Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বেপরোয়া হয়ে উঠছে স্বর্ণ পাচারকারীচক্র মামলা হলেও দ্রুত জামিনে বেরিয়ে আসছে

| প্রকাশের সময় : ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

গত ৬ বছরে ১৫৬ মামলার মধ্যে মাত্র ১টির চ‚ড়ান্ত রায় হয়েছে
মামলার তদন্তে ধীরগতিকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা
উমর ফারুক আলহাদী : শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন বিমানবন্দরে প্রায় প্রতিদিনই উদ্ধার করা হচ্ছে কেজি কেজি স্বর্ণ। এসব ঘটনায় মামলাও হচ্ছে। ধরা পড়ছে স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের সদস্যরা। তবে দ্রুতই জামিনে আবার বের হয়ে আসছেন। ফলে দিন দিন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে পাচারকারী চক্র। বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন স্থানে অব্যাহত অভিযান সত্তে¡ও স্বর্ণ চোরাচালান বন্ধ হচ্ছে না। সোনা চোরাকারবারিরা আইন-শৃংখলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির তোয়াক্কা করছে না। সোনা পাচারের অংশ হিসেবে তারা বেছে নিচ্ছে অভিনব ও অদ্ভুত সব পাচার কৌশল। এ কৌশলের অনেকগুলোই গা শিউরে ওঠার মতো। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আইনের কঠোর প্রয়োগ নেই, এমনকি এসব ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দিতেই বছরের পর বছর চলে যাচ্ছে। এর মধ্যে গ্রেফতার ব্যক্তিরা আদালতের মাধ্যমে জামিন নিয়ে বের হয়ে আসছে। গত ৬ বছরে এ সংক্রান্ত ১৫৬টি মামলার মধ্যে মাত্র ১টি মামলার চূড়ান্ত রায় হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে গ্রেফতার ২৯৫ জনের মধ্যে অধিকাংশই জামিনে বের হয়ে এসেছেন। ফলে চোরাকারবারীরা কোনো কিছুই তোয়াক্কা করছেন না বলে মনে করেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সোনা চোরাচালান নির্বিঘœ রাখতে একের পর এক কৌশল পাল্টাচ্ছে পাচারকারীরা। এসব নিত্যনতুন কৌশলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে তথা সোনার চালান ধরতে হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রশাসনকে। বেশ কয়েক দিনের অনুসন্ধানে সোনা পাচারের আবিষ্কৃত-অনাবিষ্কৃত নানা কৌশল বেরিয়ে এসেছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তো বটেই এমনকি সাধারণ মানুষকেও চোরাচালানিদের এসব অভিনব কৌশল অবাক করে দেয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, অভিনব কায়দায় কখনো চায়ের ফ্লাস্ক, বিদেশি বিস্কুটের প্যাকেট, জুসের প্যাকেট, জুতার ভিতর, প্যান্টের বেল্টের ভিতর, নারীর চুলের খোঁপায়, দেহের গোপনীয় জায়গায়, ল্যাপটপ এমনকি ওয়াটার পাম্পের ভিতরে করে সোনার বার পাচার হচ্ছে। পাচার হওয়া কিছু সোনার বার দেশের বাজারে ছড়িয়ে পড়লেও সীমান্তপথে বড় অংশ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতসহ অন্যান্য দেশে চলে যায়। লাগেজ কেটে বিশেষ পার্ট বানিয়ে, জুতার ভেতরে কিংবা পায়ুপথে সোনার বার ঢুকিয়ে পাচার করার পুরনো কাহিনী এখন আর পাত্তা পায় না। এয়ারপোর্টে কাস্টমস গেটের স্ক্যানার মেশিনেও যেমন সোনার অবস্থান চিহ্নিত হয় তেমনি পাচারকারীর চলাফেরার সন্দেহেও সোনা পাচারকারীরা মুহূর্তেই ধরা পড়ে। ফলে চোরাচালানকারী ইদানীং এমন সব কৌশল ব্যবহার করছেন যা ধারণা করাও কঠিন। বাংলাদেশে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে গরুর পেটের ভিতর সোনার বার ঢুকিয়েও ভারতে পাচারের ঘটনা ঘটছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালানের ঘটনায় ৬ বছরে ২৫৬টি মামলা হয়েছে। ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এসব মামলা হয়েছে। তবে এসব মামলার তদন্তে অগ্রগতি নেই। গত ৬ বছরে মাত্র ১টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করে অধিক সময় ব্যয় হচ্ছে। এসব মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে ২৯ জনকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্স, সিভিল এভিয়েশন, কাস্টমসসহ এ অপরাধের সঙ্গে বিভিন্ন সেক্টরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও জড়িত। এছাড়া সোনা চোরাচালান সিন্ডিকেটের সদস্যরা প্রভাবশালী হওয়ায় সঠিকভাবে মামলার তদন্ত ও আসামিদের গ্রেফতার করতে পারছে না আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ফলে বছরের পর বছর ধরে বিচারহীন অবস্থায় ঝুলে রয়েছে সোনা চোরাচালানের অধিকাংশ মামলা।
আদালতের তথ্য মতে, স্বর্ণ চোরাচালানের ঘটনায় ৬ বছরে এখন পর্যন্ত মাত্র একটি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। ২০১৬ সালের ২ নভেম্বর বাসলিনা বিনতে রাজা মালেক নামে মালয়েশিয়ার এক নারীকে ১৪ বছরের কারাদন্ড দেন ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ এসএম জিয়াউর রহমানের আদালত। একই সঙ্গে ওই নারীকে ১০ হাজার টাকার অর্থদন্ড দেয়া হয়। ২০১৪ সালের ২৮ অক্টোবর মালয়েশিয়ার একটি বিমান ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ওই বিমানে অভিযান চালিয়ে এক কেজির ৬টি স্বর্ণের বারসহ মালয়েশিয়ান ওই নারীকে আটক করে ঢাকা কাস্টমস হাউস। পরে এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় মামলা করা হয়।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক মঈনুল খান বলেন, জড়িতদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে স্বর্ণ চোরাচালান বন্ধ হবে না। চোরাচালান চক্রের সদস্যরা আন্তঃদেশীয় অপরাধের সঙ্গে জড়িত। তাই এসব মামলা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা উচিত। স্বর্ণ চোরাচালান বন্ধে মামলাগুলোর তদন্ত দ্রুত শেষ করে নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে সিআইডির বিশেষ সুপার শেখ রেজাউল হায়দার বলেন, স্বর্ণ চোরাচালানের দীর্ঘদিনের পুরনো কোনো মামলা সিআইডিতে নেই। স¤প্রতি স্বর্ণ চোরাচালানের ১৫টি মামলা তদন্ত করছে পুলিশ। তিনি বলেন, দ্রুত আইনে করা মামলা ছাড়া অধিকাংশ মামলা নিষ্পত্তিতে ৪-৫ বছর সময় লেগে যায়।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, দেশের তিনটি বিমানবন্দরে ২৫ সিন্ডিকেটের শতাধিক সদস্য স্বর্ণ চোরাচালানে সক্রিয়। এর মধ্যে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সক্রিয় রয়েছে ১৮ সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেটের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী অনেকেই জড়িত।
শুল্ক অধিদফতরের গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, দুবাই, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর থেকে অবৈধভাবে স্বর্ণের চালান আসে বাংলাদেশে। পরে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে তা পাচার হয়ে ভারতে যাচ্ছে। চক্রের মূল হোতারা বিদেশে বসেই চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা বাংলাদেশ থেকে যাওয়া বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের কর্মী, বিদেশে ঘুরতে যাওয়া নাগরিক ও শ্রমিকদের বিমানের টিকিট ও নগদ টাকার বিনিময়ে স্বর্ণ দেশে পাঠাচ্ছে। বিমানবন্দরে পৌঁছার পর কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহায়তায় স্বর্ণের চালান বাইরে চলে যায়।
বিমানবন্দর থানার ওসি নুরে আজম মিয়া বলেন, স্বর্ণ চোরাচালানের অধিকাংশ মামলায় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগসহ (সিআইডি) বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত করে। থানা পুলিশ চার থেকে পাঁচটি মামলা তদন্ত করছে। এসব মামলার তদন্তে অগ্রগতি হয়েছে। দ্রæত চার্জশিট দেয়া হবে। তিনি বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বর্ণ পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। ফলে তদন্তে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দেয়। আবার চার্জশিট দেয়ার পরও সাক্ষীর অভাবে বছরের পর বছর ধরে ঝুলে রয়েছে অনেক মামলার বিচার।
বিমানবন্দর থানা সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ পর্যন্ত স্বর্ণ চোরাচালানের ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় ২৫১টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে ২৯১ জনকে। এর মধ্যে ২০১৬ সালে করা ৫৩টি মামলার মধ্যে ৩৬টিতে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। ১৭টি তদন্তাধীন। ২০১৫ সালে দায়ের করা ৫৫টি মামলায় গ্রেফতার করা হয় ৮৭ জনকে। ২০১৪ সালে করা ৬২টি মামলায় গ্রেফতার করা হয় ৩২ জনকে। ২০১৩ সালে মামলার সংখ্যা সামান্য কমে দাঁড়ায় ৬১টিতে। এসব মামলায় গ্রেফতার করা হয় ৮১ জনকে। ২০১২ সালে ১১টি মামলায় গ্রেফতার করা হয় ১৬ জনকে। ২০১১ সালে ৯টি মামলায় গ্রেফতার করা হয় ১৪ জন চোরাকারবারীকে।
শুল্ক গোয়েন্দা সূত্র জানায়, পল্টনের একটি বাসা থেকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ৬১ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ২০১৬ সালে সিরাজগঞ্জের উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা রিয়াজ, মৌলভীবাজারের সাবেক চেয়ারম্যান শামীম চৌধুরী ও বিমানের কর্মকর্তাসহ ১২ জনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দেয় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এছাড়া ২০১৩ সালের জুলাইয়ে ১২৪ কেজি স্বর্ণ বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় জব্দ করা হয়। ২০১৬ সালে ১৩৪ কেজি ৪১৩ গ্রাম স্বর্ণ জব্দ করা হয়। এসব ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই বলেও জানান শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। ফলে বিভিন্ন সময় স্বর্ণের চালান জব্দ হলেও বন্ধ হচ্ছে না চোরাচালান।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ