Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

ভুয়া সনদে চাকরিজীবন পার করেও মুক্তিযোদ্ধার সকল সুবিধা নিচ্ছেন কুমিল্লার জাহাঙ্গীর

| প্রকাশের সময় : ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সাদিক মামুন, কুমিল্লা থেকে : অবাক হলেও সত্যি যে, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ দিয়ে মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে বিভিন্ন বড় পদে চাকরি করে ব্যাপক সুবিধা ভোগ করেছেন। অর্জন করেছেন জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল ওই ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় সচিব বরাবর তদন্ত প্রতিবেদনও জমা দিয়েছিলেন। কুমিল্লা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সভাতে ওই ব্যক্তি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন এমন তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন হওয়ার পর বিষয়টি মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়। সরকারের বিভিন্ন সংস্থাও ওই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে তদন্ত করেছে। কিন্তু দিন মাস বছর গড়িয়েছে। একের পর এক পদোন্নতি পেয়ে পার করেছেন চাকরিজীবন। অবসরে এসেও ভোগ করছেন মুক্তিযোদ্ধার সকল সুযোগ-সুবিধা। আলোচিত এ ব্যক্তিটি হলেন কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার শশীদল গ্রামের এস এম শাহজাহানের ছেলে এস এম জাহাঙ্গীর আলম। যিনি গত বছর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর কমিশনারের (কর আপীল অঞ্চল-৪, ঢাকা) পদ থেকে অবসর নিয়েছেন।
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদের মাধ্যমে মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে জাহাঙ্গীর আলম প্রথমে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের কর বিভাগে অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পান। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা কোটার বদৌলতে ১৯৯১ সালের শেষের দিকে সহকারী কর কমিশনার পদে পদোন্নতি পান। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় তার পদোন্নতি পাবার বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। আর সেই আলোচনার পথ ধরে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতির অভিযোগ উঠে। ২০০২ সালের ১ জুলাই ওই অভিযোগের অনুসন্ধানের জন্য চিঠি পাঠানো হয় কুমিল্লা জেলা প্রশাসক তারিক-উল-ইসলামের কাছে। শুরু হয় তদন্ত। জেলা প্রশাসন থেকে বিষয়টির তদন্তভার দেয়া হয় কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার তৎকালীন নির্বাহী অফিসার শাহ মো. আবু রায়হান আলবেরুনীকে। তিনি বিষয়টির তদন্তকালে ব্রাহ্মণপাড়ার স্থানীয় জনগণ ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কতিপয় বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের বক্তব্য গ্রহণ করেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের তদন্তে যুদ্ধকালীন কমান্ডার আবদুল বারিক বীর বিক্রম, ব্রাহ্মণপাড়া মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের আহŸায়ক ইদ্রিস মিয়া, মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম, মুক্তিযোদ্ধা ছালেহ আহাম্মদ, কুমিল্লা জেলা কমান্ডের সহকারী কমান্ডার সহিদুল ইসলামসহ আরো অনেকের বক্তব্যে এস এম জাহাঙ্গীর আলম প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নয়, সে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি, জালিয়াতি করে সে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নিজের নাম লিখিয়েছে এমনসব বিষয় উঠে আসে। পরে ২০০২ সালের ২ সেপ্টেম্বর উপজেলা নির্বাহী অফিসার তদন্তে এস এম জাহাঙ্গীর আলম একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নয় বলে উল্লেখ করে জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন প্রেরণ করেন।
ড. এসএম জাহাঙ্গীর আলম নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা জাহির করে চাকরিজীবনে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেছেন। বাগিয়ে নিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্রের সাধারণ সম্পাদকের পদ, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভাইস চেয়ারম্যান ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পদ। ২০০২সালের আগস্ট মাসে তার বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্রের ৪৭ লাখের বেশি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পেয়ে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো বাদী হয়ে একটি মামলাও করে। ২০০৩ সালে হাইকোর্ট ওই মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে। জাহাঙ্গীর আলম কৌশলে নিজেকে আড়াল রাখে তার বিরুদ্ধে আনা বিভিন্ন অভিযোগ থেকে। তদবির করে যুগ্ম কর কমিশনার হওয়ার পর কর কমিশনার (কর আপিল অঞ্চল-৪, ঢাকা) পদোন্নতিও পেয়ে যায় ওই বিতর্কিত ব্যক্তিটি। অথচ এই জাহাঙ্গীর আলম বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে ২০০৩ সালে জিয়া সাংস্কৃতিক সংগঠন (জিসাস) কর্তৃক জিয়া স্বর্ণপদকে এবং পরের বছরে জাতীয় যুব সাংস্কৃতিক সংস্থা (যুসাস) কর্তৃক স্বর্ণপদকে ভ‚ষিত হন। তখন তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উপ-কর কমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন। জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাঅধিদফতর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগও তদন্ত করেছে। এসব তদন্ত প্রতিবেদনে জাহাঙ্গীর আলমের ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ, অবৈধ সরকারি সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ এবং চাকরি দেয়ার নামে প্রতারণা ও জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্র্জনের অভিযোগ উঠে এসেছিল। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সাবেক সচিব খায়রুজ্জামান চৌধুরী বিভিন্ন সার্কেলে কর্মরত থাকাকালীন সময়ে জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে ২৭টি অভিযোগ তুলে ধরেন। মুক্তিযোদ্ধা ফাউন্ডেশন নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন কর কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম। এ সংস্থার নামে তিনি ভারতীয় দূতাবাস থেকে দুইটি অ্যাম্বুলেন্স গ্রহণ করেছিলেন। এনিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলে একটি অ্যাম্বুলেন্স চট্টগ্রামের একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দেন। আরেকটির হদিস মেলেনি।
এদিকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর আলমের বিষয়ে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রিয় কমান্ড কাউন্সিল থেকে চার সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটির তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর দাখিল করা হয়। ২০১২ সালের ২৬ আগস্ট পাঠানো প্রতিবেদনে তদন্ত আদালত মতামতে উল্লেখ করে- এস এম জাহাঙ্গীর আলম মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে চাকরিতে যোগদান করলেও তার নাম মুজিবনগর তালিকায় ছিল না। জাহাঙ্গীর আলম বিভিন্ন সময়ের সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তার নাম অন্তভুক্ত করতে সমর্থ হোন এবং সনদ সংগ্রহ করেন। সে অত্যন্ত চালাক প্রকৃতির হওয়ায় তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণের প্রক্রিয়া ব্যহত করেছে এবং চাকরির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধার সর্বাধিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছে। প্রতিবেদনে তদন্ত আদালতের সুপারিশে বলা হয়েছে- ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম যেহেতু মুক্তিযোদ্ধা নন, তাই তার নামে প্রকাশিত গেজেট, লাল মুক্তিবার্তার নম্বর ও গৃহীত সার্টিফিকেট বাতিল করা যেতে পারে এবং প্রতারণার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে চাকরির সুবিধা গ্রহণ করায় তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রিয় কমান্ড কাউন্সিল চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল অব. হেলাল মোর্শেদ খান বীরবিক্রম ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা এস এম জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণ করার ব্যাপারে তদন্ত আদালতের মতামত ও সুপারিশের সাথে একমত পোষণ করেন। এতসব অভিযোগের পরও নানারকম তদবির করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর কমিশনার (কর আপিল অঞ্চল-৪, ঢাকা) পদোন্নতি পান ড. এসএম জাহাঙ্গীর আলম। গত বছরের শেষের দিকে চাকরি থেকে অবসরে যান তিনি। মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার চাকরি করেছেন। পদোন্নতি থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রে নিয়েছেন সুযোগ-সুবিধা। অবসরে এসেও নিচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধার সকল সুবিধা। কুমিল্লার সকল মুক্তিযোদ্ধা সাবেক কর কমিশনার এস এম জাহাঙ্গীর আলমের নাম গেজেট থেকে বাদ দেয়া এবং মুক্তিযোদ্ধা শব্দকে কলঙ্কিত করায় তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ