গ্রাম কমিটি ও ক্লাব কমিটিগুলো মাঝে মাঝে মিটিং, সভা করে থাকে এবং গুরুত্বপুর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। কার্যালয়টি গড়ে উঠেছে গার্মেন্টস ব্যবসায়ী সাবিত্রির জায়গার উপর। এর জন্য তিনি কোন ভাড়া নেন না। এই কার্যালয়ে নারী ক্লাব ও কিশোর-কিশোরী ক্লাবের সদস্যরা কখনো যৌথভাবে, কখনো আলাদাভাবে সভা, সচেতনতা সৃষ্টিমূলক সভা, অনুষ্ঠান, বিনোদন, গান-বাজনা, নাটিকা ইত্যাদি করে থাকেন।
খবর নিয়ে জানা যায়, নারী নির্যাতন প্রতিরোধের লক্ষ্য নিয়ে পল্লীশ্রী দিনাজপুরসহ দেশের ৭টি জেলায় কাজ করছে। নারীর প্রতি সহিংসতামুক্ত গ্রাম গঠণের লক্ষ্যে ‘নিজেদের গ্রাম নিজেরা’ গড়ি শ্লোগান দিয়ে আদর্শ গ্রাম কর্মসূচি হাতে নিয়েছে ২০০৯ সালে, যার সূচনা হয়েছিল চিরিরবন্দরের ব্রম্মপুর গ্রামে। পর্যায়ক্রমে এই কর্মসূচি ছড়িয়েছে কাহারোলের দৌলতপুর, বনড়া, রামচন্দ্রপুর, সুন্দইল, বীরগঞ্জের মাঝবোয়াল, চৌপুকুরিয়া, চকমহাদেব, ব্রাম্মভিটা, বিরলের ঢেলপীর, দামাইল, কাশিজঙ্গা, ভগবানপুর, দিনাজপুর সদরের নিশ্চিন্তপুর, গোয়ালপাড়া, সব্জীবাগান, মিয়াজীপাড়া, বড়মনিপুর, চিরিরবন্দরের শিবকুড়ি, ব্রম্মপুর, অমরপুর, বাসুদেবপুর, ফুলবাড়ীর পাকাপান, সূর্যপাড়া, জামাদানী ও মুক্তারপুর গ্রামে। এই সব লক্ষ্য অর্জনে গৃহীত কর্মসূচিতে নারী-পুরুষ সবাই অংশ নিয়ে থাকেন। তবে মেয়েদের অংশগ্রহণ বেশি থাকে।
পল্লীশ্রীর নির্বাহী প্রধান শামীম আরা জানান, আদর্শ গ্রামগুলোতে ১০-১২ বছর আগে পল্লীশ্রী প্রথমে ছোট ছোট দল গঠন করে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলের ভেতরে মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের চেষ্টা চালানো হয়। এরই এক পর্যায়ে আদর্শ গ্রাম কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। আদর্শ গ্রাম সম্পূর্ণরূপে পল্লীশ্রীর নিজস্ব উদ্ভাবিত একটি কর্মসূচি। যে গ্রামের শতভাগ শিশু স্কুলে যায়, শতভাগ শিশুর জন্মনিবন্ধন হয়, শতভাগ বিয়ে রেজিস্ট্রেশন হয়, শতভাগ মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার ও বিশুদ্ধ পানি পান করে, যে গ্রামে বাল্য বিয়ে ও নারী নির্যাতন হয় না, নারীর প্রতি সহিংসতা মুক্ত গ্রাম গঠনে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল মানুষ সংবেদনশীল থাকেন ও কার্যকর ভূমিকা রাখেন। আমরা মনে করি যে, এমন গ্রাম হলো আদর্শ গ্রাম। আমরা এই রকম গ্রাম গঠনের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। যৌথ পরিবারে পারস্পরিক বন্ধনের মধ্যে বসবাস করা ও মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানো আমাদের সমাজের ঐতিহ্য। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এগুলো এখন ভেঙ্গে যাচ্ছে। আদর্শ গ্রাম কর্মসূচির মাধ্যমে সেই ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা মুক্ত পরিবেশ তৈরি ও মূল্যবোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে। বিশ্বাস করা যায়, মানুষ যখন নিজেদের গ্রাম নিজেরা গড়ার চেষ্টা করবে তখন নারীর প্রতি সহিংসতাও বন্ধ হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।