Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ত্রিত্ববাদের প্রতীক রুমী মুদ্রার স্থলে আরবি মুদ্রা প্রবর্তনের কাহিনী

| প্রকাশের সময় : ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

কে এস সিদ্দিকী : ইমাম কেসায়ী বর্ণনা করেন যে, একদিন আমি হারুনুর রশীদের দরবারে গমন করি। সেখানে খলিফাকে দেখতে পাই। তার সামনের রাখা আছে বিপুল পরিমাণে অর্থসম্পদ। একটি থলে আশরাফি (মুদ্রা) দ্বারা এমনভাবে ভর্তি ছিল যে, মনে হচ্ছিল তা ফেটে যাবে। এ সময় খলিফা নির্দেশ প্রদান করেন একটি থলের সকল আশরাফি বিশেষ খাদিমদের মধ্যে বিতরণ করে দিতে। আমি দেখলাম খলিফার হাতে একটি দেরহাম, যাতে লিখিত নকশাগুলো ঝক ঝক করছে। খলিফা বার বার সেগুলো দেখছিলেন। তিনি বললেন, কেসায়ী, জানো কি এসব দিনার ও দেরহামে সর্বপ্রথম কে এসব নকশা খোদাই করিয়েছেন? কেসায়ী বললেন, জী হুজুর, এগুলো বাদশাহ আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ানের আবিষ্কার। খলিফা বললেন, এর কারণ কী ছিল তা জানা আছে কী? কেসায়ী বললেন, শুধু এতটুকুই আমার জানা আছে, বিস্তারিত আর কিছু জানা নেই। খলিফা বললেন, বিস্তারিত আমার কাছে শুনুন।
এসব লিখিত নকশা রুমীদের আবিষ্কার। মিসরবাসীদের অধিকাংশই ছিল খ্রিস্টান ধর্মানুসারী। রুম স¤্রাট তার ধর্মেরই নকশাগুলো খোদাই করিয়েছিলেন। যেমন তার নিশান ছিল পিতা, পুত্র ও রুহ। এ ধারা সর্বদা চালু ছিল, এমন কি ইসলামের মুদ্রাকালেও প্রচলিত ছিল। খলিফা আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ানের আমলে এতে সংশোধনী আনয়ন করে তাতে নকশাগুলো প্রতিস্থাপিত করা হয়। আবদুল মালেক ছিলেন অত্যন্ত তীক্ষè বুদ্ধিসম্পন্ন মেধাবী বাদশাহ। একদিন এ মুদ্রা তার দৃষ্টিগোচর হয়। তিনি গভীরভাবে তা দেখেন। অতঃপর তিনি আরবি অনুবাদ করার নির্দেশ প্রদান করেন। সরকারের কর্মকর্তারা তা-ই করেন। এ পদ্ধতি আবদুল মালেকের মনঃপূত হলো না। তিনি আরো বললেন, এ পদ্ধতি আমাদের দ্বীন ও ইসলামে পছন্দ নয় এবং যেসব রুমী নকশা পাত্র ও কাপড়ে দেখা যায়, সেগুলো আমাদের ধর্মে না পছন্দ এবং যদিও সেগুলো মিসরে প্রস্তুত হয়ে রুমের রাজধানীতে প্রচলিত । এসব নকশা কেবল ওসব বস্তুতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং পর্দা ইত্যাদিতেও বিদ্যমান। এ কাজটি খুব উচু পর্যায়ে হতো এবং এতই বিস্তার লাভ করেছিল যে, সমগ্র বিশ্বে চালু হয়ে যায়। সুতরাং আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান তার মিসরীয় শাসনকর্তা আবদুল আজিজ ইবনে মারওয়ানকে পত্র লেখেন যে, এসব রুমী নকশা সকল মুদ্রা, কাপড় (বস্ত্র) এবং পর্দা ইত্যাদি থেকে মুছে ফেলা হোক এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নির্দেশনা দেয়া হোক, তারা যেন রুমী নকশাসমূহের স্থলে ইসলামী নকশা কালেমায়ে তাওহীদ প্রতিষ্ঠিত করেন। এ জন্য আপনারা যে মুদ্রাগুলো দেখছেন সেগুলো আবদুল মালেকের যুগ থেকে বেশী কম ঢালাই ও নির্মিত হয়ে আসছে।
এতদ্ব্যতীত আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান সকল গভর্নর ও শাসনকর্তাদের তাগিদ করেন যে, তারা যেন তাদের নিজ নিজ এলাকা থেকে সমস্ত রুমী মুদ্রা জব্দ করেন। এ নির্দেশের পরে যদি কারো কাছে পওয়া যায় তাহলে তাদের শাস্তি প্রদান করা হবে অথবা তাদের কঠিন কারা নির্যাতন ভোগ করতে হবে। অতঃপর আবদুল মালেক সকল বস্ত্র, মুদ্রা এবং পর্দাসমূহে তওহীদের নকশা অংকন করে ছাপিয়ে সা¤্রাজ্যের সর্বত্র প্রচলিত করে দেন এবং এ ধরনের কিছু নমুনা রুম স¤্রাটের এলাকাসমূহেও প্রেরণ করেন। সুতরাং এ নব আবিষ্কারের খবর সমস্ত রুমী এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এ জন্য রুমে এ নকশার অনুবাদ করা হয় এবং স¤্রাটের খেদমতে পেশ করা হয়। এতে স¤্রাট নাখোশ হন এবং রাগে-ক্ষোভে অগ্নিশর্মা হয়ে পড়েন।
এ পর্যায়ে আভাস দিয়ে রাখা দরকার যে, ‘তসলীস’ বা ত্রিত্ববাদ খ্রিস্টানদের ধর্মীয় প্রধান মূল নীতি, যা মুসলমানদের তওহীদ বা একত্ববাদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। মুসলমানগণ এক আল্লাহ অর্থাৎ এক খোদার অস্তিত্বে বিশ্বাসী, তাঁর কোনো শরিক বা অংশীদার নেই, তিনিই একক ও একমাত্র খোদা, তার সাথে অন্য কিছুকে অংশীদার করা শিরক বা মহাপাপ। পক্ষান্তরে খ্রিস্টানরা তিন খোদায় বিশ্বাসী-আল্লাহ, মরয়ম ও ঈসা। তাদের এ ভ্রান্তমতবাদকে বলা হয় ‘তসলীস’ বা ত্রিত্ববাদ। কোরআনের অসংখ্য স্থানে এ মতবাদকে ভ্রান্ত ঘোষণা করা হয়েছে এবং তওহীদে বিশ্বাস স্থাপনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
উমাইয়া খলিফা আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান যখন সে যুগে আরব দেশে প্রচলিত রুমী মুদ্রায় দেখতে পান যে, তাতে পিতা, পুত্র এবং রুহ খোদাই করা রয়েছে, তখন তিনি রহস্য বুঝতে পারেন এবং উল্লিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তার এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব প্রদান করেন মদিনায় গভর্নর হিসেবে নিয়োজিত তার ভ্রাতা আবদুল আজিজকে। আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশীদের বর্ণনায় যার নাম রয়েছে। এই আবদুল আজিজ ইবনে মারওয়ানই ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় মহান খলিফা হজরত উমর (রা.)-এর পুত্র হজরত আসেম (রা.)-এর জামাই এবং তারই পুত্র ছিলেন দ্বিতীয় উমর নামে খ্যাত উমর ইবনে আবদুল আজিজ। আরো উল্লেখ্য, খলিফা আবদুল মালেকের আরেক ভ্রাতার নাম ছিল সুলায়মান ইবনে মারওয়ান। তিনিও খলিফা ছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি ভ্রাতুষ্পুত্র উমর ইবনে আবদুল আজিজকেই তার পরবর্তী খলিফা হিসেবে মনোনীত করেছিলেন। প্রসঙ্গ কথায় ফিরে আসা যাক।
রুম স¤্রাট খলিফা আবদুল মালেক কর্তৃক রুমী মুদ্রা নিষিদ্ধ ঘোষণার খবরে বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন এবং আবদুল মালেকের নামে একখানা পত্র লেখেন। তাতে বলেন :
এ সকল নকশা, কারুকার্য করা জিনিসপত্র ইত্যাদি রুমের জন্য মিসরে নির্মাণ করা হয়ে থাকে। আমাদের এ প্রথা প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। এখন আপনি এসব বাতিল ঘোষণা করেছেন। যদি এ প্রথাটি আপনার পূর্ববর্তী খলিফাদের পক্ষ হতে প্রচলন করা হয়ে থাকে তাহলে যথার্থই করা হয়েছিল, কিন্তু আপনিও কাজটি ঠিক করেননি। যদি আপনি ঠিক করে থাকেন, তাহলে আপনার পূর্ববর্তীরা ঠিক করেননি, ভুল করেছেন। তাই আমি আপনার নিকট দুটি বিষয় পেশ করছি। আপনি যেটি খুশি গ্রহণ করুন। আমি আপনার মান-মর্যাদা অনুযায়ী উপহার প্রেরণ করছি, কিন্তু কারুকার্য খচিত আমাদের নকশায় আপনার নব আবিষ্কৃত প্রথা বাতিল ঘোষণা করতে হবে এবং আমাদের রুমী নকশা কারুকার্য খচিত বস্তুসমূহ বহাল রাখার এবং চালু করার নির্দেশ জারি করতে হবে। আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। আমার উপহার গ্রহণ করবেন। কেননা আমি বহু মূল্যবান উপহার প্রেরণ করেছি।
আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান যখন পত্রখানা পাঠ করেন, এবং রুমী কাসেদ (দূত)-কে বলেন, তাকে বলে দিও এ পত্রের কোনো জবাব নেই, আমাদের কাছে এর কোনোই গুরুত্ব নেই এবং তার প্রেরিত উপহারও ফেরত পাঠানো হচ্ছে।
রুমী দূত যখন ফেরত দেয়া উপহারসহ রুম স¤্রাটের দরবারে উপস্থিত হয় এবং অবস্থা বর্ণনা করে তখন রুম স¤্রাট আরো অধিক উপহার সহকারে আবদুল মালেকের কাছে দূত প্রেরণ করেন এবং আরো জানান যে, আমি আশা করি, আপনি আমার এ উপহারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবেন এবং আপনি তা গ্রহণ করবেন। কিন্তু জেনেছি যে, আপনি তা গ্রহণ করেননি এবং আমার পত্রেরও জবাব দেননি। এ জন্য আমি উপহারের পরিমাণ বাড়িয়ে পুনরায় প্রেরণ করলাম এবং আমার প্রত্যাশা যে, আপনি রুমী নকশাগুলো চালু করে দেবেন।
আবদুল মালেক আবারো রুম স¤্রাটের পত্র পাঠ করে রেখেদেন এবং তার প্রেরিত উপহার ফেরত পাঠান। অতঃপর রুম স¤্রাট আবার পত্র লেখেন এবং তাতে বলেন যে, আপনি আমার পত্র ও উপহারের অবমাননা করেছেন, আমার পত্রের জবাব দেয়া প্রয়োজন মনে করেননি। তাই প্রথমে আমার ধারণা হলো, আমি উপহার কম প্রেরণ করেছিলাম। অতএব তার পরিমাণ আরো বাড়িয়ে দিয়েছি। অতঃপর আমি তা আপনার নিকট প্রেরণ করি। এবার আমি বর্ধিত হারে তৃতীয়বার আপনার নিকট প্রেরণ করছি। আমি ঈসা ইবনে মরয়মের শপথ করে বলছি, আপনি অবশ্যই আমাদের নকশা ও কারুকার্য ম-িত বস্তুগুলো সম্পর্কে পুনর্বিবেচনা করবেন এবং সেগুলো পূর্বাবস্থায় বহাল রাখবেন। আমি আবারো আমার দেশে দিনার ও দেরহামগুলো ঢালাই করতে যাচ্ছি এবং তা আমার দেশের নিয়মেই হবে। আপনার জানা থাকা উচিত যে, আমাদের এখানে এ নিয়মেই ঢালাই করা হয় এবং ইসলামে এ নিয়ম প্রচলিত ছিল না তাই সে অনুযায়ী ঢালাই করা হয়নি। আপনি যদি তা না মানেন তাহলে আপনাদের নবীর ছবির নকশা বানানো হবে। আমি আশা করি যে, আপনি যখন এ পত্রখানা পাঠ করবেন, তখন আপনি ঘামায়িত হয়ে পড়বেন। এ জন্য আমি যা বলছি, সেই অনুযায়ী কাজ করুন এবং আপনার দেশে আমাদের নকশাই অক্ষুণœ রাখুন, এতে পরস্পর সম্পর্ক বাড়বে।
খলিফা আবদুল মালেকের নিকট রুম স¤্রাটের কয়েক দফা পত্র প্রেরণ, তার সাথে বর্ধিত উপহার প্রত্যাখ্যান করায় ঘটনা প্রমাণ করে যে, রুম স¤্রাটের মতো মহা প্রতাপশালী শক্তিধরের উপহারকে তিনি ইসলামী ঐতিহ্যের মোকাবিলায় তুচ্ছ গণ্য করেছেন এবং প্রত্যাখ্যান করে সত্য, নিষ্ঠা ও নবীপ্রেমের যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। রুম স¤্রাটের ইসলামের নবীর কল্পিত ছবি অংকনের হুমকি তার ইসলাম বিদ্বেষী মনোভাবেরই পরিচায়ক কিন্তু খলিফা ত্রিত্ববাদী মুদ্রার স্থলে তওহিদের প্রতীক আরবি মুদ্রা প্রবর্তন করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন