পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টালিন সরকার : ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলা একাডেমির বইমেলা দেশের সর্বজনীন উৎসব। বইমেলা মানেই জ্ঞানের আসর। কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনী, অনুবাদ সাহিত্য, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, আত্মজীবনী, বিজ্ঞান, চিকিৎসাসহ হাজারো বিষয়ের সাহিত্যের সমাহার। নানা মত পথের লেখকদের মিলনমেলা। এ বইমেলা প্রকাশকদের বই বিক্রি আর ক্রেতাদের বই কেনা শুধু নয়; আনন্দ স্ফূর্তি, হৈহুল্লোড়, উৎসব-উল্লাসের পাশাপাশি সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতি, শিল্পকলার বিকাশে জ্ঞানের চর্চায় উন্মেষ ঘটায়। এ বইমেলা লেখক, প্রকাশক ও পাঠকের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে আত্মিক যোগাযোগ ঘটায়। বইমেলায় তৈরি হয় এক আনন্দঘন পরিবেশ। মেলায় শুধু বিক্রয়ই নয়; সেই সঙ্গে ঘটে পাঠক- লেখকের আত্মার উন্নতি। লেখক-পাঠকের পারস্পরিক মতবিনিময়, চিন্তার আদান-প্রদান এবং একে অপরের কাছাকাছি হওয়ার মহা আয়োজন হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘মানুষ বই দিয়ে অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সাঁকো বেঁধে দিয়েছে।’ কবি ওমর খৈয়াম বলেছেন, ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার চোখ ঘোলা হয়ে যাবে কিন্তু বইখানা অনন্ত যৌবনাÑ যদি হয় তেমন বই।’ কিন্তু বইমেলার এ কি হাল! রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে যেন বইমেলায় সার্বজনীনতা হারিয়ে যেতে বসেছে। কয়েক বছরেই এই পরিবর্তন! শুধু কি তাই; নিয়ম-নীতির বেড়াজাল আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে মেলা যেন হয়ে পড়েছে প্রাণহীন। তারপরও শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’র মতোই কিছু লোকের মধ্যে উল্লাস উচ্ছ¡াস দেখা গেল বৈ কি!
শিল্প-সাহিত্যে যারা যত উন্নত বিশ্বদরবারে জাতি হিসেবে তারা তত সমৃদ্ধ। বিশ্বের সবচেয়ে মিষ্টি ভাষা হলো বাংলা। ২০১০ সালে ইউনেস্কোর
জরিপে বিশ্বের সবচেয়ে ‘মিষ্টি ভাষা’ হিসেবে বাংলা ভাষা নির্বাচিত হয়। শিল্প-সংস্কৃতি এবং নিজস্ব কৃষ্টিতে বাংলা সমৃদ্ধ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা এই বাংলায় অনেক সমৃদ্ধশালী কবিতা, গল্প ও গবেষণাধর্মী বই আছে। কিন্তু বইমেলা ঘিরে যে হাজার হাজার বই প্রকাশ হচ্ছে সেগুলোর কতগুলো বই পাঠযোগ্য? সাহিত্যমান দূরের কথা অধিকাংশ বই কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং রাজনৈতিক দলকে খুশি করতে যেন প্রকাশ করা হচ্ছে। আমাদের দেশের মানুষ হুজুগপ্রিয়। পরিবর্তিত ঋতুর মতোই ক্ষণে ক্ষণে হুজুগ আসে। কয়েক বছর ধরে শুরু হয়েছে বই লেখার হুজুগ। বই লেখা ও বই পড়া দুটোই মহৎ কাজ। আবার একজন লেখকের সব বইয়ে সাহিত্যমান উন্নত-সমৃদ্ধ হবে সেটাও নয়। হুমায়ূন আহমেদের মতো কালজয়ী লেখকের লেখার সাহিত্যমান নিয়ে বিতর্ক আছে। তারপরও বাংলা সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদের অবদান অপরিসীম। কিন্তু চিন্তা-চেতনায় ব্যক্তিকে খুশি করা, কিছু পাওয়ার প্রত্যাশায় রাজনৈতিক দলকে খুশি করে কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ-নিবন্ধের বই প্রকাশের উদ্দেশ্য হলে সে বই কী সাহিত্য হয়? জাতি হিসেবে আমরা স্বাধীন। গুণীজনেরা বলে থাকেন বইয়ের গুরুত্ব মানবজীবনে অপরিসীম। বই মানবজীবনকে উন্নত করে, রুচিশীল করে জ্ঞানের পরিধি বাড়ায়। যতই অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া, অনলাইন পত্র-পত্রিকা পাঠ করি; ফেসবুক, বøগ, টুইটার তথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভ্যস্ত হই না কেন বইপড়ার মতো মজা কিছুতেই পাওয়া যায় না। বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই।
কবি-সাহিত্যিকদের পাশাপাশি দেশের স্থপতি, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, গবেষকরা নিজের মেধা কর্মযজ্ঞ নিয়ে বই লিখবেন; শিল্প-সংস্কৃতিতে অবদান রেখে দেশকে সামনে এগিয়ে নেবেন। দেশের শিল্প-সাহিত্য সমৃদ্ধিশালী করে নিজেদের যোগ্য স্থান করে নেবেন দেশ-বিদেশের মাটিতে। সেটাই স্বাভাবিক। বইমেলায় বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখা গেল প্রচুর নতুন বই প্রকাশ করা হয়েছে। কবি-সাহিত্যিকদের পাশাপাশি বিভিন্ন পেশাজীবী এবং তরুণ-তরুণী এসব বইয়ের লেখক। ছাপার মান উন্নত হলেও বইগুলো হাতে নিয়ে গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ-নিবন্ধ তথা রচনা দেখে মনে হয় দেশের শিল্প-সাহিত্যের সমৃদ্ধির জন্য নয়; মূলত বইগুলোর অধিকাংশই লেখা হয়েছে কোনো ব্যক্তি-গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক দর্শনধারীদের খুশি করতে; বাহবা পেতে। লেখায় তোষামোদির ধরন এত গভীর যে, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘তোষামোদ’ কবিতার পটভূমিকেও হার মানিয়েছে। অনেকটা গ্রামের জারি-সারি গানের মতো। গাতক পূর্বতে বন্দনা করি, পশ্চিমে বন্দনা করি, দক্ষিণে বন্দনা করি, পূর্বে বন্দনা করি ইত্যাদি বলে পালা শুরু করেন। হয়তো বইয়ের লেখকরা পরিচিতজনের কাছে ‘লেখক’ হিসেবে পরিচিতি পাবেন কিন্তু দেশ-জাতি-সমাজ তাদের লেখনী থেকে কিছু পাবে কি না সেটাই প্রশ্ন।
বইমেলায় তেমন যাওয়া হয় না। ৯০ দশকজুড়ে ফেব্রæয়ারিতে আয়োজিত বাংলা একাডেমির বইমেলায় প্রায় নিত্যদিন যাওয়া হতো। অর্থের অভাবে বই কেনা না হলেও কয়েক ঘণ্টা কেটে যেত বইমেলায় নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকে। এক দশক থেকে কাজের চাপে বইমেলায় যাওয়া হয় না। কিন্তু ইনকিলাব সম্পাদকের তাগিদে গত বছর থেকে দু-একদিন বইমেলায় যাচ্ছি। তার বক্তব্য হলো বইমেলায় গেলে অনেকের সঙ্গে দেখা হবে; বই উল্টেপাল্টে দেখতেও মজা। কিন্তু বইমেলার এ কি হাল! এটা ঠিক বইমেলাকে কেন্দ্র করে বিপুল কর্মযজ্ঞ চলছে। বই ছাপানো, বই বাঁধানো, কম্পোজ, প্রচ্ছদ আঁকা, স্টলে বই বিক্রির কাজ অনেকেই করছেন। সাহিত্যচর্চাই শুধু নয়; বইমেলার অর্থনৈতিক মূল্যও কম নয়। বইমেলায় বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৬৪৯টি ইউনিট রয়েছে। প্রকাশকরা ইউনিট ভিত্তিতে বইয়ের স্টল দিয়েছেন। কেউ এক ইউনিট, কেউ দুই ইউনিট, আবার কেউ তিন ইউনিট মিলে একটি স্টল দিয়েছেন। বড় প্যাভিলিয়ন আছে ১৫টি। প্রায় সাড়ে চার শ’রও বেশি প্রকাশক মেলায় অংশগ্রহণ করেছেন। তাদের ইউনিটের ভিত্তিতে ভাড়া গুনতে হচ্ছে। এক ইউনিটের ভাড়া ১৪ হাজার টাকা, দুই ইউনিটের ভাড়া ৩৪ হাজার, তিন ইউনিটের ভাড়া ৫৬ হাজার টাকা এবং প্যাভিলিয়নের ভাড়া এক লাখ ২৫ হাজার টাকা। এ খাতে মোট ভাড়া বাবদ আয় হবে ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টাকা। সংশিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল গত বছর মেলায় প্রায় ৪০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়। বইমেলা ঘিরে হবে প্রায় শত কোটি টাকার বাণিজ্য। বইমেলা কেন্দ্রও করে বাংলা একাডেমি, টিএসসি, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও দোয়েল চত্বর এলাকা লোকে লোকারণ্য। কিন্তু হোঁচট খেতে হলো বইমেলায় প্রবেশ করতে গিয়েই।
মেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যাপক নিরপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পুলিশ, র্যাব, আনসার, ফায়ার সার্ভিসসহ প্রায় আড়াই হাজার নিরাপত্তা সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। শুধু পুলিশ সদস্যই আছে দুই হাজারের ওপরে। বইমেলায় প্রবেশে বাংলা একাডেমিতে দু’টি ও উদ্যানে তিনটি গেট আছে। প্রতি গেটে একজন ইন্সপেক্টর, একজন সাব-ইন্সপেক্টর, দুজন এএসআই, একজন নারী এসআই, ৯ থেকে ১০ জন নারী ফোর্সসহ প্রায় ২৫ জন করে রয়েছে পুলিশ ফোর্স। সর্বত্র টহল তো রয়েছেই। মেলাজুড়ে ওয়াচটাওয়ার আছে ৯টি। ৫টি পুলিশের ও ৪টি র্যাবের।
মেলার গেট খোলে বিকেল ৩টায়। কিন্তু বেলা আড়াইটার পর থেকে দর্শনার্থীরা লাইনে দাঁড়াতে শুরু করেন। ১৩ ফেব্রæয়ারি দেখা গেল মেলায় দর্শনার্থীদের মধ্যে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি। রোদে শত শত নারী-শিশু-পুরুষ লাইনে দাঁড়িয়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর গাড়ি যাতায়াতে জায়গা দিতে লাইনে দাঁড়ানো মানুষগুলোর বারবার সরে যেতে হচ্ছে। অথচ ওই সব গাড়ি কয়েক গজ ঘুরে গেলেই লাইনে দাঁড়ানো মানুষগুলোকে দৌড়ঝাঁপ করতে হয় না। বইমেলায় প্রত্যেক দর্শকের দেহ তল্লাশি করে ভেতরে প্রবেশ করানো হচ্ছে। এতে অনেকেই বিরক্তবোধ করেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কঠোর। এ নিয়ে দর্শকদের অনেকেই জানান, তারা বইমেলায় আসেন কিন্তু আগের সেই ‘মজা’ পান না। শৃঙ্খলিত নিয়মে আপনি প্রাণ পাবেন কোথায়? জানতে চাইলে একজন বললেন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের নামে যেভাবে দেহ তল্লাশি করা হয় তা খুবই পীড়াদায়ক। হাজার হাজার দর্শনার্থী। কেউ বই কিনছেন, স্টলে স্টলে ঘুরে ঘুরে কেউ বই দেখছেন। কম বয়সী অনেক ছেলেমেয়ে জুটি বেঁধে এসেছেন। খাবারের মূল্য বেশি তারপরও ভিড়। আলোচনা সভা, সঙ্গীতানুষ্ঠান হচ্ছে। কিন্তু দর্শকদের মধ্যে ’৯০ দশকের মতো নেই সেই প্রাণচাঞ্চল্য, উচ্ছ¡াস-উল্লাস। আর লেখকদের আড্ডা, বইয়ের পরিচিতি ইত্যাদিতে যেন সার্বজনীনতা অনুপস্থিত। কিছু পরিচিত মুখ এবং একই আদর্শে বিশ্বাসী লেখক-সংস্কৃতিসেবী আড্ডা দিচ্ছেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি দুই অংশে বিভিন্ন লেখক কবি-সাহিত্যিকের বড় বড় ছবি টানিয়ে দেয়া হয়েছে। সৈয়দ শামসুল হক, হুমায়ূন আহমেদ, শওকত ওসমান, সুফিয়া কামাল, রফিক আজাদসহ বিভিন্ন বরেণ্য কবি-লেখকের নামে চত্বর করা হয়েছে। অর্ধ শতাধিক স্টলে বই উল্টেপাল্টে দেখে এবং দর্শকদের সঙ্গে কথা বলে মনে হলো বাংলা একাডেমির বইমেলায় অতীতে বিভিন্ন দর্শন-আদর্শ ও মতপথের লেখক-প্রকাশকদের যে মিলনমেলা ছিল ধীরে ধীরে তা হারিয়ে যাচ্ছে। মাসব্যাপী বইমেলায় যে সর্বজনীনতার চাদর ছিল তা যেন ছিঁড়ে গিয়ে একটি গোষ্ঠীর মিলনমেলায় পরিণত হচ্ছে। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান চত্বরে দাঁড়িয়ে এক দর্শক দুঃখ করে বললেন, ‘ভাই বইমেলায় আগের সেই সার্বজনীনতা নেই। মনে হয় এক পক্ষের লোকজন লেখক, পাঠক, দর্শক। বিশেষ করে বইগুলো দেখলে বুঝবেন এগুলো সাহিত্য না তোষামোদির লিফলেট’। দর্শকের কথা শুনে মনে পড়ে গেল তার কালজয়ী লেখা ক্রীতদাসের হাসির উপন্যাসের কথা। বর্তমান মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের বাবা শওকত ওসমান ১৯৬২ সালে ‘ক্রীতদাসের হাসি’ উপন্যাসটি রচনা করেন। ওই সময় বর্বর স্বৈরশাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট ছিল দুই পাকিস্তান। হরণ করা হয় মানুষের সব ধরনের বাকস্বাধীনতা ও ভোটের অধিকার। সে প্রেক্ষাপটে লেখা ওই উপন্যাসের মূল চরিত্র তাতারী। উপন্যাসে তাতারীকে রুপক অর্থে প্রতিবাদী চরিত্র করে তোলা হয়; তেমনি রূপকের মধ্য দিয়ে লেখক দেশের চিত্র তুলে ধরেন। গণতন্ত্রহীনতায় কোনো কিছুর বিনিময়ে তাতারীর হাসি পান না। শাসকের নির্দেশে হাসার চেয়েও মৃত্যুকে শ্রেয় মনে করে তাতারী। বাংলা একাডেমির বইমেলায় কিছু লেখক-কবি-সাহিত্যিক, প্রকাশক, সংস্কৃতিসেবী ও দর্শক প্রাণ খুলে উল্লাস-উচ্ছ¡াসে তাতারীর উল্টো চরিত্রে আবির্ভূত হলেও অধিকাংশ দর্শকের অবস্থা উপন্যাসের ওই তাতারীর মতোই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।