ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
মোহাম্মদ আবু নোমান : বলা হয়, সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশ। অথচ বারবার বিভিন্ন মিডিয়ায় আমাদের দেখতে হয়, শুনতে হয়, পড়তে হয়Ñ পিএসসি বা জেএসসি পরীক্ষার্থী শিশুদেরও ‘মায়ের লাশ, কি পিতার লাশ বাড়িতে রেখে পরীক্ষা’ দেওয়ার খবর। মেহেরবান আল্লাহপাক মানুষের জন্য নামাজের মতো এত বড় ফরজ এবাদতকে সফর অবস্থায় অর্ধেক পড়তে বলেছেন। মহিলাদের বিশেষ অবস্থায় নামাজকে সম্পূর্ণ মাফ করে দিয়েছেন। অসুস্থতায় রোজা আদায়ে মাফ ও কাজার বিধান রয়েছে। অথচ পৃথিবীর সবচেয়ে আপন, আশ্রয়ের একমাত্র কেন্দ্রস্থল, আশার প্রদীপ, আমাদের আত্মবিশ্বাস, অনুপ্রেরণা, সাফল্য, আদর, সোহাগ, মমতায় ভরা বাবা ও মায়ের লাশ ঘরে রেখে কিংবা বাড়ির সামনে কবর খুঁড়তে দেখেও পরীক্ষা দিতে হয়!
চলমান এসএসসি পরীক্ষায় চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার নিশ্চিন্তপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী রুমাকে মায়ের লাশ বাড়িতে রেখেই পরীক্ষা দিতে হলো। একদিকে রুমার নিজের ভবিষ্যৎ, অপরদিকে মায়ের লাশ। শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা কেন্দ্রে যেতে হলো রুমাকে। পরীক্ষা শুরুর আগের দিন রাতে তার মা হাজেরা আক্তার মৃত্যুবরণ করেন। বৃহস্পতিবার নিশ্চিন্তপুর উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে জানা যায়, রুমার বাবা মেজবাহ উদ্দিন শিকদার এক বছর আগে মৃত্যুবরণ করেন। ৩ ভাই-বোনের মধ্যে সে-ই বড়। বাবার মৃত্যুর পর অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া চালিয়েছে সে। পরীক্ষা শেষে সাংবাদিক ও শুভাকাক্সক্ষীরা রুমার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে সে কান্নায় ভেঙে পড়ায় কথা বলা যায়নি।
অতি ছোট্ট এবং সবচেয়ে সুন্দর ও মধুর শব্দটি হচ্ছে মা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ সবকিছুর ঊর্ধ্বে মা, যার নেই কোনো উপমা-তুলনা। সব মায়ের ভালোবাসাই অকৃত্রিম ও এক। প্রতিটি মানুষের কাছেই তার মা তুলনাহীন ও অনন্যা। মা কখনো পুরনো হন না। মার কাছে থাকলে কোনো অপ্রাপ্তি থাকে না। মায়ের বুক হচ্ছে সন্তানের জন্য নিরাপদ আশ্রয়। মায়ের ভালোবাসা হচ্ছে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ, সবচেয়ে নির্ভেজাল ও স্বার্থহীন। যার ঋণ কেউ কখনো শোধ করতে পারবে না, সম্ভবও নয়। ‘মায়ের একধার দুধের দাম/ কাটিয়া গায়ের চাম/ পাপশ বানাইলেও ঋণের শোধ হবে না/ এমন দরদি ভবে কেউ হবে না...’। ইতোপূর্বে এই মায়ের লাশ ঘরে রেখে পরীক্ষা দিয়েছিল পটিয়ার এয়াকুবদ-ী গ্রামের তানিয়া। রাত পোহালেই বায়োলজি পরীক্ষা তানিয়ার। পরীক্ষার জন্য নিবিড় প্রস্তুতি নিচ্ছিল সে। রাত ১১টায় মারা যায় তানিয়ার মা। প্রিয় মাকে হারিয়ে গগণবিদারী আওয়াজে চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে তানিয়া। সেই শোক নিয়ে সারা রাত অঝোর ধারায় কান্না ও লাশ ঘরে রেখে সকালে পরীক্ষা দিতে আসে তানিয়া। বিকালে পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি গেলে যথারীতি মায়ের লাশ দাফন করা হয়। তার বাবা সামান্য একজন দিনমজুর। কখনো তিনি কাজ পান আবার কখনো পান না। মা সেলাইয়ের কাজ করে যা উপার্জন করতেন তা দিয়ে সংসার চলত। তানিয়ার কোনো প্রাইভেট শিক্ষক ছিল না। তানিয়া বলেন, মা শত বাধা উপেক্ষা করে দর্জির কাজ করে আমার পড়ার খরচ চালাতেন। অভিভাবক বলতে আমার মা-ই আমার সব।
কবির ভাষায়Ñ ‘মা কথাটি ছোট্ট অতি, কিন্তু যেন ভাই/ মায়ের চেয়ে নাম যে মধুর, ত্রিভুবনে নাই’। কালে কালে একটি কথাই চিরায়ত সত্যিতে পরিণত হয়েছে, আর সেটি হচ্ছেÑ পৃথিবীতে মা শব্দের চেয়ে অতি আপন, মধুর, মিষ্টি আর দ্বিতীয় শব্দ নেই। সন্তানের কাছে সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছেন তার মা। মা মানে অস্তিত্ব, মা মানে আশ্রয়, মা মানে মমতা। মায়ের ভালোবাসা, স্নেহ ও ত্যাগের কথা লিখে বা বলে শেষ করা যাবে না। ট্রলারডুবিতে এই মমতাময়ী ময়ের লাশ রেখে পরীক্ষার হলে যায় চম্পা। যেভাবে মা পাখিটা রোদ-বৃষ্টি এবং গাঙচিলের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য পালক দিয়ে তার ছানাকে আগলে রাখে ঠিক সেরকম বাবা হারানো চম্পাকে তার মা আগলে রেখেছিলেন। বাড়িতে আসছে মায়ের লাশ। এমন খবরে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিল চম্পা। এরপরও পাড়া-প্রতিবেশীদের টানা-হেঁচড়ায় তাকে যেতে হয় পরীক্ষা কেন্দ্রে। পরীক্ষার পুরো সময়টাই যেন তার কাছে এক দুঃসহ সময়। জীবনের পরীক্ষায় যেখানে বারবার তাকে পরাজিত হতে হচ্ছে। একাডেমিক পরীক্ষায়ও কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন চম্পা। সেই ছোট্ট বয়সে বাবা নারায়ণ সূত্রধরকে হারিয়ে মাকেই একমাত্র অবলম্বন হিসেবে পেয়ে আসছিল চম্পা। মাথার ওপর যে আর কোনো ছায়াই রইল না তার। একমাত্র ভাই অর্জুন যেন পাগল হয়ে গেছে। কোনো কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না মায়ের এই করুণ মৃত্যু। দুটি ভাইবোনের সব আশার প্রদীপই যেন ধপ করে নিভে গেল নিয়তির নির্মম ঝাপটায়।
জীবন চলার পথে ক্ষুধা, পিপাসা, দারিদ্র্যসহ নানা অভাব-অভিযোগেও অদম্য শ্রম, সাহসসহ রোদে, বৃষ্টিতে হাড়ভাঙা খাটুনি ও ইচ্ছাশক্তি জুগিয়ে থাকে যে বাবা, এই ক্ষুদ্র জীবনে চলার পথে আমাদের নির্ভর একমাত্র বাবা। যখনই বিপদে, হতাশায় ডুবে বিচলিত হয়ে পড়ে সন্তান, তখনই বন্ধু হয়ে উৎসাহ দিয়ে থাকে বাবা। যে বাবাই আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে স্বপ্ন দেখতে হয়, স্বপ্ন ধরতে হয়। একমাত্র আশার প্রদীপ সে পিতার মৃতদেহ বাড়িতে রেখে ইতোপূর্বে শোকে স্তব্ধ প্রদীপ ম-লকে পিএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়েছে। আকস্মিকভাবে সব কিছু উলট-পালট করে দেয় কোমলমতি প্রদীপের হৃদয়কে। একদিকে পিএসসি পরীক্ষা অন্যদিকে বাবার লাশ। স্বজনদের আহাজারিতে চারদিকে যখন আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। এহেন হৃদয়বিদারক মুহূর্তে কোন দিকে যাবে সে? কিংকর্তব্যবিমূঢ় প্রদীপ তার বাবার লাশ রেখে সকলের ধরাধরিতে ছুটল পরীক্ষার হলে। অন্যরা তখন ব্যস্ত শেষকৃত্যের আয়োজনে। প্রদীপ দক্ষিণ বাইনবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিএসসি পরীক্ষার্থী। গড়ইখালীর বাইনবাড়িয়ার কাঁঠালতলা চকের বৈকুণ্ঠ ম-লের ছেলে প্রদীপ। পরীক্ষা শেষ করে ছেলে প্রদীপ ছুটে যায় স্থানীয় শ্মশানে বাবার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে। ১০ মাস আগে প্রদীপের মাও সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। বিষয়টি প্রদীপের সহপাঠীদের পাশাপাশি এলাকাবাসীকে নাড়া দেয় দারুণভাবে। পরীক্ষায় দায়িত্বরত উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ইসলামুল হক মিঠু বলেন, যে কোনো সন্তানের জন্য এ শূন্যতা পূরণের নয়। বাবার মৃত দেহ বাড়িতে রেখে প্রদীপ পরীক্ষা দিয়েছে। হলে পুরোটা সময় তার চোখে-মুখে ছিল কান্নার রোল। বিষয়টি সহপাঠীদের কারো চোখও এড়ায়নি। তারাও কান্নায় ভেঙে পড়ে।
পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল রিদাত ফারহান। মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই কলম-পেনসিল আর প্রবেশপত্র নিয়ে রওনা হবে জীবনের দ্বিতীয় পাবলিক পরীক্ষা কেন্দ্রে। সঙ্গে নিয়ে যাবে ছায়াসম পিতার দোয়া। কে জানত জীবনের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তাকে শুনতে হবে সেই পিতারই মৃত্যুর খবর। পুরো আকাশসম যন্ত্রণা ঘিরে ফেলে শিশু রিদাতকে। অসহনীয় এই যন্ত্রণা বুকে নিয়েই পরীক্ষার হলে যায় রিদাত। আর ইউনিফর্ম পরা অবস্থাতেই প্রিয় বাবাকে চিরতরে বিদায় জানায় সে। ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় লেখক ও প্রকাশক ফয়সল আরেফীন দীপনকে। বাবার শেষ বিদায়ের দিন ছিল যার জেএসসি পরীক্ষা। খুন হওয়ার কিছুক্ষণ আগে রিদাতের সঙ্গে শেষ কথা হয় দীপনের। তখন আজিজ সুপার মার্কেটেই ছিলেন দীপন। ঠিক এমন একটি সময়ে একটি খবরে তার পুরো পৃথিবী যেন অন্ধকারে ঢাকা পড়ে। বাবার জন্য হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে রিদাত ও হৃদমা। কিছুক্ষণ পরে পুরো নিস্তব্ধ হয়ে যায় রিদাত। রিদাত পরীক্ষা দিতেই চাইছিল না। অনেক বোঝানোর পর তাকে পরীক্ষার জন্য রাজি করানো হয়। সবাই রিদাতের মনে সাহস জোগানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখে। তাকে আলাদা একটি রুমে দিয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি চালিয়ে যেতে বলেন বুকভরা যন্ত্রণা নিয়ে মা রাজিয়া রহমান। তার ভাষ্য, একটি বছর লস দেয়া ঠিক হবে না। শোকার্ত ওই বাসায় সবার রাত যখন কেটেছে নির্ঘুমভাবে, রিদাতও না ঘুমিয়ে বাবার জন্য ডুকরে ডুকরে কেঁদেছে সারা রাত। সকাল বেলা রিদাতের মা ও সকল আত্মীয়স্বজন তাকে সান্ত¡না দেন। পরীক্ষার জন্য জামা-কাপড় পরে প্রস্তুত হতে বলেন। পরীক্ষা শেষে স্কুলের ইউনিফর্ম পরিহিত রিদাতকে সরাসরি নিয়ে আসা হয় বাবার জানাজায়। জানাজা শেষে বাবার কফিনের পিছু পিছু আজিমপুর কবরস্থানে আসে রিদাত।
যে বাবা নিজের জীবনের সব সুখ বিসর্জন দিয়ে থাকে সন্তানের জন্য, নিঃস্বার্থ স্নেহ ও ভালোবাসার প্রতীক যে, বাবা। মায়ামাখা শাসনের ছায়া যে বাবার মধ্যে, সন্তানের জন্য জগতের যা কিছু কল্যাণকর, তার আরেক নাম বাবা সে বাবার লাশ কবরে রেখে বিগত সময়ে সাতক্ষীরায় জেএসসি পরীক্ষা দিল তামিম হোসেন। বুকভরা ব্যথা, গগণবিদারী আর্তনাদ আর দুই চোখ ভরা পানি নিয়ে অংক পরীক্ষা দেয় সে। তার সাথে ছিলেন পল্লী শ্রী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও নিকট স্বজনরা। এই মর্মস্পর্শী হৃদয়বিদারক ঘটনায় হাজারো মানুষের মুখ ছিল বিষণœ, ছিল চোখ ভরা পানি।
পৃথিবীর সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে চিরদিনের মতো হারিয়েও পরীক্ষা দিতে যেতে হয় সন্তানের। ধিক্কার জানাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। পরীক্ষার্থীর এ শোক থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার পর উপজেলা বা জেলা সদরে বসে, সংশ্লিষ্ট শিক্ষা কর্মকর্তার উপস্থিতিতে, ভিন্নসেট প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে পরীক্ষা নেয়ার বিধান কি করা যায় না? কেন তা করা হয় না?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।