Inqilab Logo

সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

শাহজালাল বিমানবন্দরে রাডার স্থাপনের নামে লুটপাটের মিশন

| প্রকাশের সময় : ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরেও বন্ধ হচ্ছে না : পিপিপির মাধ্যমে ১৭শ’ কোটি টাকায় রাডার স্থাপন প্রকল্প বাতিলের পর তা পুনরায় বাস্তবায়নের জন্য মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছে প্রভাবশালী মহল
স্টাফ রিপোর্টার : হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অত্যাধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির রাডার স্থাপন প্রকল্প নিয়ে আবারো লুটেরা প্রভাবশালী চক্রটি নানা পাঁয়তারা চালাচ্ছে। রাডার স্থাপনের নামে লুটপাটের মিশন নিয়ে তৎপর রয়েছে একটি চক্র। রাডার স্থাপন প্রকল্পটি পিপিপির মাধ্যমে বাস্তবায়ন না করে তা বাতিল করতে গত মাসে  বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারপরেও  অসাধু একটি চক্র মরিয়া হয়ে নানা পাঁয়তারা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রস্তাবিত ১৭ শত কোটি ব্যয়ে প্রকল্পটি করতে গেলে সরকারের ১৪ শত কোটি টাকা অপচয় হবে বলে মূল্যায়ন কমিটি ও মন্ত্রণালয় কয়েক দফায় মতামত পেশ করেছে।  গত ১ জানুয়ারি তা বাতিল করার জন্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও রহস্যজনক কারণে তা অর্থ মন্ত্রণালয়ে আটকা পড়েছে। গত বৃহস্পতিবার ৯ ফেব্রুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে প্রকল্পটি বাতিলের জন্য উপস্থাপন করা হলেও এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত অনুমোদন মিলেনি। প্রভাবশালীদের কারসাজিতে তা আটকে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অমান্য করে নানা অজুহাতে  ৩ শত কোটি টাকার প্রকল্প ১৭ শত কোটি টাকায় বাস্তবায়নের জন্য ওঠেপড়ে লেগেছে চক্রটি এ অভিযোগ সিভিল এভিয়েশন ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, পিপিপির মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন না করে সরকারি অর্থায়নে অর্থাৎ সিভিল এভিয়েশনের নিজস্ব অর্থায়নে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, আগের প্রস্তাব বাতিল করে নতুনভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা চলছে। বিষয়টি এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে।
বিমান মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, পিপিপির প্রকল্প বাতিল না করার জন্য প্রভাবশালী চক্রটি সচিব মহোদয়কে নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করেও ব্যর্থ হয়েছে। ওই চক্র এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের গায়ে শোয়ার হতে নানা পাঁয়তারা চালিয়ে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অত্যাধুনিক রাডার  টাওয়ার স্থাপনের নামে প্রায় ১৪শ’ কোটি টাকা লুটপাটের যে  আয়োজন করেছিল সিভিল এভিয়েশনসহ একটি প্রভাবশালী চক্র তা বাতিলের জন্য গত বৃহস্পতিবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব এএস এম গোলাম ফারুক স্বাক্ষরিত প্রস্তাবনায় বলা হয়,  প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপ (পিপিপি)-এর মাধ্যমে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ৩শ’ কোটি টাকায় অনুমোদন করা হয় ২০১২ সালে। পরবর্তীতে তা বাড়িয়ে  পিপিপির মাধ্যমে ১৭শ’ ৫৫ কোটিতে করার জন্য সিভিল এভিয়েশন সিদ্ধান্ত নেয়। তিন শত কোটি টাকার প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদনের পর রহস্যজনক কারণে তা ১৭ শত ৫৫ কোটিতে করার প্রচেষ্টা চালানো হয়। এতে সরকারি অর্থের অপচয় হবে। বিষয়টি বিমান মন্ত্রণালয়ের নজরে যাওয়ার পর প্রকল্পের ব্যয় পুনরায় মূল্যায়নের জন্য বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন সিভিল এভিয়েশনকে নির্দেশ দেন এবং এ প্রেক্ষিতে মন্ত্রীর নির্দেশে তা বাতিলের জন্য  সিদ্ধান্ত হয়েছে। গত ৬ নভেম্বর বিমান মন্ত্রীর নির্দেশে মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী প্রধান জাকিয়া আফরোজ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে সিভিল এভিয়শনকে এ নির্দেশ দেয়া হয়। চিঠির নির্দেশে বলা হয়েছিল, এ প্রকল্পের জন্য যে সব যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম  কেনা হবে তার মূল্য তালিকা এবং কোম্পানির নামসহ একটি তালিকা  মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর জন্য সিভিল এভিয়েশনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া রাডারের যন্ত্রাংশ এবং কোন কোন কাজে কি কি ব্যবহার করা হবে এর মূল্য তালিকা এবং প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির কারণ উল্লেখ করে বিস্তারিত মন্ত্রণালয়কে জানাতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ও অন্যদের প্রশিক্ষণসহ যাবতীয় ব্যয়ের একটি তালিকাও মন্ত্রণালয়কে দিতে বলা হয়েছিল।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পিপিপির মাধ্যমে ১৭শ’ ৫৫ কোটি টাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রাডার স্থাপনের যে প্রকল্পের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল তা অত্যধিক ব্যয় বলে দরপত্রের মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশ গ্রহণযোগ্য নয়। ফলে তা বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সর্বশেষ গতকাল  রাডার স্থাপনের ওই প্রকল্পটি বাতিল করে সিভিল এভিয়েশনের নিজস্ব অর্থায়নে স্থাপন করার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়েছে। এছাড়া বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তার বিষয়টি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিধায় এ পর্যায়ে দরপত্র পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ না করে দ্রুত সিভিল এভিয়েশনের নিজস্ব অর্থে তা বাস্তবায়নের জনেও মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে।
এদিকে সিভিল এভিয়েশনের একটি সূত্র জানায়, একটি অসাধু চক্র এবং প্রকল্প পরিচালক মাত্র ৩ শত কোটি টাকা বিনিয়োগ বিপরীতে ১৭শ’ কোটি টাকায় প্রকল্পটি অনুমোদনের পাঁয়তারা করেছিল। মূলত এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের নামে তারা শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে  নেয়ার ফাঁদ তৈরি করেছিল। এ প্রকল্পটি বাতিল হলে দেশ প্রায় ১২শ’ কোটি টাকার ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে। কারণ তা বাস্তবায়ন করতে ৫শ’ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হবে না। এছাড়া সিভিল এভিয়েশনের এক হাজার কোটি টাকার বেশি নিজস্ব অর্থ ব্যাংকে অলস পড়ে রয়েছে। তাই সিভিল এভিয়েশন নিজস্ব অর্থায়নে তা বাস্তবায়ন করতে পারবে। পিপিপি-এর মাধ্যমে রাডার স্থাপন প্রকল্পটি বাতিল হলে শুধু সিভিল এভিয়েশন নয়, সরকার বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে।
সিভিল এভিয়েশন একটি সূত্রে জানা যায়, এ প্রকল্পটি ২০১২  থেকেই সিএএবি-এর বহুল আলোচিত ভুয়া ও অসত্য তথ্যের উপর ভিত্তি করে বানানো। সিএএবি-এর কাছে যথেষ্ট টাকা না থাকার কারণ  দেখিয়ে রাডার কন্ট্রোল টাওয়ার এবং সংশ্লিষ্ট কমিনিকেশন ইকুয়ুপমেন্ট নামে প্রথম থেকেই এই কাজটি পিপিপি-এর মাধ্যমে করার চেষ্টা শুরু হয়। সিএএবি এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টের পিপিপি-এর মাধ্যমে করতে চায় যা কিনা তাদের বাৎসরিক আয়ের শতকরা ৮০ ভাগের যোগান দেয়। সবচেয়ে বেশি আয়ের এই  প্রকল্পটি পিপিপি-এর মাধ্যমে করলে ব্যাপক লুটপাটের সুযোগ পাবে পিপিপি মালিকপক্ষ। কারণ তারা এই বাৎসরিক আয়ের একটি বড় অংশের ভাগ পাবে। এটাই পিপিপি’র মাধ্যমে কাজ করানোর প্রধান উদ্দেশ্য বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন। প্রথম বছরে ২৫০ কোটি টাকা এবং পরবর্তী ১০ বছরে ৪০-৬০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সিএএবি এর বাৎসরিক আয়ের বেশিরভাগ অংশ নিয়ে যাবে ওই কোম্পানি। অপরদিকে অবশিষ্ট আয় দিয়ে সিএএবি তাদের ৯টি বিমান বন্দর পরিচালনা ও কোটি কোটি টাকায় স্থাপিত যন্ত্রপাতি পরিচালনা করবে। যে কাজ সিএএবি এর বাৎসরিক আয়ের শতকরা ৮০ ভাগ যোগান দেয়, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প-এ বিনিয়োগ করার জন্য সিএএবি এর কাছে ৩শ’ কোটি টাকা নেই এটা বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে সংশ্লিষ্টরা দাবি করেছিলেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সিভিল এভিয়েশনের এক হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যাংকে অলস পড়ে আছে বলে সিভিল এভিয়েশনের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ