ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
মুজিবুর রহমান মুজিব : বৃহত্তর সিলেটের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তবর্তী জেলা মৌলভীবাজার। সম্প্রতি এ জেলায় জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগদান করেছেন তোফায়েল ইসলাম। দীর্ঘদেহী-সুদর্শন ও স্পষ্টবাদী এই কর্মকর্তা ইতোমধ্যেই কথা ও কাজে সকল মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, প্রশংসাপ্রাপ্ত হয়েছেন। গত ৩ জানুয়ারি জেলাধীন কমলগঞ্জ উপজেলা সফর করছিলেন তিনি। রাস্তায় জটলা দেখে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে গাড়ি থেকে নামেন জেলা প্রশাসক তোফায়েল ইসলাম। দেখেন, সড়ক দুর্ঘটনায় একজন দরিদ্র মহিলা মৃত্যুবরণ করেছেন। দাফন-কাফনের জন্য এই দরিদ্র মহিলার নিকটাত্মীয় কেউ না থাকায় জেলা প্রশাসক স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়েই তাৎক্ষণিকভাবে আর্থিক সহায়তা দেন। কিন্তু দুর্ঘটনাজনিত অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ দাফনে আইনকানুনি জটিলতা ও বিধিনিষেধ আছে। প্রার্থিত মতে, বিশেষ ব্যবস্থায় দুর্ঘটনাজড়িত মামলা না করতে চাইলে জেলা প্রশাসক ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ দাফনের অনুমতি দিতে পারেন। সড়ক দুর্ঘটনাজনিত কারণে নিহত ওই দরিদ্র মহিলার কোনো স্বজন না থাকায় মামলা দায়েরে কেউই উৎসাহী ছিলেন না। হৃদয়বান তোফায়েল ইসলাম কমলগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে আদেশ দেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের সুপারিশসহ তিনি যেন তার কাছে লাশ ময়নাতদন্ত ব্যতীত দাফনের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন। সেই মর্মে ওসি কমলগঞ্জ স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের সুপারিশসহ আবেদনপত্রটি একজন পুলিশ কর্মকর্তা মারফত জেলা প্রশাসক মহোদয়ের কাছে পাঠালে তিনি যাবতীয় আমলাতান্ত্রিক বিধিবিধান, প্রথা-পদ্ধতি পরিহার করে কমলগঞ্জ থানাধীন মাধবপুরে তার নিজের গাড়ির ওপর কাগজটি রেখে দাফনের অনুমতিপত্রে স্বাক্ষর করেন। সামাজিক মূল্যবোধের মারাত্মক রকমের অবক্ষয়, নৈতিকতার নিদারুণ ক্রমাবনতি, নেতা-সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার, লাগামহীন গলাবাজি, বাণিজ্যায়ন-দুর্বৃত্তায়ন-স্পিডমানি ও ভ্রষ্টাচারের জোয়ারের মাঝে একজন পদস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তার এই মহৎ মানসিকতা প্রশংসনীয়, অনুকরণীয়। স্বজনহীন এক হতদরিদ্র মহিলার আবেদন নিয়ে জেলা প্রশাসকের দপ্তরে আসার লোকই নেই। অফিসের আনুষ্ঠানিকতা-প্রাসঙ্গিকতা এডিএম/এনডিসি জুডিশিয়াল পেশকার হয়ে জেলা প্রশাসক সমীপে পেশ হতে বেশ সময় লেগে যেত। সকল আমলাতান্ত্রিক প্রথা-পদ্ধতি পরিহার উপেক্ষা করে মহৎ মানুষ তোফায়েল ইসলাম মানবিকতার পরিচয় দিলেন। ৪ ফেব্রæয়ারি ২০১৭ দৈনিক মানবজমিনে ডিসির মানবিকতা শিরোনামে কমলগঞ্জ প্রতিনিধি প্রদত্ত একটি সচিত্র সংবাদ পরিবেশিত হয়। সংবাদ চিত্রে দেখা যায়, জেলা প্রশাসক তোফায়েল ইসলাম তার গাড়িতে রেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করছেন। তার এক আদেশের প্রেক্ষিতে হতদরিদ্র স্বজনহীন বৃদ্ধার লাশ দাফন-কাফনে আর কোনো আইনি বিধিনিষেধ থাকে না।
সাধারণ পাঠকের অবহিত ও অবগতির জন্য দুর্ঘটনাজনিত অস্বাভাবিক মৃত্যুর পরবর্তী আইনি কার্যক্রমে কিঞ্চিত আলোকপাত করা যেতে পারে। প্রথমে মৃতের সুরতহাল রিপোর্ট-ইনকোয়েস্ট তৈরি করা হয়। অতঃপর সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে একটি মেডিকেল বোর্ড লাশের ময়নাতদন্ত করে। এ রিপোর্টটি মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করে। লাশ সংক্রান্ত মামলা বিচারে উঠলে বাঃ দঃ বিঃ ৩০২/৩০৪/এ/বি ধারায় মামলায় হত্যার প্রমাণস্বরূপ উল্লিখিত মেডিকেল রিপোর্ট এবং চিকিৎসকগণের সাক্ষী লাগে। একটি কনটেস্টিং বা প্রতিদ্ব›িদ্বতামূলক হত্যা মামলায় এসব ডকুমেন্টারি এভিডেন্স এবং সাক্ষী প্রাসঙ্গিক। কিন্তু একটি নন কনটেস্টিং মামলায় এসবের প্রয়োজন নেই। আপস কিংবা অন্য হয়রানিজনিত কারণে অনেকেই হত্যা মামলা করতে চায় না। এসব ক্ষেত্রে একটি লাশের ময়নাতদন্তে আইনি বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত নয়। এ আইনটি আংশিক পরিবর্তনযোগ্য।
আইনের সংস্কার, সংশোধনী, সংযোজনী, পরিবর্ধন-পরিমার্জন এখন সময়ের দাবি। বৃটিশ ভারতে বৃটিশের প্রশাসনিক রাজনৈতিক সুবিধার জন্য প্রণীত আইন দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ চলতে পারে না। তখন বৃটিশরা ছিল ভারতবাসীর প্রভু, জনগণ ছিল গোলাম-রায়ত-প্রজা। স্বাধীন বাংলাদেশে সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্র একটি প্রজাতন্ত্র, প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। এই প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের মান্যবর প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা সি আর পি সি সংস্কার ও সংশোধন, বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ও মর্যাদা রক্ষা এবং সহজে স্বল্প সময়ে জনগণের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছেন। এটা আশাব্যঞ্জক, অভিনন্দনযোগ্য।
প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া একটি আধুনিক কল্যাণকামী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে খ্যাত ও স্বীকৃত। নির্যাতন, হত্যা ও গুলির মাঝেও জীবন বাজি রেখে সাংবাদিকরা দেশ ও জাতির জাগ্রত বিবেক হিসেবে কাজ করছেন। শুধু নেতিবাচক-নিন্দনীয় নয়, ইতিবাচক প্রশংসনীয় দিকও দেশ ও জাতির সম্মুখে উপস্থাপন করছেন। দেশে প্রকৃত ও সত্যিকার বিরোধী দলের অভাব ও অপূর্ণতার মাঝে জনগণের সুখদুঃখ-আনন্দ-বেদনার অপ্রকাশিত কথা ও কাহিনী তালাশ করে তুলে ধরছেন।
এই কঠিন সময়ে একজন জেলা প্রশাসকের এই মহৎ কর্ম ও মানসিকতা প্রশংসনীয়। এমনি একটি চমৎকার আশাব্যাঞ্জক সংবাদের জন্য দৈনিক মানবজমিনকে ধন্যবাদ।
লেখক : সিনিয়র অ্যাডভোকেট, হাইকোর্ট। সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেস ক্লাব। মুক্তিযোদ্ধা। কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।