Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রোহিঙ্গাদের জন্য মালয়েশীয় ত্রাণসামগ্রী খালাস

| প্রকাশের সময় : ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

চট্টগ্রাম ব্যুরো : ভাগ্যাহত রোহিঙ্গা মুসলমান শরণার্থীদের জন্য মালয়েশীয় জাহাজ ‘নটিক্যাল আলিয়া’যোগে আসা মানবিক ও জরুরি ত্রাণসামগ্রীর চালান গতকাল (মঙ্গলবার) চট্টগ্রাম বন্দরের সিসিটি জেটিতে খালাসের কাজ শুরু হয়। খালাস করা খাদ্যদ্রব্য, ওষুধসহ বিভিন্ন ধরনের ত্রাণসামগ্রী উখিয়া ও টেকনাফের শরণার্থী ক্যাম্পে ইতোমধ্যে ঠাঁই নেয়া রোহিঙ্গাদের মাঝে বিতরণ করা হবে। এর জন্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কাভার্ডভ্যান ও ট্রাকযোগে কক্সবাজারের উদ্দেশে পরিবহন করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা শরর্ণাথীদের জন্য মালয়েশিয়া থেকে বহুল আলোচিত ‘নটিক্যাল আলিয়া’ জাহাজে পাঠানো ১ হাজার ৪৭২ মেট্রিক টন ত্রাণসামগ্রী গতকাল দুপুরে বন্দর জেটি-ইয়ার্ডে বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া ভ্রাতৃ-বন্ধুপ্রতীম দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়। এ সময় মালয়েশিয়া সরকারের পক্ষে সংসদ সদস্য আব্দুল আজিজ আবদুল রহিম, দাতুশ্রি নাদিব, বাংলাদেশে নিযুক্ত মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রদূত নূর আশেকিন বিনতে তায়েব, রেড ক্রিসেন্ট ও আইওএম’র প্রতিনিধি এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে পররাষ্ট্র সচিব (মেরিটাইম ইউনিট) মোঃ খুরশিদ আলম, ভারপ্রাপ্ত চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার সারোয়ার জাহান, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক, বন্দর ও কাস্টমস কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন এবং ত্রাণসামগ্রী বুঝে নেন। এ সময় দুই দেশের কর্মকর্তারা ত্রাণসামগ্রী গ্রহণ, বিতরণ, বন্দর থেকে খালাস ও ডেলিভারি পরিবহন, জাহাজটিতে আগত বিভিন্ন সংস্থার ২৫ জনকে বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি এবং জাহাজে বাহিত পণ্যসামগ্রীর অ্যাসেসম্যান্টের বিষয়েও আলোচনা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বোর্ড সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা), মুখপাত্র মোঃ জাফর আলম দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, ‘নটিক্যাল আলিয়া’ জাহাজযোগে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য মালয়েশীয় ত্রাণসামগ্রী বন্দর জেটিতে পৌঁছার পর কোনো রকম জটিলতা ছাড়াই হস্তান্তর সম্পন্ন হয়েছে। এরপর সেসব ত্রাণসামগ্রী কক্সবাজারে শরণার্থী রোহিঙ্গাদের জন্য নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াও চলছে।
বর্মী (মিয়ানমার) সেনা, পুলিশ, বিজিপি এবং উগ্র মুসলিম-বিরোধী মগবৌদ্ধদের গণহত্যা, গণধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, চরম নির্যাতন-নিপীড়ন-বিতাড়নের মুখে বাধ্য হয়ে স্বদেশভূমি মিয়ানমারের আরাকান (রাখাইন স্টেট) প্রদেশ ছেড়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে এসে ঠাঁই নিয়েছে স¤প্রতি হাজার হাজার রোহিঙ্গা। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাসমূহের হিসাবে নতুন করে পালিয়ে আসা মুসলিম রোহিঙ্গা নর-নারী-শিশু-বৃদ্ধের সংখ্যা হিসাবভেদে ৫০ থেকে ৯০ হাজার পর্যন্ত। জাতিসংঘের ভাষায় ‘পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যাহত নিপীড়িত’ রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর নির্যাতনের স্টিম রোলার আজ বন্ধ হয়নি। রোহিঙ্গাদের উপর হত্যা-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশসহ বিশ্বের দেশে দেশে হয়ে আসছে বিক্ষোভ, নিন্দা-ধিক্কারের ঝড়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফুঁসে ওঠে মালয়েশিয়ার জনসাধারণ এবং কঠোর প্রতিবাদের ভূমিকায় রয়েছে মালয়েশীয় সরকারও। এই প্রেক্ষাপটে চরম ভাগ্যাহত মজলুম রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য মালয়েশিয়া থেকে পাঠানো মানবিক ত্রাণবাহী জাহাজ বহুল আলোচিত ‘নটিক্যাল আলিয়া’ গতকাল সকাল ১১টার দিকে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রধান চিটাগাং কন্টেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) জেটি-বার্থে এসে ভিড়ে। জাহাজটি আসে বন্দরের বহির্নোঙর থেকে। আসার কিছুক্ষণ পর সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জাহাজে উঠে স্বাগত জানান এবং মানবিক ত্রাণের চালান আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম বন্দরের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কমডোর জুলফিকার আজিজ, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার এএফএম আবদুল্লাহ, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক সামসুল আরেফিন ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেন, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ও আইওএম’র প্রতিনিধিরা এসময় উপস্থিত ছিলেন।
গত সপ্তাহে প্রথমে মানবিক ত্রাণবাহী জাহাজটি মিয়ানমারের বন্দরে পৌঁছালে ইয়াঙ্গুন শহরে একদল উগ্র বৌদ্ধভিক্ষুসহ রোহিঙ্গা-বিরোধীরা জাহাজ আগমনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-সমাবেশ করে। যা আন্তর্জাতিক বিবেকবান মহলে নিন্দিত হয়। মিয়ানমারে ৫শ’ মেট্রিক টন (আংশিক) ত্রাণসামগ্রী খালাস করা হয়েছিল। এর পরবর্তীতে জাহাজটি কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী টেকনাফের নাফ নদীতে আসতে চাইলেও সেখানে ভিড়ার উপযোগী গভীরতা (ড্রাফট) না থাকায় ‘নটিক্যাল আলিয়া’র ভিড়া হয়নি। পরে গত সোমবার কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়া উপদ্বীপ সংলগ্ন সাগর-কিনারে ত্রাণসামগ্রী খালাসের চেষ্টা চালিয়েও ক্রেন এবং জেটি-ঘাট না থাকাসহ বিভিন্ন টেকনিক্যাল কারণে তাও সম্ভব হয়নি। পরে সোমবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে এসে পৌঁছায় জাহাজটি। মালয়েশীয় ত্রাণবাহী জাহাজটি বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় পৌঁছার পর যথারীতি নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ নিজামুল হকের নেতৃত্বে স্বাগত জানানো হয়।
কর্মকর্তারা জানান, ‘নটিক্যাল আলিয়া’ জাহাজটি ১ হাজার ৪শ’ ৭২ মেট্রিক টন ত্রাণসামগ্রী নিয়ে আসে। এর মধ্যে আছে চাল, তেল, ওষুধ, পোশাকসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। কন্টেইনার এবং খোলা (বাল্ক) উভয় প্যাকিংয়ে এসব মানবিক ত্রাণ এই জাহাজে এসেছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এবং বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির সহযোগিতায় হতভাগ্য রোহিঙ্গাদের মাঝে এসব ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হবে। ত্রাণসামগ্রী বিতরণকালে মালয়েশিয়া সরকার, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ও আইওএম’র স্বেচ্ছাসেক এবং সাংবাদিক মিলে ২৫ জনের একটি প্রতিনিধি দল উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
তুরস্কভিত্তিক তার্কি দিয়ানেত ভাকফি (টিডিভি) ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় পুতেরা ওয়ান মালয়েশিয়া ক্লাব ও মালয়েশিয়ান কনসালটেটিভ কাউন্সিল অব ইসলামিক অর্গানাইজেশন (এমএপিআইএম) মিয়ানমারের জন্য জাহাজে করে ত্রাণ সরবরাহের কাজটি করছে। ত্রাণসামগ্রী সরবরাহের জন্য ‘নটিক্যাল আলিয়া’ জাহাজটিতে চিকিৎসক, স্বেচ্ছাসেবক, সাংবাদিকসহ ১৩টি দেশের ২৩০ জন স্বেচ্ছাসেবী রয়েছেন। জাহাজটিতে মালয়া ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল সেন্টারের চিফ হার্ট সার্জন প্রফেসর রাজা আমিন রাজা মোখতারসহ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের একটি বড় দল রয়েছে। রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণে তারা সরাসরি অংশ নিতে আগ্রহের কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশের সরকারি পর্যায়ে। এর জন্য তারা অন এরাইভাল ভিসার জন্যও অনুরোধ রেখেছেন। অবশ্য বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তদারক করছে।
প্রশাসন সূত্র ত্রাণ-প্রস্তুতি সম্পর্কে জানায়, আনীত ত্রাণসামগ্রী ১৫০টি ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানযোগে কক্সবাজার শহর হয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উখিয়া ও টেকনাফ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হবে। এরপর তা ১৫ হাজার পরিবারের মাঝে বিতরণ করা হবে। এর মধ্যে টেকনাফের সাড়ে ৫ হাজার রোহিঙ্গা পরিবার ও উখিয়ায় ৯ হাজার পরিবারকে ত্রাণসামগ্রী দেয়া হবে। এর জন্য ১৬ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠিত হয়েছে। এছাড়া নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) নেতৃত্বে উপজেলা কমিটিও গঠন করা হয়েছে। ত্রাণসামগ্রী বিতরণের প্রাক্কালে খুব সাময়িকভাবে (ট্রানজিট) মজুদে রাখার জন্য কয়েকটি গুদাম ভাড়া করা হয়েছে। গুদামে নেয়ার পর এসব ত্রাণসামগ্রী ১৫ হাজার প্যাকেটে ভাগ করা হবে। এ কাজ সম্পন্ন করতে মাত্র ২ থেকে ৩ দিন সময় লাগবে।
এদিকে নিপীড়িত রোহিঙ্গা মুসলমানদের চরম দুঃসময়ে পাশে দাঁড়ানো এবং ত্রাণসামগ্রী নিয়ে ‘নটিক্যাল আলিয়া’ জাহাজটি মানবিক ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বন্দরে আসার বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রামের সাধারণ জনগণের মাঝে এখানে-সেখানে ব্যাপকভাবে আলোচনা হচ্ছে। অনেকেই এহেন মহতি উদ্যোগের জন্য মালয়েশিয়ার ভ্রাতৃপ্রতীম জনগণ ও সরকারের প্রতি ধন্যবাদ জানাচ্ছেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ